Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

কোনও বিজ্ঞাপন নয়, স্রেফ মুখে মুখে ৩০০ কোটি ব্যবসা এই লজেন্সের!

বিজ্ঞাপনের দামামা বাজাতে হয়নি। তবু লজেন্স থেকে সিনেমা, অনেক কিছুই ছড়িয়েছে স্রেফ মুখে মুখে। সুজিষ্ণু মাহাতোলজেন্সের দাম ১ টাকা। দু’বছরে ৩০০ কোটির ব্যবসা।১২০ কোটির দেশে তা হলে অঙ্কের হিসেব সহজ! ভারতে থাকা প্রতিটি মানুষই অন্তত দু’বার এই লজেন্স খেয়েছেন। অথচ এই ল়জেন্সের কোনও বিজ্ঞাপন নেই।

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৭ ১৬:২৫
Share: Save:

লজেন্সের দাম ১ টাকা। দু’বছরে ৩০০ কোটির ব্যবসা।

১২০ কোটির দেশে তা হলে অঙ্কের হিসেব সহজ! ভারতে থাকা প্রতিটি মানুষই অন্তত দু’বার এই লজেন্স খেয়েছেন। অথচ এই ল়জেন্সের কোনও বিজ্ঞাপন নেই। নেই রাস্তার ধারে বিশাল হোর্ডিং বা টিভিতে নজরকাড়া আবেদন। কোনও তারকা আপনাকে বলছেন না এই লজেন্স খেতে। বলছেন পরিচিতরাই। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবেরা। চেনা মুখেই আসছে চেনা স্বাদের প্রশংসা। আর সেটাই এই লজেন্সের রমরমা সাফল্যের রহস্য।

অন্যের মুখের কথাতে প্রচার। বিজ্ঞাপনের পরিভাষায় যার নাম ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’ ক্যাম্পেন। আর এই মুখের কথাতেই দেশ জুড়ে বাজিমাত করেছে ‘পাল্স’ ক্যান্ডি। ২০১৫ সালে এই লজেন্স বাজারে আনে ডিএস গ্রুপ। বাজারে তখন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছে দেশেরই আর এক কোম্পানি পার্লের ‘ম্যাঙ্গো বাইট’। রয়েছে ভিনদেশি প্রতিদ্বন্দ্বীও। ইতালির কোম্পানি পারফেট্টি-র ‘অ্যালপেনলিবে’। তবে স্বাদের দুনিয়ায় এমন দুই পোড়-খাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বীও রুখতে পারেনি পাল্‌স-এর উত্থান। উল্কার গতিতে আট মাসেই একশো কোটির ব্যবসা করে পাল্স। আর, ২০১৭-তে দু’বছর পেরোতে না পেরোতেই তাদের ব্যবসা ছুঁয়েছে ৩০০ কোটি!

কিন্তু শুনতে তাজ্জব লাগলেও সত্যি, পাল্স ক্যান্ডির বিজ্ঞাপনের জন্য কার্যত কোনও বরাদ্দই করতে হয়নি নির্মাতাদের। কারণ এর কথা দেশ জুড়েই ছড়িয়েছে লোকের মুখে মুখে। ঢাউস বিজ্ঞাপনে মুখ না ঢেকে দিয়েও মানুষের কাছে তা হলে এ ভাবে পৌঁছে যাওয়া যায়?

ইতিহাস বলছে, যায়। সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল নিমেষে। টুনটুনি পাখি তো হাটেমাঠে ‘রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরে সে ধন আছে’ কথাটা এমন ভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিল যে স্বয়ং রাজাও তাকে প্রাসাদে ডাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’-এর মতো এমন শক্তিশালী বিপণন-মাধ্যম খুব কমই রয়েছে। শৌভিক মিশ্র মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আমাদের চেনাজানা অনেক ব্র্যান্ডই রয়েছে, যেগুলোর কোনও দিন কোনও বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে না। কিন্তু তাদের নাম সবাই জানে। যেমন কেটে গেলে আর্নিকা, গলায় মাছের কাঁটা আটকে গেলে হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ সাইলেশিয়া থার্টি-র কথা বাংলার ঘরে ঘরে সবার জানা। তাদের কাউকে কোনও দিন তা প্রচার করতে হয়নি।

শুধুই ওষুধ? পাল্স-এর সাফল্য মনে পড়িয়ে দিচ্ছে, এই বাংলায় ‘কালিকার তেলেভাজা’ বা ‘প্যারামাউন্টের ডাব-শরবত’— কাউকেই বিজ্ঞাপনের পিছনে বিন্দুমাত্র খরচ করতে হয়নি। দামামা না বাজিয়েও কয়েক দশক ধরে লোকের মুখে মুখে তৈরি হয়ে গিয়েছে তাদের ব্র্যান্ড-আইডেন্টিটি। বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানা, চন্দননগরের জলভরা, এই মোড়ের ঘুগনি হোক বা ওই মোড়ের ফুচকা—জনপ্রিয় সব কিছুই ছড়িয়ে পড়ে স্রেফ মুখে মুখে।

বিজ্ঞাপন জগতে দীর্ঘ দিন কাজ করা অনীক দত্ত যখন ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ তৈরি করেন, তখন সেই ছবির কিন্তু কোনও ব্যাপক প্রচার ছিল না। কিন্তু লোকের মুখে মুখে ফিরেছিল। অনীক জানাচ্ছেন, ওয়ার্ড অব মাউথ-এর কার্যকারিতার একটা বড় কারণ বিশ্বাসযোগ্যতা। তাঁর কথায়, ‘অনেকে মনে করেন, যাঁদের জিনিস তাঁরা নিজেরা তো সেটা নিয়ে ভাল কথা বলবেই। কিন্তু আমার চেনা লোক যখন বলছেন, তা হলে এটা নিশ্চয়ই ভাল হবেই।’

এই কৌশলেই ভরসা রেখেছিল পাল্‌স। ডিএস গ্রুপের কর্তারা জানিয়েছেন, পাল্‌স প্রথমে পরীক্ষামূলক ভাবে রাজস্থান, গুজরাত ও দিল্লিতে বিক্রি শুরু হয়েছিল। কোনও প্রচার ছাড়াই তার চাহিদা এত বাড়ে যে পরে অন্য রাজ্যের বাজারে তা ছাড়া হয়। তাতেও প্রবল চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হত। তাঁরা জানাচ্ছেন, পাল্‌স-এর ‘ইউনিক’ স্বাদও এর সাফল্যের একটা বড় কারণ। লজেন্স তৈরির আগে রিসার্চের সময় তাঁরা বুঝেছিলেন, কাঁচা আমের স্বাদ এমন একটা স্বাদ, যা গোটা দেশে কোনও না কোনও ভাবে সবাই খেয়ে থাকেন। তাই কাঁচা আমের স্বাদের উপরেই ফ্লেভার তৈরি করাতেই ‘সুপারহিট’ হয় পালস। অনীকও জানাচ্ছেন, যা নিয়ে লোকে কথা বলবে, সেই জিনিসটা অন্তত কিছু লোকের কাছে প্রথমে জনপ্রিয় হতে হবে। না হলে ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’-এর বলটাই বা গড়াবে কি করে?

‘ওয়ার্ড অব মাউথ’-এর আবহ তৈরি করতেও তাই নানা ব্র্যান্ড এমন বিজ্ঞাপন করে, যা নিয়ে সকলে কথা বলবে। শৌভিক কয়েক বছর আগের ‘বেনেটন’-এর তৈরি এক বিজ্ঞাপনের কথা মনে করাচ্ছেন যেখানে দেখা গিয়েছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট উগো চাভেস-এর চুম্বনরত ছবি। ‘আনহেট’ স্লোগান দিয়ে তৈরি ওই ক্যাম্পেন নিয়ে যাতে চর্চা হয়, সে কারণেই এই কৌশল নিয়েছিল বেনেটন।

আজকের দুনিয়ায় অবশ্য ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’ বা ‘মুখের কথা’-র খানিক চরিত্র বদল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল মঞ্চ পেয়ে তা আরও শক্তিশালী। তাই তো আরব বসন্ত বা শাহবাগের মতো আন্দোলনের কথা ফেসবুকে ছড়ায় হু-হু করে। হোয়াটস্‌অ্যাপে ‘ভাইরাল’ হয় নানা রটনা।

শুধু বিজ্ঞাপন জানে, যা রটে, কিছুটা বটে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lozenges Business
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE