চিল্কা হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে, উড়ন্ত বকের দিকে তাক করে এয়ারগানের ট্রিগার চেপে ধরল কিশোর ছেলেটি। গুড়ুম! নির্ভুল টিপ। বন্দুক দিয়ে পাখি মেরে, সেই মৃত পাখির পায়ে দড়ি বেঁধে দোলাতে দোলাতে নিয়ে যাওয়া— এই ছিল ছেলেটির খেলা। সে দিনও তাই হত, কিন্তু মৃত বকের দু’ঠোঁটের মধ্যে তখনও আটকে আছে খড়কুটো। বাসা বানানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছিল নিশ্চয়ই। দৃশ্যটা দেখে অনুতাপ হল, কান্না পেল কিশোর নন্দকিশোর ভুজবলের।
সত্তরের দশকের প্রথম দিক, নন্দকিশোর তাঁর গ্রাম টাঙ্গি থেকে চলে আসেন শহরে। সেই এয়ারগানটা কবেই হারিয়ে গিয়েছে তাঁর, বরং ভাল লাগে পাখির রঙিন ডানা। দেশি-বিদেশি পাখি নিয়ে চর্চাও করেন। চিল্কা হ্রদের একটা অংশর নাম মঙ্গলাজোড়ি। সেখানে অবশ্য চিল্কার মতো অত জল নেই। কম জলে মাছ বেশি। জেলেদের যেমন প্রিয় জায়গা তেমন শীত পড়তে না পড়তেই মঙ্গলাজোড়ির জলাশয় ভরে যায় লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী পাখির কলতানে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে নন্দকিশোর বুঝেছিলেন, এই হ্রদের পাখিরা বিপণ্ণ। শীতের সময় মাছ ধরার পাশাপাশি জেলেরা কখনও বিষ দিয়ে, কখনও গুলি করে, কখনও বা স্রেফ ঘাড় মটকে নির্বিচারে হত্যা করে ইউরোপ, রাশিয়া, বৈকাল হ্রদ, কাস্পিয়ান সাগর, মানস সরোবর থেকে উড়ে আসা হাঁসেদের। একটা হাঁস মারতে পারলে দারুণ ভোজ। জেলেদের খিদের চেয়ে স্থানীয় ধাবা মালিকদের খিদে আরও বেশি। একটা হাঁস মানে ৪০-৫০ টাকা।
‘‘এই ঘটনা জানার পর ছোটবেলার সেই অনুতাপ আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। কিছু একটা করা দরকার। এই চিন্তা বারবার তাড়া করছিল। শিকারীদের সবাই ভয় পেত। যাকে মঙ্গলাজোড়ির ‘বীরাপ্পন’ বলা হত সেই কিশোর বেহেরার সঙ্গেই প্রথম কথা বলেছিলাম।’’ স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো বছর পিছিয়ে গেলেন নন্দকিশোর। কিশোর ছাড়াও সেই সময় আরও এক ত্রাসের নাম মধু বেহেরা। মধু ও তাঁর দলের ১১ জন সঙ্গী শিকারীকে সবাই বলত ‘ডার্টি ডজন’। তাঁদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার সাহস ছিল না বনদফতরেও! নন্দকিশোর বুঝেছিলেন, কাজটা সহজ নয়। ‘বীরাপ্পন’ ও ‘ডার্টি ডজন’দের বোঝাতে গিয়ে পেলেন প্রাণনাশের হুমকি! কিন্তু জেদ ছাড়লেন না। পাখি শিকারের বিরুদ্ধে সই জোগাড় শুরু করলেন তিনি। অস্বস্তি বাড়ল শিকারীদের মধ্যে।
ত্রাতা: নন্দকিশোর ভুজবল। (ডান দিকে) মধু বেহেরা
শোনা যায়, নীরব প্রতিবাদ এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে মধু নাকি ছুরি হাতে আপনার বাড়ি সটান চলে এসেছিল, আপনাকে খুন করতে? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন নন্দকিশোর, ‘‘হ্যাঁ সে সব হয়েছিল বটে। কিন্তু এখন তো সব বদলে গিয়েছে।’’ সে দিন মধুর ছুরির সামনে ভয় না পেয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাকে মেরে ফেলো কিন্তু পাখিগুলোকে ছেড়ে দাও।’’ কথাটায় ধাক্কা খেয়েছিলেন মধু। ক’দিন পর সদলবল নন্দকিশোরে কাছে এসে জানিয়েছিলেন, তাঁরা আর পাখি হত্যা করবেন না। কিন্তু নন্দকিশোর বুঝেছিলেন, অভাবের তাড়নায় জেলেরা শিকার করে। আবেগ কাটলেই খিদে আবার তাদের ধাবামুখী করবে। তা হলে? একটাই রাস্তা। মানুষগুলো ধর্মভীরু। নন্দকিশোর তাঁদের নিয়ে গেলেন গ্রামের মন্দিরে। ঈশ্বর সাক্ষী রেখে তাঁরা শপথ নিলেন, আর কোনওদিন পাখি হত্যা করবেন না। নন্দকিশোর বুঝেছিলেন, শিকার পুরোপুরি বন্ধ হবে তখনই, যদি এদের বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থা করা যায়। শুরু হল সেই কাজ। তাঁর উদ্যোগে তৈরি হল ‘শ্রীশ্রী মহাবীর পক্ষী সুরক্ষা সমিতি’। কিশোর, মধু ও বাকি চোরা শিকারীদের নিয়ে শুরু করলেন পাখি চেনানোর কাজ।
বেশ কয়েক বছর হল মঙ্গলাজোড়িতে মধু ও তাঁর দলের লোকেরা পর্যটকদের নৌকায় করে ঘুরিয়ে দেখায় লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী পাখি। পাখি দেখাতে দেখাতে ওঁরা বলে উঠেন, ‘ও দেখিয়ে পিনটেল, থোড়া বাদ গডউইট-কা ঝুণ্ড পুরা আসমান ভর দেগা। লেন্স রেডি করকে রাখিয়ে মালাড-কা ফ্লাইং শট মিল জায়েগা।’ কে বলবে এঁরা কখনও রত্নাকর ছিলেন। এ যেন পূর্বজন্মের কথা! এঁদের প্রায় সকলের হাতে সেলিম আলির ‘দ্য বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস’। কিন্তু কেউ ইংরেজি পড়তে জানেন না! অনেকে নিরক্ষরও। তবু জানেন পাখিদের ইংরেজি নাম। কোনও পর্যটক বুঝতে না পারলে বই খুলে দেখিয়ে দেন পাখিটির ছবি। শুধু পাখি চেনানো নয়, এঁরা রাত জেগে পাহারা দেন শিকার আটকানোর জন্য। প্লাস্টিকমুক্ত রাখার চেষ্টা করেন হ্রদ। আর্থিক অবস্থাও এখন অনেকটাই ভাল। চিল্কা উন্নয়ন নিগম ‘শ্রীশ্রী মহাবীর পক্ষী সুরক্ষা সমিতি’কে স্বীকৃতি দেওয়ার পর এই কাজে এগিয়ে এসেছেন আরও অনেক জেলে। এখন মঙ্গলাজোড়ি পাখিদের স্বর্গরাজ্য।
‘‘পুরনো দিনের কথা আর মনে করতে চাই না। আমরা যা করেছিলাম, ঠিক করিনি। কিন্তু এখন বদলে গিয়েছি। এখানে ইকো-টুরিজম তৈরি হয়েছে। প্রচুর পর্যটক আসেন। আমরাই সবাইকে ঘুরে দেখাই।’’ মধু বেহেরার গলায় পরম তৃপ্তি।
মঙ্গলাজোড়ির ছবি: লেখক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy