Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

হিটলারের হাতে যদি অ্যাটম বোমা থাকত

হিরোশিমা-নাগাসাকির পর নোবেল প্রাইজ পেলেন অটো হান। অথচ তিনি বেপাত্তা। পুরস্কার অনুষ্ঠানে, অতএব, গরহাজির। কোথায় তিনি? কী করছেন? হিরোশিমা-নাগাসাকির পর নোবেল প্রাইজ পেলেন অটো হান। অথচ তিনি বেপাত্তা। পুরস্কার অনুষ্ঠানে, অতএব, গরহাজির। কোথায় তিনি? কী করছেন?

হিরোশিমায় অ্যাটম বোমার ছবি।

হিরোশিমায় অ্যাটম বোমার ছবি।

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৭ ০৮:৪০
Share: Save:

এখন বিজ্ঞানে ক্রিসমাস। উৎসবের মরশুম। এখন প্রায় রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান কেউ কেউ। একটি শিরোপার সুবাদে। নোবেল প্রাইজ। ১১৭ বছর পুরনো হওয়া সত্ত্বেও এই পুরস্কার এখনও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আর কোনও প্রাইজ গ্ল্যামারে ছাপিয়ে যেতে পারল না ওটিকে। পুরস্কার ঘিরে কত উপাখ্যান, কত নাটক! বৈচিত্রে তাদের মধ্যেও স্বতন্ত্র একটি বছরে বিশেষ একটি বিভাগের ইনাম। ১৯৪৪, রসায়ন। নোবেলের ইতিহাসে যা স্মরণীয়, ঘটনার ঘনঘটায়।

১৫ নভেম্বর, ১৯৪৫। স্টকহল্‌ম থেকে ঘোষণা। আগের বছর— অর্থাৎ ১৯৪৪ সালের— কেমিস্ট্রি নোবেলের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন জার্মান বিজ্ঞানী অটো হান। প্রাইজের ইতিহাসে এমন রীতি (কোনও বছরের পুরস্কার পরের বছরে দেওয়া) নতুন নয়। আগেও ঘটেছে। আসলে ১৯৪৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ উত্তাল। সে পরিস্থিতিতে সম্ভব হয়নি পুরস্কারের জন্য বিজ্ঞানী নির্বাচন।

১৯৪৪-এর রসায়নে নোবেল বিরল বিশেষ কারণে। প্রাইজ তো ঘোষণা হল, কিন্তু কোথায় বিজেতা? নোবেল কমিটি জানেই না হান কোথায়, জানে না তাঁর পরিবারও। ফলে, তিনি যে হাজির হয়ে পুরস্কার নেবেন না, তা নিশ্চিত। এ রকম ‘নিরুদ্দেশ’ বিজ্ঞানীকে নোবেল! চারদিকে বিস্ময় আর প্রশ্নচিহ্ন।

সত্যিটা কী? তা এই যে, হান তখন এক গোপন ডেরায় বন্দি। সে আর এক কিস্‌সা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার অ্যাটম বোমা বানানো স্রেফ হিটলারের ভয়ে। জার্মানির বিজ্ঞানীরা বুঝি তা বানিয়ে ফেলছে, এই আশংকায়। যুদ্ধে গো-হারা হারলেন হিটলার। তিনি ফাটালেন না অ্যাটম বোমা। বরং ফাটাল আমেরিকা, হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। তার আগে থেকেই আমেরিকা ব্রিটেনের এক ফন্দি। জানতে হবে, জার্মান বিজ্ঞানীরা কত দূর এগিয়েছিলেন বোমার লক্ষ্যে। জানা যায় কী ভাবে?

যুদ্ধে হেরে জার্মানি যখন ছত্রভঙ্গ, ও দেশে হু-হু করে ঢুকছে ব্রিটিশ ও মার্কিন সেনা, তখন তাদের ঠিক পিছনে চলল পরমাণু বিজ্ঞানীদের বিশেষ দল। তাঁদের মিশন? জার্মানিতে অ্যাটম বোমা বানানোর কাজে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, এমন বিজ্ঞানীদের গ্রেফতার করা। মিশন সাকসেসফুল। একে একে ধরা পড়লেন এরিখ ব্র্যাগ, কার্ট ডিবনার, ওয়াল্টার গ্যেরলাখ, পল হার্টেক, হরস্ট করশিং, ম্যাক্স ফন ল, কার্ল ওয়ার্টজ, কার্ল ফ্রিডরিখ ফন ওয়াইজাকার, ভার্নার হাইজেনবার্গ এবং অটো হান।

দশ বিজ্ঞানীকে নিয়ে আসা হল ইংল্যান্ডে, কেমব্রিজের কাছে গডম্যাঞ্চেস্টার নামের গ্রামে। অন্তরীণ করে রাখা হল ‘ফার্ম হল’ নামের এক ম্যানসনে। সে বাড়ির দেওয়ালে লুকনো মাইক্রোফোন বসানো, যাতে ওই দশ জনের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা আড়ি পেতে শোনা যায়। অ্যাটম বোমা বানানোর লক্ষ্যে কোথায় কখন কতটা কাজ হয়েছে, তা জানতে বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে লাভ নেই। ওঁরা সত্য ফাঁস করবেন না। তাই গোয়েন্দাগিরির এই কৌশল। নিজেদের আড্ডায় ওঁরা নিশ্চয়ই খোলা মনে আলোচনা করবেন সব। তা-ই হল। দশ বিজ্ঞানী বন্দিদশায় রইলেন ১৯৪৫-এর ৩ জুলাই থেকে ’৪৬-এর ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত। ছ’মাস ধরে ওঁদের প্রতি মুহূর্তের কথোপকথন রেকর্ড করা হল। জানা গেল অনেক কিছু।

হায়, তা জানলেন না জার্মান বিজ্ঞানীরা। কী করে জানবেন, ওঁরা তো খবর পাননি লুকনো মাইক্রোফোনের! বোকাই বলতে হবে ওঁদের। প্রমাণ, ফার্ম হল-এ পা দিয়েই ডিবনার এবং হাইজেনবার্গের কথোপকথন।

ডিবনার: ভাবছি, দেওয়ালে মাইক্রোফোন বসানো নেই তো?

হাইজেনবার্গ: লুকনো মাইক্রোফোন? নাহ্‌, ওরা অত দুষ্টু নয়। আমার মনে হয় না ওরা গেস্টাপোদের কায়দাকানুন জানে। ও ব্যাপারে ওরা পিছিয়ে আছে।

ফিরে আসি হান-কিস্‌সায়। কোন কৃতিত্বের জন্য নোবেল প্রাইজ তাঁকে? নোবেল কমিটি জানাল: ‘ফর হিজ ডিসকভারি অব দ্য ফিশন অব হেভি নিউক্লিয়াই’। মানে? সোজা কথায়, ভারী পরমাণু ভেঙে দু’টুকরো করায় সাফল্যের জন্য। যে কাজ কিনা অ্যাটম বোমার মূল কথা। যা ঘটেছে হিরোশিমায়, নাগাসাকিতে। দু’টো শহর ধূলিসাৎ। প্রাণবলি লাখের ওপরে। হান নিজে দু’টো বোমা বানাননি বটে। তবু, তাঁর কাজের সূত্রেই তো এসেছে বোমা দু’টি। এই বিজ্ঞানীকে নোবেল! অথচ, প্রাইজের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড সাহেব উইলে বলেছিলেন, পুরস্কার পাবে তাঁরা, যাঁদের কাজ মানুষের ‘দারুণ উপকারে লাগবে’। সে কথা স্মরণ করে চারদিকে বিস্ময়, ঘৃণা।

নোবেল কমিটি সে প্রতিক্রিয়া অনুমান করেনি তা নয়। তবে, সে চিন্তা ছাপিয়ে গিয়েছে দুই ভাবনা। এক, ফলাফল বাদ দিয়ে শুধু বিজ্ঞানের বিচারে পরমাণু-বিভাজন বিরাট এক কাজ। দুই, রাজনীতি। ১৯৩৭-এ হিটলার ফতোয়া দিয়েছিলেন, কোনও জার্মান বিজ্ঞানী নোবেল নিতে পারবেন না। প্রত্যাখ্যানের অপমান থেকে বাঁচতে নোবেল কমিটিও ও দেশের কাউকে দেয়নি পুরস্কার। তাই যুদ্ধ শেষে বদলা নেওয়ার সুযোগ, এবং সদ্ব্যবহার।

কিন্তু সে তো নভেম্বরের ব্যাপার। তার তিন মাস আগে অগস্টের প্রথম সপ্তাহে কী হল? যখন ৬ ও ৯ তারিখে হিরোশিমা ও নাগাসাকির বুকে দুই অ্যাটম বোমা দেখাল তাদের রক্তক্ষুধা? ফার্ম হল-এ আটক বিজ্ঞানীদের প্রতিক্রিয়া আড়ি পেতে শুনে জানা গেল অনেক কিছু।

প্রথমে অনুশোচনা। ফার্ম হল-এর দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ সেনা অফিসার রিপোর্টে লিখেছেন, ৬ অগস্ট সন্ধেবেলা ডিনারের কিছু আগে তিনি হান-কে জানান বিবিসির খবর, আমেরিকা হিরোশিমায় অ্যাটম বোমা ফেলেছে। শুনে হান বিধ্বস্ত। অফিসারকে বললেন, প্রথম যে দিন টের পেয়েছিলেন নিজের আবিষ্কারের এমন কদর্য সম্ভাবনা, সে দিন আত্মহত্যা করবেন ভেবেছিলেন। আজও বারবার বলতে লাগলেন, সব দোষ তাঁর। অনেকটা অ্যালকোহলের প্রভাবে তাঁর মুড বদলানো গেল।

এর পর অবিশ্বাস। হান সতীর্থ বিজ্ঞানীদের খবরটা দিতে সবাই আকাশ থেকে পড়লেন। ধুস, সব আমেরিকার ধাপ্পাবাজি। সন্দেহ নানা ব্যাপারে। বোমা বানাতে লাগে কতটা ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম? আমেরিকা কি জোগাড় করেছে তা? কী ভাবে? রাত ন’টার বিবিসি নিউজ। দশ বিজ্ঞানী রেডিয়োর সামনে হুমড়ি খেয়ে। আমেরিকা সত্যিই বোমা ফেলেছে। অবশ্য তার আগেই খবর সত্যি ধরে নিয়ে শুরু হয়েছে বিস্ময়, হা-হুতাশ, তর্ক, ঝগড়া, গালাগালি। যা পারেনি জার্মানি, তা করে দেখাল আমেরিকা! কেন ব্যর্থ জার্মান বিজ্ঞানীরা? ওঁরা চাননি অমন নৃশংস অস্ত্র হিটলারের হাতে তুলে দিতে। ধুস, ওটা সাজানো কথা। সত্যিটা এই, আমেরিকা সরকার যে ভাবে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করেছে, তা করেনি নাত্‌সি প্রশাসন। না, ওটাও নিজেদের সাফাই গাওয়া। বন্দিদশা শেষ হবে এক দিন। ব্রিটিশ সেনা গুলি করে না মারলে দেশে ফিরে শুনতে হবে দেশভক্ত জার্মানদের ধিক্কার। সবই আঙুল তুলে বলবে, ওরা ‘হেরো’।

উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময়ের মাঝে হঠাৎ সরে গেলেন ওয়াল্টার গ্যেরলাখ। একছুটে নিজের শোবার ঘরে। সেখান থেকে কান্নার আওয়াজ। দৌড়ে গেলেন ম্যাক্স ফন ল এবং পল হার্টেক। দেখলেন, গ্যেরলাখ চিৎকার করছেন। দেশে ফিরে এ মুখ দেখাবেন না। নিজেকে গুলি করে মারবেন। হাতের কাছে পিস্তল না পেয়ে ছটফট করছেন। এর পাশাপাশি তিন জনের কথোপকথন তাৎপর্যপূর্ণ।

ফন ওয়াইজাকার: আমি বলব, আমেরিকা যা করল তা নৃশংস। স্রেফ উন্মত্ত আচরণ।

হাইজেনবার্গ: তা বলা যায় না। বরং বলা যায়, এটাই যুদ্ধ শেষ করার দ্রুততম পন্থা।

হান: ওই যুক্তিই আমার সান্ত্বনা।

এক সময় আলোচনার মোড় ঘুরে গেল অন্য দিকে। বিবেকদংশন কিংবা ‘হেরো’ প্রতিপন্ন হওয়ার গ্লানির চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াল নিজেদের ভবিষ্যৎ। আশ্চর্য, কী মিল মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ওঁদের চিন্তার! হিরোশিমা-নাগাসাকির আগেই জাপান পরাজিত। অ্যাটম বোমা না ফেললেও আমেরিকা জয়ী হত। কিন্তু জাপান চালিয়ে যাচ্ছিল যুদ্ধ। মরছিল আমেরিকান সেনা। যুদ্ধে ইতি টানতে হিরোসিমা-নাগাসাকি। যুদ্ধ চালু থাকলে বন্দিদশা থেকে মুক্তি নেই। হাইজেনবার্গ এবং হান তাই সান্ত্বনা খুঁজছেন অ্যাটম বোমার মধ্যেও।

আর এর তিন মাস দশ দিন পর, যে দিন ঘোষণা হল হান-এর নোবেল প্রাইজ? ১৬ নভেম্বর, ১৯৪৫। বন্দি দশ বিজ্ঞানী পড়লেন ‘ডেলি টেলিগ্রাফ’ কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা খবর। আড়ি-পেতে শোনা ওঁদের কথোপকথনে এ বারও প্রথমে অবিশ্বাস। খবরটা ঠিক তো? বন্দি করে রেখেছেন যাঁরা, সেই কর্তৃপক্ষ কি পারেন না খবরের সত্যতা যাচাই করে জার্মান বিজ্ঞানীদের জানাতে? খবর সত্যি হলে কর্তৃপক্ষ কি হানকে স্টকহল্‌ম গিয়ে পুরস্কার নিতে দেবেন? যদি দেন, হান তাঁর এখনকার ঠিকানা কী বলবেন? কাগজে-কলমে যে লেখা হচ্ছে, হান নিরুদ্দেশ!

খবর যে সত্যি, তা জানার পর হল উৎসব। ডিনার, ভাষণ, মানপত্র পাঠ। সব শেষে সমস্বরে গান। ছড়ার আকারে। চার লাইনের অনেক ছড়া। প্রথম দু’লাইনে বহু বিষয়। কেন বন্দিদশা থেকে হানকে পুরস্কার। প্রত্যেক ছড়ার শেষ দু’লাইন এক। ‘যদি বলো দোষ কার?/ দোষীর নাম অটো হান।’ পরের বছর, ১৯৪৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর— হান নিলেন পুরস্কার। রীতি অনুযায়ী, পুরস্কার নিয়ে ভাষণ দিতে হয়। বক্তৃতায় হান খোঁচা দিতে ছাড়লেন না আমেরিকাকে। জানালেন, পরমাণু ভেঙে দু’টুকরো করার কাজটা তাঁর নেতৃত্বে যদিও হয়েছে জার্মানিতে, বোমা কিন্তু ফাটিয়েছে ওই দেশ।

পরমাণু বিভাজন বা ‘ফিশন’ বিজ্ঞানে এক মহা-উপাখ্যান। মাত্রায় যা মহাকাব্যিক। ফিশন ঈশ্বরকণা নয় যে আগে অনুমান করে, পরে পরীক্ষা সাজিয়ে তা শনাক্ত করা হবে। ফিশন যে সম্ভব, তা আগে কেউ অনুমান করতে পারেনি। এর আবিষ্কার নেহাতই আকস্মিক ঘটনা। একাধিক চমকপ্রদ আবিষ্কার, মূল্যবান পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এমনকী ভুলভ্রান্তিরও সমাহার ওই ফিশন। তার জন্য একা হানকে নোবেল প্রাইজ? সেটা আবার ওই পুরস্কারের ইতিহাসেও এক কালো অধ্যায়।

১৯০৫। পাঁচ-পাঁচটি পেপার লিখে বিজ্ঞানীদের চমকে দিলেন পেটেন্ট অফিসের কর্মী আলবার্ট আইনস্টাইন। একটি পেপারের দাবি, পদার্থ আর শক্তি একই জিনিস। একটা বদলে যেতে পারে অন্যটায়। ওই বদলের নিয়মটি আবার বিচিত্র। একরত্তি পদার্থ = বিপুল পরিমাণ শক্তি। ১৯৩২। পরমাণু বিজ্ঞানের পুনর্জন্ম হল। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস শ্যাডউইক খুঁজে পেলেন পরমাণুর নতুন কণা। নিউট্রন। পরমাণুর আর এক কণা প্রোটনের প্রায় সমান ভারী, কিন্তু প্রোটনের মতো পজিটিভ চার্জবিশিষ্ট নয়। নিউট্রন হল নিউট্রাল বা নিস্তড়িৎ, তাই কণাটির নাম দেওয়া হল ও রকম। নিউট্রনের এই দুই ধর্ম— নিস্তড়িৎ এবং ভারী— দারুণ উপকারী। নিস্তড়িৎ বলে তা গুলতির মতো ছুড়লে কোনও মৌলের পরমাণুর একেবারে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। পৌঁছে যেতে পারে সরাসরি একেবারে প়জিটিভ চার্জবিশিষ্ট প্রোটনের বাসা নিউক্লিয়াসে। নিউট্রনের যদি পজিটিভ চার্জ থাকত, তা হলে প্রোটনরা তাকে ঢুকতে দিত না নিউক্লিয়াসে। ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিত, যে ভাবে দু’টো চুম্বকের উত্তর মেরু একে অন্যকে দূরে ঠেলে দেয়। আর, নিউট্রন ভারী বলে পরমাণুর মধ্যে ঢুকে তাকে ভারী করে তোলে।

নিউট্রন আবিষ্কারের পর শুরু হল কম্পিটিশন। রোম, প্যারিস আর বার্লিনে। নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে ক্রমশ বেশি ভারী পরমাণু তৈরির কাজে নেমে পড়লেন তিন শহরের বিজ্ঞানীরা। এক এক মৌলের পরমাণু এক এক রকম ভারী। আর, ছুটে গিয়ে নিউক্লিয়াসকে আঘাত করার সময় নিউট্রন ভেঙে পাওয়া যায় প্রোটন। আঘাতপ্রাপ্ত নিউক্লিয়াসে তার ফলে মেলে বাড়তি একটা প্রোটন। নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা বাড়লে এক মৌল বদলে যায় অন্য মৌলে। সুতরাং, গুলতির মতো ছুড়ে ছুড়ে একের পর এক নতুন নতুন মৌল বানালে কেমন হয়?

তখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভারী মৌল ইউরেনিয়াম। রোম শহরে এনরিকো ফের্মি ও তাঁর সহযোগীরা অনেক নতুন মৌল বানানোর পর নামলেন ইউরেনিয়ামের চেয়েও বেশি প্রোটনওয়ালা মৌল বানাতে। ইউরেনিয়াম পরমাণুকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করলেন ওঁরা। ভাবলেন, বুঝি পেয়ে গেলেন তেমন মৌল। একের পর এক মৌল তৈরি এবং এই ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি প্রোটনওয়ালা মৌল বানানোর জন্য ১৯৩৮ সালে ফিজিক্সে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হল ফের্মিকে।

ভুল হল। কিছু নতুন মৌল বানালেন বটে ফের্মি, তবে ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি প্রোটনসমৃদ্ধ মৌল তাঁর পক্ষে বানানো সম্ভব হল না। তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া, অতএব, আধখানা ভুল। ইউরেনিয়ামকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে ফের্মি যা পেয়েছেন, তা যে বেশি প্রোটনওয়ালা মৌল না-ও হতে পারে, সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করলেন জার্মান রসায়নবিদ ইডা নোডাক। বললেন, এমন হতে পারে, নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম পরমাণু দু’টুকরো হয়েছে। সন্দেহ আমল দিলেন না ফের্মি। দিলে এক বিরাট আবিষ্কারে পৌঁছতেন তিনি।

প্যারিসে মারি কুরি-র মেয়ে আইরিন জোলিও-কুরি এবং পাভেল সাভিচ আর বার্লিনে অটো হান, ফ্রিৎজ স্ট্রাসমান এবং লিজে মিটনার নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়ামকে আঘাতে কী হয়, তা পরীক্ষা করতে নামলেন। জোলিও কুরি এবং সাভিচ দেখলেন, ওই আঘাতে যা যা মিলছে, তার মধ্যে একটা মৌলের রাসায়নিক ধর্ম ল্যানথানাম-এর কাছাকাছি। ল্যানথানাম কিন্তু ইউরেনিয়ামের প্রায় অর্ধেক ভারী। তবে কি নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম ভাঙছে? নোডাকের সন্দেহ প্যারিসের বিজ্ঞানীদের মনেও উঁকি দিল।

সন্দেহ পরীক্ষায় বার্লিনে নামলেন হান, স্ট্রাসমান এবং মিটনার। মিটনার ইহুদি, আর বার্লিনে ওঁদের পরীক্ষা চলাকালীন ১৯৩৮-এ হিটলারের নির্দেশে নেমে এল ইহুদিদের ওপর অত্যাচার। বাঁচতে সুইডেন পালিয়ে গেলেন মিটনার। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেন হান ও স্ট্রাসমান। ওঁকে জানালেন, নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম ছাড়ছে বেরিয়াম। ইউরেনিয়ামে যেখানে প্রোটন ৯২টা, সেখানে বেরিয়ামে তা ৫৬টা। এই অবিশ্বাস্য ফলাফলের ব্যাখ্যা কী? মিটনার নিজে পদার্থবিজ্ঞানী। ওঁর বোনপো, পদার্থবিজ্ঞানী অটো ফ্রিৎশ-এর সঙ্গে আলোচনা করে মিটনার দিলেন ব্যাখ্যা। বললেন, নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম দুই টুকরোয় বিভাজিত হচ্ছে। জীবদেহে কোষের এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, এ ভাবে বিভাজনকে বলে ‘ফিশন’। সে নাম ধার করে মিটনার এবং ফ্রিৎশ বললেন, নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম পরমাণুর ফিশন হচ্ছে। ফিশন প্রক্রিয়ায় সামান্য পদার্থ হারিয়ে যাচ্ছে। পদার্থ তো উবে যেতে পারে না। হারানো পদার্থ আসলে আইনস্টাইনের ফর্মুলা মেনে বনে যাচ্ছে এনার্জি। কেমন হিসেবে, তা-ও জানালেন মিটনার ও ফ্রিৎশ। বললেন, আড়াই টন কয়লা পোড়ালে যে তাপ মেলে, তা মিলবে মাত্র এক গ্রাম ইউরেনিয়ামের ফিশনে। একরত্তি পদার্থের ও ভাবে বিপুল এনার্জি উপহারই অ্যাটম বোমার মূল নীতি। দেখা যাচ্ছে, ফিশন আবিষ্কারের পিছনে ভূমিকা বহু বিজ্ঞানীর। তাঁদের মধ্যে একা হানকে নোবেল দেওয়া ঘোর অবিচার।

ফিশন উপাখ্যান শেষ করার আগে একটা প্রশ্ন। প্রশ্নটা যদি-র। ইংরেজিতে যাকে বলে কাউন্টারফ্যাকচুয়াল, বা ‘হোয়াট-ইফ’ হিস্ট্রি। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘পরিবর্ত ইতিহাস’। ঘটনা-পরম্পরায় ইতিহাস যে পথে এগিয়েছে, তার বদলে যদি ভিন্ন পথে এগোত, তবে তা কেমন হত। ইতিহাস তো ঘটনার মিছিল। আর ঘটনা পরিস্থিতির— অর্থাৎ সমাজ ও সময়ের— উপহার। সেই উপহার কি যেমন দেখা গিয়েছিল, তেমনটাই কেবল পাওয়ার কথা ছিল? না কি তা হতে পারত অন্য রকমও? সবচেয়ে বড় কথা, ইতিহাসের ভিন্ন পথে বাঁক নেওয়ার মূলে কি থাকতে পারত তুচ্ছ কোনও কারণ? যেমন বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন বলতেন, ‘‘পেরেক বিনে নাল নেই/ নাল বিনে ঘোড়া নেই/ ঘোড়া বিনে সওয়ার নেই/ সওয়ার বিনে যুদ্ধে হার/ যুদ্ধ হেরে রাজ্যের বার/ সবই এক পেরেকের কারবার।’’ কোথা থেকে কী যে হয়ে যায়, কে বলতে পারে? ফরাসি দার্শনিক ব্লেজ পাস্কাল এ জন্যই বলেছিলেন, ক্লিওপেট্রার নাক যদি খ্যাঁদা হত, তবে পালটে যেত পৃথিবীর ইতিহাস। মিশর সম্রাজ্ঞীর মোহময়ী সৌন্দর্য ও যৌন আবেদন নাকি বেড়েছিল তাঁর সুচারু নাসিকার জন্য। যা দেখে মজেছিলেন জুলিয়াস সিজার বা মার্ক অ্যান্টনি। পাস্কালের দাবি, ক্লিওপেট্রার রূপে না মজলে ওই দুই বীর নামতেন না যুদ্ধবিগ্রহে। বিশ্ব-ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি হত ভিন্ন। নাকের জন্য এত কাণ্ড!

কাউন্টারফ্যাকচুয়াল বা হোয়াট-ইফ প্রশ্নটা ওঠে ফিশন ঘিরেও। আজ পদার্থবিজ্ঞানীরা সবাই মনে করেন, ফিশন জিনিসটা ১৯৩৯-এ নয়, তার পাঁচ বছর আগে ১৯৩৪ সালে আবিষ্কৃত হতে পারত। নিউট্রন কণার আঘাতে ইউরেনিয়ামের চেয়ে ভারী মৌল তৈরির লক্ষ্যে এক্সপেরিমেন্টে ফের্মির দুই সহযোগী এমিলিও সিগার এবং এদোয়ার্দো আমালদি-ও কবুল করেছেন এই সত্য। অবজ্ঞায় উড়িয়ে দেওয়ার বদলে ফের্মি যদি ১৯৩৪-এ ইডা নোডাক-এর মন্তব্য গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতেন, তা হলে পরীক্ষার ফল সম্পর্কে তাঁর ভুল সিদ্ধান্ত দূর হত। ধরা পড়ত ভুল। ফিশন আবিষ্কার করে ফেলতেন তিনি।

তা হলে? বিজ্ঞানের যে আবিষ্কারের রাজনৈতিক অভিঘাত বিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি, তা অর্ধ-দশক আগে-পরে ঘটলে ইতিহাস-বদল অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত সেই উদ্ভাবন যদি হয় ১৯৩০-এর দশকের ঘটনা। কে না জানে, বিশ্ব তখন যুগসন্ধিক্ষণে। ইউরোপে এক কংসরাজের আস্ফালন। অ্যাডলফ হিটলার।

কী হতে পারত, তা বিচারে কী হয়েছিল, দেখা দরকার। ফিজিক্সের বিখ্যাত জার্নাল ‘ফিজিকাল রিভিউ’-এর ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সংখ্যাটি স্মরণীয়। ওতে ছাপা দু’টি পেপার, এবং তাদের মধ্যে এক কাকতালীয় যোগাযোগের কারণে। একটি পেপারের উপজীব্য, মহাশূন্যে ব্ল্যাক হোল তৈরি হওয়া সম্ভব। লেখক হার্টল্যান্ড স্নাইডার এবং রবার্ট ওপেনহাইমার। দ্বিতীয় পেপারের উদ্দেশ্য পরমাণুর ফিশন কী ভাবে হয়, তা ব্যাখ্যা করা। পণ্ডিতেরা যা পড়ে বুঝলেন, অ্যাটম বোমা বানানো যায়। এই পেপারেরও লেখক দুই। নিলস বোর এবং জন আর্চিবাল্ড হুইলার। পরে কিন্তু ওই বিজ্ঞানীদের কাজ উলটেপালটে যায়। ওপেনহাইমার বানান বোমা। আর হুইলার বনে যান ব্ল্যাক হোল বিষয়ে প্রথম সারির গবেষক। এমনকী ব্ল্যাক হোল নামটাও তাঁরই দেওয়া।

ওই ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ তারিখেই হিটলারের বাহিনী ঢোকে পোল্যান্ডে। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তার আট মাস আগে জানুয়ারি মাসে ফিশন ঘোষণা করে ‘নাচুরওয়াজেনস্থাফটেন’ জার্নালে হান এবং স্ট্রাসমান-এর পেপার। তার অনেক আগে থেকেই নাত্‌সি অত্যাচারে অতিষ্ঠ ইহুদি বিজ্ঞানীদের দলে দলে জার্মানি এবং ইতালি ত্যাগ। পালিয়ে আমেরিকা। হিটলারের তাড়া-খাওয়া বিজ্ঞানীদের আশংকা, জার্মানি বোমা বানাবেই। বাঁচতে হলে আমেরিকারও তা বানানো দরকার। প্রথমে কেবল দর্শক থাকলেও, যুদ্ধে আমেরিকার যোগদান ১৯৪১-এর ডিসেম্বরে। আর তার দেড় মাসের মধ্যে অ্যাটম বোমা তৈরিতে হাত।

যদি ১৯৩৯-এর বদলে ১৯৩৪-এই আবিষ্কৃত হত ফিশন? ঘটনা হয়তো অন্য দিকে গড়াত। অ্যাটম বোমা তৈরি হত অনেক আগে। মালিক হত শুধু আমেরিকা নয়, আরও দেশ— ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন। অন্য দিকে জার্মানি, ইতালি, জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি তা হলে হত অ্যাটম বোমার লড়াই? মনে হয় না। বরং সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াত একে অন্যের পরমাণু বোমা তৈরির কারখানা বিমানহানায় ধ্বংস করা। সে যুদ্ধ হত আরও বেশি ভয়াল! না কি ঘটনা গড়াত অন্য দিকে? হোয়াট-ইফ বিবেচনায় মনে হয় অন্য কথাও। হয়তো যুদ্ধ বাধতই না। শত্রুর হাতে অ্যাটম বোমা আছে, এই ভয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করত না। তা হলেও যে বিপদ! জার্মানিতে তা হলে এখনও দোর্দণ্ড প্রতাপে বিরাজ করত নাত্‌সিরা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Otto Hahn Atomic bomb Hiroshima
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE