Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

ভিক্টোরিয়ার বাঙালি বন্ধু

বাকিংহাম প্রাসাদ ও বিভিন্ন জায়গায় সেই বাঙালির সঙ্গে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে ইংল্যান্ডের রানির। টেম্স নদীর জলে থাকত তাঁর বজরা, চার্লস ডিকেন্স থেকে অনেকেই পানভোজনে আমন্ত্রিত হতেন সেখানে। বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুরের একটি স্কেচও এঁকেছিলেন মহারানি। শ্রাবণী বসুবাকিংহাম প্রাসাদ ও বিভিন্ন জায়গায় সেই বাঙালির সঙ্গে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে ইংল্যান্ডের রানির। টেম্স নদীর জলে থাকত তাঁর বজরা, চার্লস ডিকেন্স থেকে অনেকেই পানভোজনে আমন্ত্রিত হতেন সেখানে। বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুরের একটি স্কেচও এঁকেছিলেন মহারানি। শ্রাবণী বসু

টেগোর জমিদার: ভিক্টোরিয়ার ডাইরিতে তাঁর নিজের হাতে আঁকা দ্বারকানাথের স্কেচ

টেগোর জমিদার: ভিক্টোরিয়ার ডাইরিতে তাঁর নিজের হাতে আঁকা দ্বারকানাথের স্কেচ

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৭ ০০:৫৭
Share: Save:

জু ন মাসের সেই দিনটায় ইংল্যান্ডেও বেশ গরম। উইন্ডসর ক্যাস্‌ল-এ একটা আয়েশি প্রাতরাশ সেরে, তেইশ বছর বয়সি রানি ভিক্টোরিয়া অপেক্ষা করছিলেন এক ‘বিশেষ দর্শনপ্রার্থী’-র। নামজাদা এক ভারতীয় আসছেন রানির কাছে। আর তাঁর ভারতীয় সাম্রাজ্য থেকে আসা মানুষজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের শখ রানির বরাবরই।

এগারোটা বাজার খানিক পরে, লেফটেন্যান্ট ফিটজেরাল্ড, রানির অধস্তন এক রাজকর্মচারী, তাঁর সামনে নিয়ে এলেন ‘ভিজিটর’কে। তাঁর নাম দ্বারকানাথ ঠাকুর। লম্বা, সুভদ্র, সুদর্শন ব্রাহ্মণ ক’দিন আগেই ইংল্যান্ডের ডোভার বন্দরে এসে পৌঁছেছেন, তাঁর নিজের জাহাজে চেপে। জাহাজের নাম ‘দি ইন্ডিয়া’। ১৮৪২ সালের ৯ জানুয়ারি কলকাতা থেকে জাহাজ ছেড়েছিল। আর তার ঠিক ছ’মাস পর, ৯ জুন দ্বারকানাথ ইংল্যান্ডে পৌঁছন— যাত্রাপথে নেপলস সহ ইউরোপের অনেকগুলো শহর ঘুরে। লন্ডন পৌঁছে ক’দিনের বিশ্রাম সেরে, ১৬ জুন তিনি এসেছেন রানির দর্শনে।

রানি বসে ছিলেন সেই ঘরটায়, যেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশ থেকে ইংল্যান্ডে সফরে আসা হোমরা-চোমরাদের দর্শন দিতেন। ঘরের দেওয়ালে তাবড় সব ইংরেজ রাজাদের ছবি— ‘উইলিয়াম দ্য কংকারার’ থেকে শুরু করে তৃতীয় জর্জ হয়ে রানি শার্লট অবধি। মাথার ওপর লম্বা, বিরাট একটা ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি। দ্বারকানাথকে রানির সামনে নিয়ে আসা হলে, রানি তাঁর চেয়ারে বসলেন। দ্বারকানাথও মাথা নুইয়ে, প্রথামাফিক রানির হাতে চুম্বন করলেন।

এই সাক্ষাতের পরে, রানি তাঁর জার্নালে একটা ছবি এঁকেছিলেন। দ্বারকানাথের স্কেচ। সঙ্গে লেখা পরিচয়: ‘Tagore Zemindar’। রানি ডায়রিতে আরও যা লিখেছিলেন, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘লেফটেন্যান্ট ফিটজেরাল্ড এক ব্রাহ্মণকে নিয়ে এলেন, যিনি হাতে চুমু খেলেন। তাঁর পরনে ছিল তাঁর জাতীয় পোশাক, সোনালি-আর-লাল সুতোর কাজ করা পাজামা, অপূর্ব শাল, আর ঠিক এই ছোট্ট ছবিতে যেমন আছে, তেমনই দেখতে পাগড়ি।’

উইন্ডসর ক্যাসল থেকে রানি আর প্রিন্স আলবার্ট বাকিংহাম প্রাসাদে ফিরেছিলেন সে দিন। রানির লেখাতেই পাওয়া যায়, প্রাসাদের বাগানে বসে তিনি কিছু ক্ষণ ডায়রি লিখেছিলেন। ‘তার পর নৌকোয় উঠলাম, আর আলবার্ট লেকের ওপর দিয়ে নৌকো চালাল বেশ কিছু ক্ষণ। দারুণ লাগল।’

ভারতীয় বণিক দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে এই ছিল রানির প্রথম সাক্ষাৎ। কেবল দেখাই নয়, দুর্দান্ত এক বন্ধুত্বেরও শুরুয়াত ছিল সেটা। যে বন্ধুত্ব অটুট ছিল পরের চার বছর, ১৮৪৬ সালের ১ অগস্ট দ্বারকানাথের অকালমৃত্যুর আগে পর্যন্ত।

রানির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই লন্ডনের ‘হাই সোসাইটি’তে দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রবেশাধিকার মিলে গেল। ভারত থেকে আসা দ্বারকানাথ বিলাসবহুল সব পার্টি দিতেন, অতিথিদের দিতেন বহুমূল্য উপহার। দান-খয়রাত করতেন অকাতরে। ৪৮ বছর বয়সি দ্বারকানাথ বিশেষ প্রিয় হয়ে ওঠেন ইংরেজ ‘লেডি’দের। বহু ডিউকের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু হয় তাঁর, ডাচেসরা ছিলেন তাঁর বিশেষ অনুরক্ত। শিল্প, সংগীত ও সাহিত্যের সমঝদার দ্বারকানাথ টেমসের জলে একটা নৌকো রেখেছিলেন, যেখানে চার্লস ডিকেন্স, উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে সহ সে সময়কার দিকপালদের নেমন্তন্ন করতেন তিনি। ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’-এর লেখক থ্যাকারে তো আবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই কলকাতাতেই।

পরের পাঁচ মাসে দ্বারকানাথের সঙ্গে রানির কয়েক বার দেখা হয়েছিল। রানি তাঁর বন্ধুপ্রীতির নিদর্শন স্বরূপ দ্বারকানাথকে একটি মেডেল দিয়েছিলেন, আলাদা করে অর্ডার দিয়ে তৈরি করা। তাতে রানির ও প্রিন্স আলবার্টের ছবি আঁকা ছিল। এই দ্বারকানাথের অনুরোধেই রানি ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স আলবার্ট বসেছিলেন ছবি-আঁকিয়ের সামনেও। প্রমাণ সাইজের সেই ছবি পাঠানো হয়েছিল কলকাতায়, টাঙানো হয়েছিল টাউন হল-এর দেওয়ালে।

১৮৪২-এর এই ইংল্যান্ড সফরের সময়েই দ্বারকানাথ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের কাছ থেকে একটা সোনার মেডেল পেয়েছিলেন। সঙ্গে একটা চিঠিও, সেখানে প্রশস্তিসূচক অনেক কথা লেখা। ভারত আর গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যেকার সম্পর্ক শক্তিশালী করার লক্ষ্যে দ্বারকানাথের প্রচেষ্টা যে কোম্পানির সমূহ প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে, চিঠির বয়ানে স্পষ্ট।

বন্ধু: ভিক্টোরিয়া ও দ্বারকানাথ

দ্বারকানাথের সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য একেবারে মধ্যগগনে। তিনি ছিলেন হাতে-গোনা কয়েক জন ভারতীয়ের অন্যতম, ব্রিটিশদের সঙ্গে যাঁদের সরাসরি যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল। আজকের টাটা-মিত্তলদের মতো পশ্চিমি জগতেও প্রভাব-ফেলা ভারতীয় শিল্পসংস্থা তখন কোথায়! দ্বারকানাথই প্রথম ভারতীয় যিনি বিদেশভ্রমণে গিয়েছিলেন, আর তুলে ধরেছিলেন পশ্চিমি সংস্কৃতির ভাল দিকগুলো।

নিজের ব্যবসায়িক দক্ষতা ও সমাজ-সংস্কারক মন দিয়ে দ্বারকানাথ বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশ রাজত্ব ভারতে পরিবর্তন আনতে পারে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, উনিশ শতকের ভারতকে কুরে কুরে খাচ্ছে যে জাতপাত, সরকার ও প্রশাসন যুক্তিনির্ভর হলে সে-সব নিজে থেকেই এক দিন দূর হয়ে যাবে। পাশাপাশি, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যাতে আরও বেশি সুযোগসুবিধা পান, সেটাও তিনি চেয়েছিলেন।

দ্বারকানাথের জন্মের সময়, ১৭৯৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড কর্নওয়ালিস। তাঁর হাতে ভূমি সংক্রান্ত আইনগুলির ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে জন্ম নেয় নতুন এক করদাতা জমিদারশ্রেণি। কলকাতার ঠাকুর পরিবার যেমন। বিশাল ভূ-সম্পত্তির অধিকারী জমিদার হওয়া সত্ত্বেও দ্বারকানাথ তাঁর পারিবারিক ব্যবসার পরিসরকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নানান দিকে, খুব অল্প সময়েই।

১৮২২ সালে কলকাতায় প্রবাসী ব্রিটিশদের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার। স্বদেশে তাঁদের যা যা ছিল, তাঁরা সেগুলো এই কলকাতাতেও চাইছিলেন। চাইছিলেন ইংরেজি খবরের কাগজ, থিয়েটার হল। সাহেবদের এই প্রয়োজনগুলোকে কেন্দ্র করে যে বিপুল এক বাজারের সম্ভাবনা আছে, দ্বারকানাথ তা বুঝতে পেরেছিলেন।

এই দ্বারকানাথকেই ১৮২৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘বোর্ড অব কাস্টমস, সল্ট অ্যান্ড ওপিয়াম’-এর দেওয়ান নিযুক্ত করল। পরের বছর, ১৮২৯ সালে দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’। প্রথম বাণিজ্যিক ব্যাংক, যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা অন্য কোনও বাণিজ্যিক সংস্থার অধীন ছিল না। পরে এই ব্যাংকের অন্যতম ডিরেক্টরও হয়েছিলেন। জাহাজের ব্যবসাসহ বাংলায় নতুন গড়ে ওঠা ব্যবসায়িক প্রচেষ্টায় দ্বারকানাথের ব্যাংক ঋণ দিয়ে সাহায্য করত। ব্যবসা ছড়ালেন পত্রপত্রিকার জগতেও। ১৮৩০-এর মধ্যেই দ্বারকানাথ তখনকার শ্রেষ্ঠ সংবাদপত্রগুলোর (যার মধ্যে ছিল ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’, ‘দি ইংলিশম্যান’, ‘বঙ্গদূত’ এর মতো কাগজ) ব্যবসায়িক অংশীদার হলেন।

তার চার বছর পর, ১৮৩৪ সালে তৈরি হল ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’। ব্রিটিশ পার্টনারদের সঙ্গে যৌথ অংশদারিত্বে কোনও সংস্থার নির্মাণ সেই প্রথম। এর আগে ব্রিটিশরা পার্সিদের বিজনেস পার্টনার করেছে, কিন্তু বাঙালিদের এই প্রথম। সে দিক থেকেও এই সংস্থা ছিল ব্যতিক্রম। তখন নীলচাষের যুগ, নীলই ছিল এই সংস্থার প্রধান পণ্য। নীল ব্যবসায় সংস্থার বিশাল লাভ হয়েছিল, কারণ ইউরোপের ফ্যাশনদুরস্ত সমাজে নীল ছিল জনপ্রিয় রং। ক্রমে ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ হয়ে ওঠে নীল-ব্যবসার মুখ। দ্বারকানাথের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল, ব্রিটিশরা তাঁকে চিনে আফিম সরবরাহের জন্য জাহাজ নিয়ে যাওয়ারও অনুমতি দিল। এই অনুমতিও ব্যতিক্রমী, কেননা ব্রিটিশরা এত দিন আফিম আর চায়ের ব্যবসা রেখেছিল নিজেদের হাতেই। শুল্ক, নুন, চা, কয়লা, জাহাজ, নীল, আখ, আফিম— কীসের না ব্যবসা ছিল দ্বারকানাথের! ১৮৪০-এর মধ্যেই দ্বারকানাথের বাণিজ্য-সাম্রাজ্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, আর ব্যবসার বিপুল মুনাফা তিনি ব্যয় করেন ভূসম্পত্তি কেনায়। ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করে, রানিগঞ্জে খনি থেকে কয়লা তোলানোর কাজ শুরু করেন তিনি। তৈরি করেছিলেন ‘স্টিম টাগ অ্যাসোসিয়েশন’, ভারতের নদীগুলো দিয়ে ‘স্টিম নেভিগেশন’-এর প্রচলনও তাঁর হাতেই। কলকাতার খিদিরপুরে ডক বানিয়েছিলেন জাহাজ মেরামতের জন্য। তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়, যিনি এই সমস্ত কাজে এগিয়ে এসেছিলেন।

ছিলেন সমাজ সংস্কারেও। সতীদাহ প্রথা রদের ব্যাপারে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন খোদ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক। দ্বারকানাথ ছিলেন রাজা রামমোহনের রায়ের বন্ধু ও তাঁর সংস্কার আন্দোলনের সমর্থক। হিন্দু স্কুল, জেলা দাতব্য হাসপাতাল, ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি-র মতো প্রতিষ্ঠানে প্রচুর অর্থদান করেছিলেন তিনি।

তাঁর সমাজ-সংস্কারে উৎসাহ ইউরোপ-সফরেও বিদ্যমান ছিল। লন্ডনের এলিট সমাজে ওঠাবসা যেমন করতেন, তেমনই তৎকালীন ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীদের কথাও সমান আগ্রহে শুনতেন। লন্ডনে দেখা করেছিলেন দাসপ্রথার প্রবল বিরোধী, বাগ্মী জর্জ টমসনের সঙ্গে। ইংল্যান্ড থেকে আয়ারল্যান্ড গেলেন, সেখানে তখন ভয়ংকর খরা আর দুর্ভিক্ষ চলছে। সেখানে দেখা করেছিলেন বিখ্যাত আইরিশ ক্যাথলিক নেতা ড্যানিয়েল ও’কনেল-এর সঙ্গে। প্যারিসে তিনি রাজা লুই ফিলিপের সম্মাননীয় অতিথি, আবার লন্ডনে ‘বোনাপার্টিস্ট’ গোষ্ঠীর সদস্যদেরও বন্ধু।

১৮৩৩ সালে ব্রিস্টলের কাছে স্টেপলটনে রাজা রামমোহন রায় মারা যাওয়ার পর দ্বারকানাথই বন্ধুর স্মৃতিতে সমাধিসৌধ তৈরি করে দেন। তারও দশ বছর পর, রামমোহনের দেহ তুলে এনে ফের সমাধিস্থ করলেন ব্রিস্টলের আর্নস ভেল সমাধিক্ষেত্রে। উইলিয়াম প্রিন্সেপ-এর বানানো বিখ্যাত সেই সমাধিসৌধের যাবতীয় খরচপত্র দিয়েছিলেন দ্বারকানাথই।

ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে আসা দ্বারকানাথ ঠাকুরকে সবাই চিনত প্রভাবশালী জমিদার ও ট্যাক্স-কালেক্টর হিসেবে। ভারতের ব্রিটিশ শাসকরা তাঁকে একটা স্পেশাল ট্রেন পর্যন্ত দিয়েছিলেন। সাদা রঙের সেই ট্রেনের গায়ে লেখা থাকত তাঁর নামের আদ্যক্ষর— ডিএনটি।

১৮৪৫ সালের ৮ মার্চ ফের ইংল্যান্ডে ফিরলেন, ‘দ্য বেন্টিংক’ নামের জাহাজে চেপে। ২১ জুন পৌঁছলেন ডোভারে। রানি ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স আলবার্ট স্বাগত জানালেন তাঁদের ‘পুরনো বন্ধু’কে।

এই সফরই ছিল তাঁর শেষ সফর। দ্বারকানাথের একটা পুরনো অসুস্থতা ছিলই (সম্ভবত ডায়াবেটিস)। হাওয়াবদলের জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল সমুদ্রতীরের শহর ওয়ার্দিং-এ। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জার্মান সঙ্গীতকার বন্ধুকে, যিনি তাঁকে তাঁর প্রিয় সোনাটাগুলো বাজিয়ে শোনাতেন। দ্বারকানাথ তখন খুব অসুস্থ, অনেক সময়ই থাকেন অর্ধচেতন অবস্থায়।

১৮৪৬-এর ১ অগস্ট দ্বারকানাথ মারা গেলেন সেন্ট জর্জেস হোটেলে। খুব ঝড়বৃষ্টির একটা রাত সেটা, থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে সেন্ট জর্জেস হোটেল এক মাইলেরও কম পথ। সে দিন দ্বারকানাথের সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছোট ছেলে নরেন্দ্রনাথ আর ভাগ্নে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। চার দিন পর, কেনসাল গ্রিন সেমেটরি-তে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। শুধু তাঁর হৃৎপিণ্ডটা কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল, সৎকার-অনুষ্ঠানে প্রথামাফিক সেটির দাহ করা হয়। সে দিন শোক-অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর ছেলে, ভাগ্নে, ইংল্যান্ড-সফরে তাঁর সঙ্গে যাওয়া চার জন ডাক্তারির ছাত্র আর তাঁর এক কালের কর্মসঙ্গী মেজর হেন্ডারসন ও উইলিয়াম প্রিন্সেপ। খোদ মহারানি ভিক্টোরিয়া একটা শববাহী ঘোড়ারগাড়ি পাঠিয়েছিলেন সে দিন অনুষ্ঠানে। দ্বারকানাথের সমাধিফলকে লেখা ছিল: ‘Dwarkanauth Tagore of Calcutta. OBIIT 1st August 1846’। লেখা ছিল তাঁর নামের আদ্যক্ষরও। ৭ অগস্ট তারিখে বিখ্যাত লন্ডন মেল পত্রিকা দ্বারকানাথের স্মরণে শোকবার্তা প্রকাশ করেছিল।

ওই একই সেমেটরিতে সমাধি আছে উইলিয়াম থ্যাকারে ও অ্যান্টনি ট্রলপ-এর মতো লেখক, টমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েল-এর মতো শিল্পী, ইসামবার্ড কিংডম ব্রুনেল-এর মতো প্রযুক্তিবিদ-স্থপতি, কুইন ব্যান্ডের বিখ্যাত রকস্টার ফ্রেডি মার্কারিরও। অদৃষ্টের পরিহাস, ব্রিস্টলে দ্বারকানাথের বানানো রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি দেখতে ব্রাহ্মসমাজের মানুষ থেকে শুরু করে বাঙালি পর্যটক অবধি সবাই আসেন, কিন্তু কেনসাল গ্রিন সেমেটরিতে দ্বারকানাথের সমাধি পড়ে আছে বিস্মৃত। ওয়েস্ট লন্ডনের এই সেমেটরিতে তাঁর সমাধি দেখতে কেউ তেমন আসেনই না, ফুল দেওয়া তো দূরস্থান। আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের প্রথম প্রতিনিধি দ্বারকানাথ— ভিক্টোরিয়ার কলমে আঁকা দ্বারকানাথ শুয়ে আছেন শুধু সমাধিতে নয়, তাঁর স্বদেশের বিস্মৃতির অন্ধকারেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dwarkanath Tagore Queen Victoria Friendship
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE