Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সাহারায় সীতাহরণ

কখনও সামনে টলটলে স্বচ্ছ জলের মরীচিকা। কখনও বা প্রবল মরুঝড়, ল্যান্ডমাইন আর জঙ্গি আল-কায়দার ভয়। এই ভাবেই প্রতিদিন ১০০ কিলোমিটার দৌড়ে দু’ চাকার সীতাহরণ পেরিয়ে এল সাহারা মরুভূমি। অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়কখনও সামনে টলটলে স্বচ্ছ জলের মরীচিকা। কখনও বা প্রবল মরুঝড়, ল্যান্ডমাইন আর জঙ্গি আল-কায়দার ভয়। এই ভাবেই প্রতিদিন ১০০ কিলোমিটার দৌড়ে দু’ চাকার সীতাহরণ পেরিয়ে এল সাহারা মরুভূমি। অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

মরুবিজয়: সাহারা মরুভূমিতে ক্ষণিকের বিশ্রামে সীতাহরণ

মরুবিজয়: সাহারা মরুভূমিতে ক্ষণিকের বিশ্রামে সীতাহরণ

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

দিগন্তের কালো বিন্দুগুলোকে প্রথমে গুরুত্ব দিইনি। গত কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতায় জানতাম, ওরা সত্যি নয়। বেলা বাড়লে আপন খেয়ালে ওরা দেখা দেয়, কখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কখনও জোট বাঁধে। আবার কখনও ছড়িয়ে যায়। প্রথম দিন দেখে ভেবেছিলাম উটের সারি বোধহয়। তার পর কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ ভ্যানিশ। সে দিন থেকেই জানি, ওরা মরীচিকা। আর যে দিন বালির ঝড় হয় না, তেষ্টায় বুক ফেটে যায় না, সে দিন ওদের ভ্যানিশিং অ্যাক্ট দেখাই আমার একমাত্র কাজ।

কোনও দিন আবার টিনটিনের গল্পের মতো জলাশয় দেখি। টলটলে জল, তাতে মেঘের ছায়া। দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি, সঙ্গে সঙ্গে তারা অদৃশ্য। জল নিয়ে মরীচিকার একটা মায়াবী খেলার ব্যাপার আছে, জানাই ছিল। তাই অবাক বা হতাশ, কোনওটাই হই না। বরং আপন মনে হাসি। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ একা সাইকেল চালিয়ে যায়, তার আর কাজই বা কী, মরীচিকা-বিশারদ হওয়া ছাড়া?

সে দিনের কালো বিন্দুগুলো অনেক ক্ষণ পরেও যখন অদৃশ্য হল না, তখন বুঝলাম, একটা গ্রাম আসছে। গ্রাম বলতে আমরা যা বুঝি, তেমনটা নয় অবশ্য। কয়েকটা ক্যানভাসের তাঁবু, কয়েকটা ভাঙা, অর্ধেক বালি চাপা-পড়া গাড়ি, তিন-চার জন সৈনিক আর ক’টা উট। সাহারা মরুভূমিতে আমার মতো সাইকেল-পথিকের কাছে এটুকুই বিরাট ভরসা। মানুষ আছে মানেই জল আছে, আছে খাবার, রাতের আশ্রয়। প্রতি দিন গড়ে ১০০ কিলোমিটার সাইকেল চালাই আমি এই আস্তানার ভরসাতেই। এক আস্তানায় পৌঁছে খবর নিই, পরেরটা কত কিলোমিটার দূরে। পুলিশ বা সৈনিক থাকলে বেশি ভরসা পাই, ওরাই একটু ইংরেজি বলে বা বোঝে কিনা! সাহায্য করে। জল চাইলে দেয়। ‘ফাতিগে, ফাতিগে’, অর্থাৎ ‘ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি’ বললে, শোবার জায়গা দেখিয়ে দেয়। গোটা মরক্কো আর ওয়েস্টার্ন সাহারায় তাই হয়েছে। কেবল গত এক হপ্তায় হিসেব বিগড়ে গিয়েছে।

লাইউন অঞ্চলের অভিনব ঘরবাড়ি

সে দিন সকালেও যখন সাইকেলটাকে বালি ঠেলে রাস্তায় তুলে এনেছিলাম, জানা ছিল, ১১০ কিলোমিটার গেলে তবেই পাব রাত কাটানোর আস্তানা। গোটা পথে কিচ্ছুটি নেই। এত দিনের একাকীত্ব আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল নিজের মধ্যে মশগুল থাকার মন্ত্র। দূরত্ব সয়ে গিয়েছিল, ঝোড়ো হাওয়া আর বালির আঁচড়ও। সয়ে গিয়েছিল পেশির মধ্যে জমে ওঠা যন্ত্রণা আর শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া উটের মাংস। জানতাম, আর মাত্র কয়েক দিন এই গতিতে সাইকেল চালাতে পারলেই মরুভূমি শেষ। তবু সাহারা যেন শেষ হয়েও হতে চাইছিল না।

অথচ সাইকেলের সিটে বসলেই মনে হচ্ছিল, এই তো সেদিন ক্যাসাব্লাঙ্কায় নামলাম। মরিটানিয়ার ভিসা করতে গিয়ে আটকে রইলাম মরক্কোর রাজধানী রাবাত-এ। পাক্কা চার দিন। সারা দিন কখনও বন্দরে, কখনও পুরনো মেদিনায় (বাজার) টো-টো। ফুটপাতে বিচিত্র খাবার চেখে দেখা আর অবাক চোখে নতুন দেশ গিলে নেওয়া। সকাল থেকে রাত কোথা দিয়ে উধাও। তার পর বাসে চেপে এক দিন গুলমিম, সাহারা মরুভূমির দোরগোড়ায়। তার পর থেকেই ব্যাপারটা কেমন বদলে গেল।

গুলমিম পৌঁছেই প্রথম কাজ ছিল বাক্স খুলে ‘সীতাহরণ’-কে অ্যাসেম্বল করা। সীতাহরণ আমার সাইকেলের নাম। একা অনেকটা পথ দিনের পর দিন চলতে হবে জেনে, আগে থেকেই তার একটা গালভরা নামকরণ করে রেখেছিলাম। সত্যজিৎ-পড়া বাংলার ছেলে সাহারা যাবে অ্যাডভেঞ্চারের টানে, আর মন্দার বোস-জটায়ুর বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়বে না, হয়? ‘সাহারায় সীতাহরণ’-এর মত অ্যাবসার্ড, নন-সেন্সিকাল ব্যাপারটাই আমার অ্যাডভেঞ্চারের থিম হিসেবে ভাবতে ইচ্ছে করেছিল। যাই হোক, সীতাহরণকে রেডি করে বাজারে ছুটেছিলাম টুকিটাকি খাবার, আর সব থেকে দরকারি যেটা, সেই তুয়ারেগ যাযাবরদের মতো পাগড়ির জোগাড়ে। উড়ে আসা বালি আর গরম হাওয়া, দুটো থেকেই আমাকে বাঁচাবে সে।

মরিটানিয়া-সেনেগাল সীমান্তের গ্রামে পোষা উট

সাতসকালে ঢুকে পড়েছিলাম সাহারার অন্দরমহলে। প্রথম দিনেই ১৩০ কিলোমিটার। অ্যাটলাস পর্বতমালার সীমান্তে বিস্তৃত পাথুরে ঢেউ-খেলানো জমি ক্রমশ আটলান্টিক উপকূলের দিকে পাথুরে মরুভূমির চেহারা নিয়েছিল। দমকা হাওয়া আর সাহারার রেগিস্তান আমাকে বলেছিল, স্বাগতম। চোয়াল শক্ত হয়েছিল আমার, চোখ চকচক করে উঠেছিল রোমাঞ্চে। সীতাহরণের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলাম। ও অবশ্য কিছু বলেনি।

সাহারা মরুভূমি পার হবার জন্য চির কালই হাতে গোনা কয়েকটি রাস্তা ছিল। এই রাস্তাগুলো ছিল ভূমধ্যসাগর-সংলগ্ন আফ্রিকার সঙ্গে সাহারার দক্ষিণের কালো মানুষের আফ্রিকার যোগসূত্র। উটের ক্যারাভান নিয়ে, একের পর এক মরূদ্যান ছুঁয়ে ছিল এই সব পথ। জল কোথায় আছে, ডাকাতের উৎপাত কোন রাস্তায় কম— এই সব কিছু হিসেব করে পথের রেখা বদলে যেত সময়ে সময়ে। ইদানীং কালে, আফ্রিকা মহাদেশ থেকে ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো সরে যাওয়ার ঠিক পরের দুই দশক (১৯৭০-’৮০) জুড়ে ছিল ট্রান্স-সাহারা ঘোরাঘুরির স্বর্ণযুগ। এই সময় মরক্কো কিংবা আলজেরিয়া থেকে পথ চলা শুরু করে মালি-র টিম্বাকটু কিংবা নাইজার-এর অ্যাগাদেজ চলে আসা যেত সাহারার মধ্যাঞ্চল দিয়ে। কিছু দিন আগে পর্যন্তও নীলনদের পাড় ধরে কায়রো থেকে নুবিয়ার মরুভূমি পেরিয়ে, সুদান হয়ে উগান্ডা আসা যেত নির্বিবাদে। ১৯২০-র দশকে বিমল মুখোপাধ্যায় কায়রো থেকে সাইকেলে এই পথে আবু সিম্বেল-ওয়াদি হাইফা হয়ে খার্তুমের পথে বেশ কিছুটা এগিয়েছিলেন। তবে সুদানের এক গ্রামে, রাস্তা জুড়ে এক সিংহের পরিবার লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট করায় তাঁকে ফের মিশরে ফিরতে হয়েছিল। আরও অনেক পরে রামচন্দ্র বিশ্বাস লিবিয়ার আল জাওইয়া থেকে কোফরা হয়ে সুদানের ডোঙ্গোলা আসেন ট্রাকে চেপে। কিন্তু, বর্তমানে লিবিয়া-মিশর-সুদান-নাইজার-শা’দ-মালি— সব দেশেই চরম অরাজকতা। অভ্যুত্থান, গেরিলা যুদ্ধ, উগ্রপন্থা, কিডন্যাপিং, গণহত্যা। তাই শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও, সাহারা পার হওয়ার শিহরন একটুও কমেনি।

এই মুহূর্তে সাহারা পার হওয়ার একমাত্র আপাত-নিরাপদ পথ মরক্কো থেকে ওয়েস্টার্ন সাহারা-মরিটানিয়া হয়ে সেনেগাল। তাই মরক্কোর গুলমিম থেকে সেনেগালের ডাকার— এই ছিল আমার সাইকেল-রুট। গুলমিম থেকে প্রথম বেশ কিছুটা পথ ছিল আটলান্টিক উপকূল ছুঁয়ে, সাহারার বালি যেখানে সমুদ্রে এসে মিশেছে। সারা দিন বালির বুক চিরে সাইকেল চালানোর পর রাত কাটাতাম সমুদ্রতীরে জেলেদের গ্রামে। একে একে এল আউটিয়া, আখফেনির, তারফায়া। যেমন সুন্দর নাম, তেমনই গা-জুড়োনো তাদের সন্ধের হাওয়া।

আখফেনির থেকে তারফায়া যাবার দিন এক কাণ্ড। সকাল থেকেই হাওয়া আমার গতির বিপরীতে। বেলা একটু বাড়তেই তা পরিণত হল ভয়ংকর ঝড়ে। ভেবেছিলাম ব্যাপারটা সাময়িক। পরে বুঝলাম, সাইকেল চালানো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে থাকাই দুষ্কর। মাটির সমান্তরালে উড়ে চলা বালির জেট স্ট্রিম, না দেখলে বিশ্বাস হত না। অনেক ক্ষণ পাগড়িতে নাকমুখ ঢেকে শুয়ে থাকলাম বালির ওপর। তার পর সাইকেল ঠেলে হেঁটে এগোতে লাগলাম। পুরো পাঁচ ঘণ্টা পর হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো উদয় হল একটা দোকান। পড়ন্ত বিকেলে হাওয়া একটু কমলে ফের সাইকেলে, পৌঁছলাম তারফায়া। মরুঝড় আমার মনোবল শক্ত করে দিয়ে গেল। এর পর আর সে ভাবে মরুঝড়ের মুখে পড়তে হয়নি ঠিকই, কিন্তু হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ প্রায় শেষ দিন অবধি করতে হয়েছে। সাহারার ‘হারমাটান’ যেন আক্ষরিক অর্থেই ‘হাড় ধরে মারো টান’।

তারফায়া থেকে এক ভয়ংকর বৈচিত্রহীন রেগিস্তান পার করে পৌঁছলাম ওয়েস্টার্ন সাহারার রাজধানী লাইউন, ওরফে, আল-আইউন’এ। পথে বৈচিত্র বলতে ক’টা উইন্ডমিল। আদিগন্ত মরুর মধ্যে উইন্ডমিলের সারি দেখেই মনে হয়েছিল ডন কিহোতে-র কথা। তাঁর বাহন রোচিনান্তে, আমার সীতাহরণ। এটা বুঝেছিলাম, সাইকেলে সাহারার একঘেয়েমি কাটানোর শ্রেষ্ঠ পন্থা— দিবাস্বপ্নে মশগুল থাকা। অবশ্য সেটা তখনই সম্ভব, যখন হাওয়া অনুকূলে বইছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগেই পৌঁছে গেছিলাম শহরের দোরগোড়ায়। ধু-ধু মরুভূমির মধ্যে মাথা তুলেছে এক অলীক শহর। কোথা থেকে ম্যাজিকের মতো হাজির মিনিবাস, ট্যাক্সি, গুচ্ছের মোটরবাইক। বড় বড় বাড়ি, দোকান-বাজার, হোটেল, পার্ক, ক্যাফে, অফিস, কী নেই! একশো কিলোমিটার শূন্যতার পর আধুনিক এক শহরে পৌঁছে মনে হচ্ছিল, এ যেন এক ইন্দ্রজাল। অদৃশ্য হয়ে যাবে এক্ষুনি।

লেখকের যাত্রার ম্যাপ

শহরে ঢোকার ঠিক মুখেই পুলিশ আটকাল। অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল ওদের নজরদারি। কোথা থেকে আসছি, আজ কোথায় যাব, এ-ই তাদের জিজ্ঞাসা। ভালই লাগত পুলিশ ক্যাম্পগুলোতে থামতে। বিশ্রাম মিলত, বোতলে জল ভরে নিতে পারতাম। ভাগ্য ভাল থাকলে কোনও অফিসার এক কাপ চা-ও বাড়িয়ে দিতেন। আমার ভারতীয় পাসপোর্ট দেখে তাদের প্রতিক্রিয়া হত দেখার মতো। ‘ইন্ডিয়া! হিন্দ?’ এই দুটো শব্দের পরই অবধারিত উঠে আসত শাহরুখ খানের নাম। গোটা মরক্কো, ওয়েস্টার্ন সাহারা, এমনকী মরিটানিয়ারও দু-একটা পুলিশ পোস্টে এই শাহরুখীয় আলাপচারিতায় ব্যতিক্রম হয়নি। বুঝেছি, সাহারা মরুভূমির পশ্চিম প্রান্তের দেশগুলিতে ভারতবর্ষের এক এবং একমাত্র প্রতিনিধি এসআরকে। সে দিন অবশ্য নাটক আরও এগোল। পাসপোর্টে আমার পদবি দেখে দু-এক জন উত্তেজিত হয়ে বলেই ফেললেন, ‘মুখার্জি? লাইক, রানি?’ আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতেই যে সুমধুর দৃষ্টি আমার ওপর পড়ল তা বলা বাহুল্য পুলিশোচিত নয়। আমিও হাবভাব যথাসাধ্য বলিউডসুলভ করার চেষ্টা করে পালাবার পথ খুঁজতে লাগলাম। পুলিশ ভদ্রলোকের সঙ্গে সেলফি না তুলে অবশ্য নিস্তার পাওয়া গেল না।

ভিসার ভুলে এক জায়গায় এক দিনের বেশি বিশ্রাম আমার কপালে ছিল না। হাওয়া অনুকূল দেখে স্থির করলাম, লাইউন থেকে এক দিনে ১৯০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে বুজদুর চলে যাব। গড়ে ঘণ্টায় ১৭ থেকে ১৮ কিমি বেগে আমার সাইকেল চলছিল এত দিন। সকাল সাতটায় পথে নেমে, দিনের শেষে পৌঁছে গেলাম বুজদুর। তার পর এক দিন মরক্কো আর ওয়েস্টার্ন সাহারার বিস্তীর্ণ অঞ্চল শেষ হল। শেষ হল আমাকে দিন-রাত ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলা মরক্কো পুলিশের ডিউটি। ওদের আশঙ্কা, আলজেরিয়ার আশ্রিত পোলিসারিও গেরিলাদের খপ্পরে না পড়ে যাই আমি। আসলে বোঝার চেষ্টা, আমার সঙ্গে পোলিসারিও ফ্রন্ট বা সাহরাউয়ি আন্দোলনের কোনও যোগ নেই তো? সেই ’৭০ এর দশকে স্প্যানিশরা পশ্চিম সাহারা ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে এলাকার বেআইনি দখল নিয়ে রেখেছে মরক্কো। তাই বহিরাগত দেখলেই তাদের অতিরিক্ত কৌতূহল ও সাবধানতা।

তার পর এল গেরগেরাট-এর ল্যান্ডমাইন বিছানো নো-ম্যান্স ল্যান্ড। মরক্কো সীমান্তে পুলিশ আগেভাগেই সাবধান করে বলেছিল, গাড়ির চাকার দাগের বাইরে গেলেই বিস্ফোরণের সম্ভাবনা। এখানে পথ ভুল করে ল্যান্ড মাইন ফেটে মারা গেলে দায় নেই কোনও দেশের। নো-ম্যান্স ল্যান্ড যে! তাই বালির ওপর চাকার দাগ হল আমার লাইফ লাইন। সাইকেল ঠেলে পাঁচ কিলোমিটার পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম মরিটানিয়া। সীমান্ত থেকেই ওয়ার্নিং ছিল আল কায়দার। বছর কয়েক আগেও এই রাস্তা থেকেই ইউরোপীয় টুরিস্ট অপহরণ করেছে তারা। গাড়ির ক্যারাভান ছাড়া একা ঘুরে বেড়ানোর বিপক্ষে নির্দেশ জারি অনেক দেশের সরকারি ওয়েবসাইটে। কিন্তু আমি ক্যারাভান পাব কোথায়? সীতাহরণ, আমি আর আমাদের ছায়া— এই ক্যারাভান নিয়েই এগিয়ে চলি।

মরিটানিয়া দেশটার নব্বই ভাগই মরুভূমি। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ (শ্বেত মুর) রাজ করে কালো মুরদের ওপর। কাগজে-কলমে না হলেও, বংশানুক্রমে ক্রীতদাস প্রথা আজও সচল এখানে। আমার গায়ের রঙ হোয়াইট মুরদের থেকে কালো হওয়ায় দিনের পর দিন আমার সঙ্গে কথাই বলতে চায়নি কেউ। খাবার খেতে দিয়েছে ছুড়ে, অস্পৃশ্যের মতো। সামনে দাঁড়িয়ে পথ জানতে চাইলে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। গ্রাম এলে বাচ্চারা ছুড়েছে পাথর। চিৎকার করেছে, ‘নাসরানি, নাসরানি’ বলে। শিশুর চোখে ঘৃণা দেখে শিউরে উঠেছি। প্রথমে খুব রাগ হলেও পরে খুব দুঃখ হয়েছে। জাতপাত, বর্ণবিদ্বেষ— এ সব যে আমার দেশেও আছে!

মরিটানিয়ার রাজধানী নুয়াকশোট থেকে দক্ষিণে চলা শুরু হতেই বাড়তে থাকে জনবসতি। এত দিন গড়ে ১০০ কিলোমিটার অন্তর দেখা পাচ্ছিলাম, এ বার প্রতি ২০-২৫ কিলোমিটার অন্তর দেখা দিতে লাগল ছোট ছোট গ্রাম। তাই সে দিন সকালে যখন সাইকেলটাকে বালি ঠেলে রাস্তায় তুলে এনেছিলাম, তখনই জানতাম, দিগন্তের সব বিন্দুগুলি সব সময় অদৃশ্য হয়ে যাবে না। ওগুলো তো আসলে মানুষের বাসস্থান। আর মানুষ দেখেই আমার ক্লান্ত শরীর চাইবে থামতে। মন চাইবে কথা বলতে। কিন্তু ফের পাথর উড়ে আসবে আমার দিকে। আমাকে মাথা বাঁচিয়ে, আরও দ্রুত সাইকেল চালাতে হবে। কারণ উড়ে আসা পাথরগুলো মরীচিকা নয়। কঠিন বাস্তব। আসবে বালি, দমকা হাওয়া, কাঁটাঝোপ। তবু এগোতে হবে। আর ক’দিন পরই আসবে সেনেগাল নদী। শেষ হবে সাহারা, শুরু হবে সবুজ সেনেগাল। দিগন্তের বিন্দুগুলি আরও বড় হতে থাকে। মনকে বলি, আর দুশো কিলোমিটারের কিছু বেশি পথ পার হতে পারলেই শেষ হয়ে যাবে সাহারা।

টিগেন্ট নামের ছোট্ট একটা গ্রামে আশ্রয় পাই। কাঁকড়াবিছের বিষাক্ত হুল থেকে বেঁচে যাই একটুর জন্য। সাহারা পেরোবার শেষ সন্ধ্যা সে দিন। পর দিন ১২০ কিলোমিটার পথ যেন আর শেষ হতে চায় না। কেউর মাসিন গ্রামের পর জলাভূমি। শুরু হয় দিয়াওলিং ন্যাশনাল পার্ক। দিনশেষে জাতীয় উদ্যানের রেস্ট হাউসে পৌঁছে অবাক লাগে খুব। সাহারা মরুভূমি পিছনে ফেলে এসেছি! কাল মাত্র ১০ কিলোমিটার গেলেই পৌঁছে যাব সেনেগাল নদীর পাড়ে, যার ওপারেই বর্ডার পোস্ট। ২২ মার্চ বাবলা গাছ, উটের সারি, সবাইকে বিদায় দিয়ে, সেতু পেরিয়ে সেনেগাল ঢুকে পড়ি। একের পর এক গ্রাম পেরিয়ে এগোতে থাকি সেন্ট লুই বন্দরের দিকে। কখনও বাওবাব গাছ, কখনও এক দল শিশু আমায় ঘিরে ধরে। মশগুল হয়ে যাই বন্ধু পাওয়ার আনন্দে। সাহারার বুক ছুঁয়ে সভ্যতাকে চিনে নিই আমি। বেঁচে থাকা সার্থক মনে হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE