Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দুর্গার বাহন সিংহ ছিল না

শত শত বছর ধরে পালটেছে দুর্গার রূপ। বেড়েছে দেবীর হাত ও অস্ত্রের সংখ্যা।শত শত বছর ধরে পালটেছে দুর্গার রূপ। বেড়েছে দেবীর হাত ও অস্ত্রের সংখ্যা।

মহিষমর্দিনী: ১৮ শতকের ছবি। চেস্টার বিটি লাইব্রেরি, ডাবলিন

মহিষমর্দিনী: ১৮ শতকের ছবি। চেস্টার বিটি লাইব্রেরি, ডাবলিন

অশোককুমার দাস
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৭:৪০
Share: Save:

তাঁর হাতে নানা আয়ুধ— বাঁ দিকে ত্রিশূল, খড়্গ, চক্র, তির ও শক্তি; ডান দিকে ঢাল, ধনু, পাশ, অঙ্কুশ ও ঘণ্টা (বা পরশু)। রণরঙ্গিণী সিংহবাহিনী দেবী মহিষ নামের অসুররাজকে নিধনে রত।

দুর্গার এই রূপকল্পনা এক দিনে হয়নি, শত শত বছর ধরে তাঁর মূর্তির নির্মাণ ও বিবর্তন হয়েছে। গোড়ার দিকে তিনি দ্বিভুজা হলেও পরাক্রম দেখাবার জন্য তাঁকে চতুর্ভুজা, ষড়ভুজা, অষ্টভুজা, দশভুজা, দ্বাদশভুজা, ষোড়শভুজা বা অষ্টাদশভুজা রূপে দেখানো হয়েছে। ক্রমবর্ধমান শত্রুসংখ্যা ও অসুরশক্তির সঙ্গে মোকাবিলার জন্য তাঁর হাতের সংখ্যা আয়ুধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে। একদম প্রাচীন কালে তাঁর না ছিল বাহন সিংহ, না কোনও অনুচর, তিনি একাই বিশাল মহিষকে লেজ ধরে ঘুরিয়ে ছুড়ে ফেলেছেন।

ক্রমশ পরিবারদেবতা হিসেবে তাঁর সঙ্গে সরস্বতী, লক্ষ্মী, গণেশ ও কার্তিক সন্নিহিত হলেন। রূপান্তরিত হলেন পরিবারের সদস্য পুত্রকন্যা হিসেবে। মহাদেবও স্থান পেলেন, তবে পিছনের চালচিত্রে দুর্গার মাথার উপর। অর্থাৎ হিন্দুধর্মের প্রায় সব মুখ্য দেবদেবী একত্রিত হয়ে চলে এলেন পূর্ব ভারতে শরৎকালের দেবীপক্ষে। দশভুজা মহামায়ার রণরঙ্গিণী রূপ যেন অনেকটা নিষ্প্রভ হল— কারণ এখানে তিনি আসছেন অসুরপীড়নে বিজয়িনী হয়ে, ভক্তদের হর্ষ-উল্লাসের জন্য। তাঁর বাহন সিংহের রূপেও পরাক্রমের চিহ্ন নেই, বরং অনেকটাই পোষ-মানা, ঘরোয়া ভাব। দেবীর বাহন সিংহকে নিয়ে বেশ কিছুটা ধোঁয়াশাও রয়েছে।

ভারতবর্ষে এখন সিংহ গুজরাতের গির অভয়ারণ্যের বাইরে দেখা না গেলেও, উনিশ শতকেও রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, এমনকী ঝাড়খণ্ডের পলামৌ অঞ্চলে সিংহ পাওয়া যেত। কিন্তু প্রাচীন কালে সিন্ধু সভ্যতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে (যার মধ্যে আছে গুজরাতের ধোলাবিরা, লোথাল ও রাজস্থানের বেশ ক’টি জনপদ) কোথাও সিংহের উপস্থিতির প্রমাণ নেই। অসংখ্য সিলমোহরে নানা জীবজন্তুর প্রতিকৃতি দেখা গেলেও সিংহ অনুপস্থিত। দিব্যভানু সিংহ তাঁর ‘দি স্টোরি অব এশিয়া’জ লায়ন্‌স’-এ লিখেছেন, পশ্চিম এশিয়া থেকে ইরান হয়ে পূর্ব-মধ্য ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত তৃণারণ্যে যে সিংহ ছিল, আফ্রিকার তিনটি প্রজাতির সঙ্গে তার অনেক অমিল। আবহাওয়ার পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে পশ্চিম এশিয়া, ইরাক, ইরান ও সিন্ধু নদীর পশ্চিম অঞ্চল থেকে ক্রমশ তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ‘ইগজোটিক এলিয়েন্স: দি লায়ন অ্যান্ড দি চিতা ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে রোমিলা থাপার প্রায় একই উপাদানের বিচার করে সিংহ আদপেই এ দেশের নয়, সুদূর অতীতে পশ্চিম এশিয়া, ইরান থেকে সিংহকে এ দেশে আনা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন। আবার ঋগ্বেদে সিংহের, সিংহনাদের উল্লেখ আছে, বাঘের উল্লেখ নেই। অথর্ববেদে বাঘ, সিংহ দুই-ই আছে। তবে কি ঋগ্বেদের রচনাস্থল এমন কোথাও যেখানে সিংহ আছে কিন্তু বাঘ নেই?

মৌর্য শিল্পকলায় সিংহের উপস্থিতি নজরকাড়া। সম্রাট অশোকের স্থাপিত স্তম্ভশীর্ষে সিংহ দেখা যায়, রাজশক্তির প্রতীক সে। ব্যাকট্রিয়ান, ইন্দো-গ্রিক, পশ্চিম ক্ষত্রপ ও গুপ্ত যুগের ও পরবর্তী কালের মুদ্রায়, ভারহুত, সাঁচি, পশ্চিম ভারতের গুহায়, স্তম্ভশীর্ষে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। সুলতানি আমলে ও মুঘল দরবারের ছবিতে সিংহের ছড়াছড়ি, যদিও সম্রাট ছাড়া অন্য কারও সিংহ শিকারে অনুমতিও ছিল না।

দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহ তাই শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। তাঁর বাহন সিংহ এসেছিল পিতা হিমালয়ের কাছ থেকে, অথচ হিমাচল প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, উত্তর ভারতের কোনও কোনও জায়গায় দেবীর বাহন সিংহ নয়, বাঘ। আমাদের এখানে মহামায়া সিংহারূঢ়া হয়েই আসেন, কখনও সে থাকে শান্ত হয়ে। এখানে তো যুদ্ধ নয়, আনন্দের, শান্তির, উৎসবের বাতাবরণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE