Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মৎস্যভুক বাঙালি মাংসাশী হয়ে উঠল কবে থেকে?

আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ছিল রবিবার দুপুরে প্রেশার কুকারের সিটিতে, সুসিদ্ধ মাংসের সুবাসে। সেই মঙ্গলকাব্যের যুগ থেকে সজারু, গোসাপ, হরিণ, শুয়োর, খরগোস, হাঁস, মুরগি, কচ্ছপ, কী না উদরস্থ করেছে এই জাতি? জয়ন্ত সেনগুপ্তআমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ছিল রবিবার দুপুরে প্রেশার কুকারের সিটিতে, সুসিদ্ধ মাংসের সুবাসে। সেই মঙ্গলকাব্যের যুগ থেকে সজারু, গোসাপ, হরিণ, শুয়োর, খরগোস, হাঁস, মুরগি, কচ্ছপ, কী না উদরস্থ করেছে এই জাতি? জয়ন্ত সেনগুপ্ত

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

‘দেশ’ পত্রিকায় অনেক দিন আগে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি কবিতা পড়েছিলাম, প্রথম দু’লাইন শুধু মনে আছে: ‘ওরা আমাকে আর মাংস খেতে দেয় না/ তাহলে আর বেঁচে থাকার কী মানে’... পড়লেই মনশ্চক্ষে ভেসে উঠত এক বর্ষীয়ান কবির অপ্রসন্ন মুখ, তাঁর কণ্ঠে এক মন্দ্রবিষাদ, কেন মাংস হারিয়ে গেল জীবন থেকে? এখন বয়েস হয়েছে, রেওয়াজি খাসির মাংস এখন এক ধূসর মহাপৃথিবীর বার্তা বয়ে আনে, তাই আরও বেশি করে বুঝি মাংসহীন জীবনের সেই অর্থহীনতা।

কিন্তু কী করে তৈরি হল মৎস্যভুক বাঙালির সঙ্গে মাংসের এই ওতপ্রোতকরণ? কবে থেকে? মুঘল যুগ? কিন্তু আকবরের বঙ্গবিজয় যদি ১৫৭৫ সালে, তবে কাছাকাছি সময়ের লেখা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ তো মাংসের ছড়াছড়ি। নিদয়ার শখ, সাধভক্ষণে তিনি খাবেন নকুল গোধিকা আর সজারুর পোড়া। দুঃখিনী ফুল্লরার বারমাস্যার ছন্দে ধ্বনিত এক হাহাকার, ‘কেহ না আদরে মাংস, কেহ না আদরে’, কারণ ‘দেবীর প্রসাদ মাংস সবাকার ঘরে’, ব্যাধিনী-বাহিত হরিণীর মাংস— যা কিনা যজ্ঞনিবেদিত নয় বলে ‘বৃথামাংস’— কে আর কিনবে? আর খরশন বৈশাখে তো ‘মাংস নাহি খায় সর্ব্ব লোক নিরামিষ।’ কিন্তু, ওই অফ-সিজনটুকু বাদ দিলেই ব্যস, লোকজন আবার মাংসময় আবিল। ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরীর লেখায় পড়ি, আকবর আর জাহাঙ্গিরের আমলে বাংলায় খাসি, বাছুর, বনমোরগ, বুনো শুয়োর, খরগোশ, হরেক রকম পাখি দিব্যি চলত, ছুঁতমার্গ ছিল শুধু মোরগ, হাঁস-মুরগির ডিম, পোষা শুয়োর, আর গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে। অতএব, ব্যাধের শিকারী মনোবৃত্তি আমাদের, বাঙালিদের মজ্জাগত। শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ভক্তিবাদ হয়তো বাঙালি সমাজের কিছু অংশকে নিরামিষাহারে দীক্ষিত করেছিল (শুক্তো, নিমঝোল বা লাবড়ার মতো ভক্তিযোগের রেসিপিকে বাঙালি সভ্যতায় অতুলনীয় অবদান বলেই ধরতে হবে), কিন্তু সে নেহাতই নগণ্য। আমিষ-বর্জনের সেই আকস্মিক মন্বন্তরে আমরা বাঙালিরা মরিনি, মাংস নিয়ে ঘর করে চলেছি এত কাল। এই বন্ধন অবিচ্ছেদ্য।

এর পর সময় যত এগিয়েছে, বাঙালির মজ্জায় মাংস মজেছে আরও বেশি, মুসলিম শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে হিন্দু বাঙালি যজ্ঞিবাড়ির আদা-জিরের মাংসের— বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় ‘দুর্গাপূজার অজ মাংস (যা) শুধু একটি দুটি নম্রভাষী তেজপাতা দিয়ে সুবাসিত)— জায়গা উত্তরোত্তর নিয়েছে পেঁয়াজ-রসুনের গরগরে ঝোল। আঠেরো শতকে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ ‘কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝোল ঝাল রসা’-য় বাঙালির ক্ষুন্নিবৃত্তি হচ্ছে। আর উনিশ শতকে সমাজসংস্কার আন্দোলনের সমর্থক এবং বিরোধীদের এক করে দিয়েছিল এক মাংসল মেলবন্ধন। রাজা রামমোহন রায় ব্রহ্মসংগীত লিখতে লিখতে একটা গোটা পাঁঠা খেতে পারতেন জানি, কিন্তু অনেকেই খেয়াল রাখি না, বিলেত যাওয়ার আগেই ১৮৩০ সালে তিনি এক পুস্তিকা লেখেন, যার নাম ‘হিন্দু অথরিটিজ ইন ফেভার অব স্লেয়িং দ্য কাউ অ্যান্ড ইটিং ইটস ফ্লেশ’। উলটো দিকে জীবনের প্রথম দিকে বিধবাবিবাহের প্রবল বিরোধী ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেন: ‘কিন্তু মাছ পাঁটার নিকটে কোথা রয়?/ দাসদাস তস্য দাস তস্য দাস নয়।’

হিন্দু কলেজে ডিরোজিয়োর নব্যবঙ্গ ছাত্রদের কথা আর কী বলব, পাঁঠায় তাঁদের মন উঠত না। রাধানাথ শিকদার তো গোমাংসে সমর্পিতপ্রাণ ছিলেন, আর রাজেন্দ্রলাল মিত্র কী খেতেন জানি না, কিন্তু এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকার এক প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন যে প্রাচীন আর্যরা ছিলেন উদ্দণ্ড বিফখোর। এই ছাত্রগোষ্ঠী নাকি লোকেদের বাড়িতে হাড় ছুড়ে দিয়ে ‘আমরা গরু খাই গো গরু খাই গো’ বলে চেঁচাতেন। এখন মনে হয়, এ রকম ‘হোক কলরব’-এর স্টাইলে কাজটা করে ওঁরা ভাল করেননি, বরং দেড়শো বছর পরে ওই একই কলেজে পড়ার সময় আমরা যেমন ক্লাস কেটে মেট্রোয় সিনেমা দেখে কাউকে না ঘাঁটিয়ে নিজামে চুপচাপ সস্তায় বিফ রোল খেতাম, সেটা সুভদ্র ও পরিশীলিত বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অনেক বেশি সাযুজ্যপূর্ণ।

বাংলা ভাষার সর্বপ্রথম দুটি রান্নার বই ১৮৩১ সালে বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কার ভট্টাচার্যের ‘পাকরাজেশ্বর’ আর ১৮৫৮ সালে গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’। দুই সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের লেখাতেই মাংসের এক মহাকাব্য, গৌড়ীয় সাধুভাষায়। ‘পাকরাজেশ্বর’-এ পাঁচ পাতা জুড়ে রকমারি ‘প্রলেহ’, অর্থাৎ কোর্মা ধরনের ব্যঞ্জন তৈরির প্রণালী— সেখানে লাউ, বেগুন, করলা, আর খরমুজের প্রলেহকে ডমিনেট করে রাশি রাশি মাংস, সেখানে মেষের সঙ্গে হাজির কচ্ছপ হরিণ খরগোশ। অতঃপর ‘তিলতৈল’ সহযোগে ‘ছাগাদি মুণ্ড’ এবং হিং ও তেঁতুলছড়া দিয়ে ‘ছাগাদি নাড়ী’ রন্ধনের উপদেশ।

তুলনায়, গৌরীশঙ্করের ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’-এর রেসিপি-বর্ণনে এক ধরনের নির্মোহ, সিনিক্যাল ভায়োলেন্স রয়েছে, যেমন বাঙালির প্রতি ‘ছাগ আদি পশু পরিষ্কার’-এর এই উপদেশ: ‘লোম সহ চর্ম্ম দূর করণের পর উদরস্থ মূত্র পুরীষ ও তিক্তস্থলী এবং নাড়ী ইত্যাদি ত্যাগ করিবে, পরে ওষ্ঠ দন্ত চক্ষু কর্ণ ক্ষুর ও চরণ আদি ত্যাগ করিবে’। এই ত্যাগে অবশ্য তিতিক্ষার দীক্ষা নেই, কারণ ‘বুটি প্রলেহ’ রান্নায় লাগবে কলিজা, দিল, গোর্দ্দা, ফেপড়া, আর ‘নাড়ী রন্ধনে’ লাগবে ঘি গরমমশলা আদা-পেঁয়াজের ফোড়ন। পাতার পর পাতা মাংসের মোচ্ছবে পাশাপাশি জায়গা করে নেয় মাংস দিয়ে করলা বা বেগুনের ‘শুষ্ক প্রলেহ’, মাংস দিয়ে লাউ, কাঁচা আম, আনারস বা কলার পোলাও, আর ঝিঙে, লাউ, বেগুন, শসা বা কাঁকুড়ের ভিতরের শাঁস বের করে নিয়ে তাতে মাংসের কিমার পুর ঠেসে কাবাব। অবাক হয়ে ভাবি, এই মাংসসংকুল মানসবিশ্বের অবাধ বিচরণকারী বাঙালিকে সায়েবরা পেটরোগা, ভিতু, দুবলা-পাতলা জাতি বলে দুয়ো দিতে পারল কী ভাবে?

মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রথম রান্নার বই বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাক-প্রণালী’-তেও (সংকলিত ১৮৮৫-১৯০২) ঠাঁই পেয়েছে লাউয়ের ‘শুষ্ক প্রলেহ’, ‘নাড়ী রন্ধন’, বা ঝিঙের কাবাব। যদিও তাঁর বক্তব্য ছিল যে ‘ইউরোপ প্রভৃতি মহাদেশ সমূহে যে পরিমাণে মাংসাদির প্রচলন, এ দেশে সেরূপ প্রচলিত নাই’, প্রশ্ন জাগে, তবে তাঁর বইয়ের ছত্রে ছত্রে মাংসের এই মহতী আয়োজন কেন? ছাগ, মেষ, হরিণ, শশক, হরেক রকম পক্ষীমাংস, কিছুই বাদ নেই। আহা, কী সব রান্না! মোকশ্বর খেচরান্ন (মাংস দেড় সের, চাল আধ সের, সোনামুগের ডাল আধ সের, ইত্যাদি), খয়বরী জেরবিরিয়ান (মাংস দুই সের, চাল এক সের, ঘৃত দুই সের, ইত্যাদি), মেষ বা হরিণ মাংসের এস্‌ক্যালাপ (সিদ্ধ বা ঝলসানো মেষ বা হরিণমাংস, রুটির ছিল্‌কা, দুধ, ইত্যাদি)— এই সব সহজ সরল ছিমছাম প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার মধ্যবিত্ত বাঙালির রসনারুচি থেকে উধাও হল কী করে?

বিপ্রদাসের ধারাতেই বিশ শতকের গোড়ার দিকে রান্নার বই লিখতে শুরু করেন অভিজাত বাঙালি বাড়ির মহিলারা, ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’-এর (১৯০০) লেখিকা, রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী তাঁদের মধ্যে পথিকৃৎ। তার বেশ কিছু পরে রাজশাহী জেলার দিঘাপতিয়ার জমিদারগৃহিণী কিরণলেখা রায়ের ‘বরেন্দ্র রন্ধন’ (১৯২১)। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আর এক জমিদারগৃহিণী রেণুকা দেবী চৌধুরাণীর ‘রকমারি নিরামিষ রান্না’ আর তার ‘আমিষ খণ্ড’ প্রজ্ঞাসুন্দরীর বইয়ের প্রায় একশো বছর পরে প্রকাশিত হলেও তাদের রেসিপিগুলি মূলত তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশের দশকের। রেণুকা অননুকরণীয় ভাবে লিখেছেন, তাঁর শ্বশুরালয়ে হাঁসের মাংসকে নরম ও সুস্বাদু করার জন্য হাঁসকে পনেরো-কুড়ি দিন অন্ধকার ঘরে শুধু দই-ভাত খাইয়ে রাখার কথা, যে ‘বীভৎস পরিচর্যার পর হাঁসের মাংস খাওয়ার প্রবৃত্তি আমাদের (বউদের) ছিল না।’ কিন্তু খাদ্যবস্তুর সঙ্গে এমন কুসুমিত এমপ্যাথি সবার ছিল বলে মনে হয় না। যিনি আমাদের পর্কের চমৎকার সব রান্না শিখিয়েছিলেন, মনেও করিয়ে দিয়েছিলেন যে বরাহ মাংস বাতনাশক, রুচিকর, বৃষ্য, দুর্জর ও শ্রমনাশক, এবং বাতল, পিত্তশমনকারী, রুচিকর ও ধাতুপোষক,’ সেই প্রজ্ঞাসুন্দরী দাবি করেছিলেন, ‘হিংসার বস্তু মাংসাহারকে সংযত ও সুসংস্কৃত করিয়া কিরূপে খাইতে হয়, পাকগ্রন্থে তাহাই প্রদর্শিত হইয়াছে’। সেই সুসভ্য সংযম ও সংস্কৃতির নির্ভুল ছাপ তাঁর খরগোশের রোস্টের ‘অনুবন্ধন’ প্রণালী: ‘খরগোশ মারিয়া বুকের দিকে চিরিয়া ফেলিতে হইবে। প্রথমে ইহার হাঁটুর নীচে পা চারিটা কাটিয়া ফেল। তারপরে গলার ঢিলা করিয়া চামড়া খুলিয়া পিঠের উপর হইতে পিছনের পায়ের দিক দিয়া এই চামড়াটা খুলিয়া ফেল... তারপরে ঐ চামড়াটা পিঠের উপর হইতে আবার ঘুরাইয়া লইয়া গলার দিক হইতে বাহির করিয়া...’ ইত্যাদি ইত্যাদি, ঠিক যেমন দ্রৌপদীর অপমানের প্রত্যুত্তরে ভীম এক জটিল ‘সেলর্স নট’-এ বেঁধেছিলেন কীচকের শরীর। ভ্রাতুষ্পুত্রীর এই রন্ধনপ্রণালী পড়েই রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতার সংকট’ লিখেছিলেন কি না, জানা যায় না।

কিরণলেখা রায়ও কিছু কম যাননি, বরেন্দ্র অঞ্চলের রন্ধনপ্রথা অনুযায়ী তাঁর বইয়ে মেথি ফোড়ন দিয়ে রকমারি নিরামিষ ব্যঞ্জনের কথা থাকলেও, ‘কেঠোর (ছোট কচ্ছপ) কালিয়া’-র রেসিপিতে তাঁর কলমেও এক শীলিত নির্মমতা: ‘কেঠো কুটা কিছু শক্ত। ইহারা মস্তক বাহির করিলে ধাঁ করিয়া তাহা কাটিয়া ফেলিবে, কেন না সামান্য ভয় পাইলেই ইহারা মস্তক লুকাইয়া ফেলে। অতঃপর কেঠো চিৎ করিয়া ফেলিয়া বুকের খোলার ধার দিয়া একখানি সূঁচাল ডগা বিশিষ্ট হাত-দা’র দ্বারা ঠুকিয়া ঠুকিয়া বুকের খোলাটি কাটিয়া উঠাইয়া... পরে ধারাল ছুরি দ্বারা ভিতর হইতে মাংস কাটিয়া বাহির করিয়া লইয়া কুটিতে হয়।’ পড়লে মনে হয় রান্নার বই নয়, বীরাঙ্গনা কাব্য পড়ছি। সকালে পাঁউরুটিতে হালকা করে সিন্থেটিক অরেঞ্জ মার্মালেড মাখাতে মাখাতে চাতকের মতো পড়ি প্রজ্ঞাসুন্দরীর ‘কমলালেবুর ঠান্ডা জেলী’-র উপকরণ: ‘ভেড়ার পা চারিটা (হাঁটু হইতে খুর পর্যন্ত সমস্তটা), কাঁধের মাংস ১ কিলো, কমলালেবু আটটা... ইত্যাদি ইত্যাদি। এই মাংসের সুরুয়া তৈরি করে তার সঙ্গে কমলালেবুর রস, ডিমের সাদা ইত্যাদি মিশিয়ে ঠান্ডা করে তৈরি-করা জেলি হল যাকে বলে আলটিমেট স্লো ফুড, যে ঘরানা থেকে বাঙালির অপসরণকেই উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের চূড়ান্ত মৃত্যু বলে ধরে নিতে হবে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ভোজনরসিক, নিমন্ত্রণবাড়িতে স্তূপীকৃত মাংস দিয়ে তাঁর ভাত খাওয়ার গল্পও লোকমুখে শুনেছি। অথচ ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘অপরাজিত’— কোথাও মাংসের উল্লেখ নেই। আফ্রিকা থেকে টেলিগিরাপের তার পর্যন্ত সব কিছুতে যার অদম্য কৌতূহল, সেই অপু জীবনে প্রথম বার মাংস খেয়ে সেই অনির্বচনীয় অচেনার আনন্দকে কী ভাবে উপভোগ করত, পথের কবি তা লেখেননি। খাওয়াদাওয়া নিয়ে মিনিমালিজমের মহাকাব্য যে ‘আরণ্যক’, সেখানে অবধি পক্ষীমাংসের উল্লেখ আছে, আর ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর রাঁধুনি হাজারি ঠাকুরের শেখা কোনও-জল-না-দিয়ে নেপালি কায়দার মাংসের রেসিপি না দিয়ে বিভূতিভূষণ অন্যায় করেছিলেন সন্দেহ নেই। তাঁর ‘যাত্রাবদল’ গল্পে আমরা শিউরে উঠে পড়ি এক ভয়ংকর রাত্রির কথা, যখন চলন্ত ট্রেনের মধ্যে স্বামী ও শিশুপুত্রের সামনে হঠাৎ মারা-যাওয়া এক যুবতীকে শ্মশানে দাহ করতে এসে লেখক দেখেন, দাহ শেষে সদ্য-বিপত্নীক স্বামীর পয়সায় পরোটা-মাংস খাওয়ার জন্য চটজলদি জোগাড়-করা শ্মশানবন্ধুদের আকুলিবিকুলি। কিন্তু, যদ্দূর মনে পড়ে, হাজার পাতার ট্রিলজিতেও বেচারা অপুর কপালে মাংসযোগ আর ঘটে না।

সে না হোক, তবু এই দুঃখময় পৃথিবীতে সেই সাতপুরনো মাংস আমাদের জীবনে এখনও এক পরম নিশ্চিন্তিপুর। মফস্‌সলে কাটানো আমার বাল্যকালে রবিবার সকালে ক্রিকেট খেলতে বেরোতাম বটে, কিন্তু বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ চার পাশের বাড়ি থেকে প্রেশার কুকারের এক সম্মিলিত ভোঁ বাজার সঙ্গে সঙ্গেই খেলা বন্ধ হয়ে যেত, কারণ কী এক অনির্বচনীয় সুবাস— শার্লক হোমসের ডেভিল’স ফুটের মতোই— আমাদের সবার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলত, আমরা জানতাম যে সময় হয়েছে, এখন আর খেলা নয়। এখন জানি বয়স হয়েছে, হাজার ব্যাধি শরীরে, চিতাকাঠ ডাকছে আয় আয় করে, ডাক্তার বলছে খাসনি বাছা খাসনি ওরে, তবু নিজেকে চোখ ঠেরে বলি এখনও সময় যায়নি, খেয়েছি তো একুনে পাঁঠা ভেড়া গরু শুয়োর হাঁস মুরগি বটের কচ্ছপ খরগোশ হরিণ বাইসন ঝিঁঝিপোকা আর চমরীগাই (নট রেকমেন্ডেড), শস্যশ্যামলা ও মাংসময় বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি এখনও? সিদ্ধান্ত নিই, শরৎকুমারের মতো ওই বিষাদময় কবিতা লিখব না কিছুতেই, বরং লিখব মাংসাশীর ম্যানিফেস্টো, বাঙালির রক্ত যত দিন শরীরে, বঙ্গভূমিকে সমস্ত মাংসাশী বাঙালির বাসযোগ্য করে যাব আমি। আমরা মহামিলনের মন্ত্রদীক্ষিত, মাংস খাব বিদ্যাপতি পড়তে পড়তে, কেত্তন গাইতে গাইতে, তা তা থৈ থৈ নাচতে নাচতে। মাংসে আমার জন্মগত অধিকার, অ্যান্ড আই শ্যাল হ্যাভ ইট। কোনও কথা হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Carnivorous Bengali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE