Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ড্রয়ারে টাকা থাকলে আর লিখি না

কল্পনা, পাণ্ডিত্য আর তুখড় রসবোধের মিশেল। এত কিছু নিয়েই আমার চাচা, সৈয়দ মুজতবা আলী। গত কাল ছিল তাঁর প্রয়াণ দিবস। সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীবাঘে মানুষ খায় এটাই সত্য। তা হলে এই বাঘে কোনও মানুষ খেয়েছিল কি না তা দিয়ে কী দরকার!’ তখন বয়স বিশের গোড়ায়। গুটি ছেড়ে মনের সবে পাখনা মেলার বয়স। কার্যত আকাশেই উড়ছি তখন, কেননা সদ্য পড়ে ফেলেছি ‘শবনম’। উপন্যাসের হাজার হাজার পাঠকের মত আমিও উদ্বেল।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বাঘে মানুষ খায় এটাই সত্য। তা হলে এই বাঘে কোনও মানুষ খেয়েছিল কি না তা দিয়ে কী দরকার!’ তখন বয়স বিশের গোড়ায়। গুটি ছেড়ে মনের সবে পাখনা মেলার বয়স। কার্যত আকাশেই উড়ছি তখন, কেননা সদ্য পড়ে ফেলেছি ‘শবনম’। উপন্যাসের হাজার হাজার পাঠকের মত আমিও উদ্বেল। তবে অন্যান্য পাঠকের যে সুযোগ নেই, আমার রয়েছে! এই আশ্চর্য প্রেমের উপন্যাসটির লেখক তো আমারই চাচা! ‘আসল’ শবনম-কথা তাঁর জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ তো সামনেই!

ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিলেন চাচা। চিরকালীন অভ্যাসমত মাথার চুলে বিলি কাটছেন। রাশভারী অথচ ‘মাই ডিয়ার’ ব্যক্তিত্ব। কাছে গিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, ‘চাচা, শবনম পড়ে শেষ করলাম। দুর্দান্ত লেগেছে। কী অপূর্ব লেখা!’ খুশি হয়ে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ!’ চাচাই আমায় শিখিয়েছিলেন, কারও লেখা ভাল লাগলে, সম্ভব হলে তাঁকে গিয়ে সেটা বলতে। তাঁর বক্তব্য ছিল, সব লেখকই প্রশংসায় খুশি হন। স্বয়ং বিশ্বকবিও নাকি খুশি হতেন তাঁর কোনও লেখা কারও ভাল লেগেছে শুনলে!

দ্বিধা কাটিয়ে এ বার আসল প্রশ্নটি পাড়লাম। ‘উপন্যাসটা পড়ে একটা কথা মাথায় ঘুরছে। শবনম নামে কোনও মহিলার সঙ্গে কাবুলে থাকার সময় কি আপনার সত্যিই পরিচয় হয়েছিল?’

এর পরেই সেই মোক্ষম মুহূর্ত। কপট রাগ দেখিয়ে চাচা পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি তো দেখছি ভারী বেরসিক হে! বাঘে মানুষ খায় এটা সত্যি তো, না কি? আমতা আমতা করে বললাম, ‘হ্যাঁ, তা তো বটেই।’ পরের প্রশ্ন, ‘তা হলে এই বাঘে মানুষ খেয়েছে কি না তা দিয়ে কম্মটা কী?’ কী আর বলব, বোকার মত মুখ করে বসে রইলাম। চাচা বললেন, ‘শোনো, যুবক যুবতী প্রেম করে সেটা যেমন সত্যি, এই গপ্পও তেমনই সত্যি! তবে তুমি যেহেতু গাড়ল তাই খোলসা করে বলছি। কাবুলে থাকাকালীন এক জন কাবুলি নারীর সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়েছিল। সে আমার বাড়ি রোজ সকালে দুধ দিয়ে যেত! তার বয়স ৮০!’ আমার বিস্ময় কাটানোর জন্যই বোধহয় আরও একটু যোগ করেছিলেন চাচা: ‘ভাতিজা, বাড়াও, বাড়াও! কল্পনাশক্তিটা আর একটু বাড়াও হে!’

তুখড় কল্পনাশক্তি। তার সঙ্গে অগাধ পাণ্ডিত্য এবং অনমনীয় জেদ। এই সব মিলিয়েই বোধহয় এক জন সৈয়দ মুজতবা আলী তৈরি হয়। শুধু চাচা নয়, এক জন শিক্ষক হিসেবেই কত কিছু যে তাঁর কাছ থেকে শিখেছি, আজ এই বয়সে এসে তার হিসেব করতে বসে কূলকিনারা পাই না। সে শিক্ষা যে সব সময় পুঁথিগত, তাও নয়। আদবকায়দা, বিভিন্ন দেশের রীতিনীতি, কী ভাবে একটা নতুন রাষ্ট্রকে চিনতে হয় সেই শিক্ষা— এক জন কূটনীতিক হিসেবে আজীবন কাজে লেগেছে আমার। এখনও লাগছে।

এমএসসি পাশ করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করার বৃত্তি পেলাম। চাচা তো মহাখুশি। দিনরাত তালিম চলল। কী ভাবে রাঁধতে হবে, কীভাবে বাথটবে গোসল করতে হবে, কী ভাবে লোকের সঙ্গে কথা বলতে হবে— সব কিছু। যদিও পিএইচডি করতে সে সময় আমেরিকা যাওয়া হয়নি, কিন্তু তাঁর তালিম কাজে লেগে গেল অন্য ভাবে। সেই বছরই পরীক্ষা দিয়ে ফরেন সার্ভিসে যোগ দিই। দু’বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে ওয়াশিংটন পাড়ি দিতে হয় সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের কাজে।

তাঁর অনেক উপদেশের মধ্যে যেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি, সেটা বাজার সংক্রান্ত! চাচা বলতেন, ‘বিশ্বের যে দেশেই যাও না কেন, সেখানকার বাজারে গিয়ে মন দিয়ে সব দেখবে শুনবে। জানবে, বাজার হল পৃথিবীর আদি সংবাদপত্র। কাবুল থেকে বার্লিন— সব জায়গার বাজারেই আমি টো-টো করে ঘুরেছি। এই সব বাজারি গল্প থেকেই কিন্তু অনেক শহরের পরিচয় পেয়েছি।’

বিদেশে বসবাস নিয়ে তাঁর আরও দুটি কথা মনে পড়ে। এক: যেখানেই যাবে, সেখানে কী পাচ্ছ না তা নিয়ে খুঁতখুঁত করবে না কদাচ। যেটা পাবে সেটাকেই নিজের মতো করে উপভোগ করবে। সে রান্নাই হোক কি আদবকায়দা। দুই, যেখানেই যাও না কেন, আগেভাগে সেখানকার সম্পর্কে একটু লেখাপড়া করে যেয়ো বাপু! তবেই সেখানকার রসটা পাবে। আর পুরোপুরি যখন এই পেশায় জড়িয়ে পড়লাম, ঠাট্টা করে বলতেন, ‘কোনও কূটনীতিককে বাইরে থেকে দেখে যদি বোঝা যায় সে খুব খুশি না বেজার, তাহলে নির্ঘাত জানবে, তার চাকরি কিন্তু টলোমলো! এটা মনে রেখো।’

চাচা তখন কলকাতায় থাকেন, মাঝে মাঝে ঢাকায় আসেন। কিন্তু বাবার সঙ্গে আমরা থাকি বিভিন্ন জেলা শহরে। তাই ভিতরে সর্বদা তাঁর সঙ্গ পাওয়ার জন্য উসখুস করলেও নিয়মিত দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। অবশেষে আমার আব্বা ১৯৫৪ সালের মাঝামাঝি জেলা সদর ছেড়ে এলেন ঢাকায়। চাচার সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ ফের শুরু হল।

তবে তাঁর সুদীর্ঘ আড্ডার আসরে সঙ্গী হওয়ার সুযোগটা আসে আরও পরে— ষাটের দশকে, যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। একটা দুটো করে প্রশ্ন করতাম তাঁকে। প্রশ্ন তো নয়, ওঁর কথা শোনার লোভে উসকে দেওয়া আর কী! বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে উত্তর দিতেন, তাঁর প্রবাদপ্রতিম রসবোধ বজায় রেখেই। এক বার ভরা মজলিশে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন কী পড়ছ?’ আমিও সাচ্চা ভাতিজা! ছাড়ব কেন? চটপট জবাব দিলাম, ‘তড়ড়ষড়মু!’ সবার গোল হয়ে যাওয়া চোখের সামনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন চাচা। শব্দ ব্যুৎপত্তি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন, তড়ড়ষড়মু মানে প্রাণীবিদ্যা!

আর এক দিন ঢাকায় তাঁকে ঘিরে এক জমজমাট আড্ডায় চাচা একটা সংস্কৃত প্রবাদ আওড়ালেন, যা সবার মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। ফলে চাচা-ই বাংলায় তরজমা করে দিলেন। ‘সিংহের মত গর্জন করে, মশার মত দংশন করে, মহিষের মত গোঁতায়। তবুও মানুষে তাকে এড়াতে পারে না, সহাবস্থান করতে বাধ্য হয়।’ কেউ যখন মাথামুন্ডু বুঝতে পারছে না, উনি বললেন, এমত প্রাণীর নাম হল ‘স্ত্রী’!

এক দিন আড্ডায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এক জন মার্সিডিজ চেপে এসেছেন। খোলা দরজা দিয়ে তাঁর গাড়িটি দেখে চাচা প্রশ্ন করলেন, ‘এই গাড়িটা যে চড়ে এলে, ভায়া বলো দেখি এর নামটি কেন মার্সিডিজ হল?’ সে বেচারা ভ্যাবাচ্যাকা। চাচা বললেন, এই গাড়ি যিনি প্রথম বানিয়েছিলেন, তাঁর মেয়ের নাম ছিল মার্সিডিজ! এ ভাবেই তাঁর কাছ থেকে জেনেছি ফিয়াট শব্দটি এসেছে, ‘ফ্যাব্রিকা ইতালিয়ানা অটোমোবিলি তুরিন’ থেকে।

যখন শুদ্ধ বাংলা বলতেন, মুগ্ধ হয়ে শুনতে হত। একটি ইংরেজি শব্দও মেশাতে দেখিনি কখনও। যখন খাস সিলেটি বলতেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলেই যেতেন, অনর্গল। আবার তাঁর ইংরেজি শুনলে মনে হত, পাক্কা সাহেবের সামনে বসে আছি। চাচার আড্ডায় যাওয়ার একটা প্রাক-শর্তও থাকত। আমার অনেক বন্ধু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইত। নিয়েও আসতাম কাউকে কাউকে। অনেকেই চোখের সামনে প্রথম বার মুজতবা আলীকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ত। চাচা এক দিন এমনই এক জনকে বললেন, ‘আমি কি বাঘ নাকি, তোমায় গিলতে যাব! আড্ডা মারতে আসার আগে কিছু পড়ে তো এসো। নইলে কথা বলব কী তোমার সঙ্গে!’ সে বেচারার তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা!

তাঁর রসালো মন্তব্যের ঝাঁপি খুললে বোধহয় শেষ হওয়ার নয়। এক বার বর্মা থেকে আনা খুব কড়া সিগারের টিন বাবাকে এনে দিয়েছি। বাবা সেটি দিয়েছেন চাচাকে। পরে চাচা আমায় বললেন, ‘তোমার আনা সিগার তো খুব টানলাম। কী যে কড়া, বাপ রে বাপ! ভাগ্যিস মোজা পরেছিলাম, তাই বাঁচোয়া। সব বেরিয়ে গিয়েছিল, মোজা দিয়ে কোনও মতে আটকে রেখেছিলাম!’

এই মানুষটাকেই দেখেছি, লেখা এবং পড়ার সময় যেন ধ্যানমগ্ন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল এক আশ্চর্য অধিকারবোধ। কবিগুরুর প্রথম মুসলিম ছাত্র ছিলেন চাচা। ওঁর কাছেই শুনেছি, প্রথম তাঁকে দেখে নাকি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ওহে, তোমার মুখ থেকে তো কমলালেবুর গন্ধ বেরোচ্ছে!’ কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত ছিল সিলেট, আর চাচার বাংলায় তখন সিলেটি টান! নিজে রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখার সমালোচনা করেছেন, সে বিষয়ে খোদ কবিগুরুকেই চিঠি লিখেছেন। কিন্তু অন্য কারও মুখে রবিঠাকুরের সামান্য সমালোচনা শুনলেও ক্ষিপ্ত হতে দেখেছি তাঁকে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই শরীর ভাঙতে শুরু করে চাচার। উদ্‌ভ্রান্ত, এবং চরম মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কলকাতায় দিন কাটাচ্ছেন। চাচি, দুই পুত্র, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের নিরাপত্তার চিন্তায় অস্থির। রাতে ঘুম নেই, অতিরিক্ত সিগারেট, মদ্যপান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাঙা শরীর নিয়ে ফিরলেন ঢাকায়। ডান হাত দিয়ে শেষ দিকে লিখতে পারতেন না। পর পর দু’বার স্ট্রোক হল।

তবে শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল তাঁর রসবোধ। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে মা ও আব্বা তাঁকে দেখতে গিয়েছেন পিজি হাসপাতালে। চাচা আমাদের কুশল জানতে চাইলেন। মা বললেন, সবই ঠিক আছে, তবে নওশেরের (আমার পুত্র) দেড় বছর হয়ে গেল এখনও চুষিকাঠি ছাড়তে পারছে না! চাচা একটু চুপ করে ভাবলেন। তার পর বললেন, ‘ভাবী, অনেক ভেবে দেখলাম, কোনও জজসাহেব, ডাক্তার, মোক্তার, আমলা, অধ্যাপক, লেখককে চুষিকাঠি মুখে তো মনে করতে পারছি না! ওরা যখন ছোটবেলার অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছেন, আমাদের নাতিও ছেড়ে দেবে!’ বলেই সেই পরিচিত অট্টহাসি।

আজ এত দিন পরেও চাচাকে নিয়ে একটা আক্ষেপ কাজ করে আমার ভিতরে। যে প্রতিভা তাঁর ছিল, তার সিকিভাগও তিনি লিখে যাননি। এই ক্ষণজন্মা অথচ বোহেমিয়ান মানুষটি নিজেই নিজেকে ঠকিয়েছেন। নিজেই লিখে গিয়েছেন, ‘হাঁড়িতে ভাত থাকলে সাঁওতাল কাজে যায় না। আর আমার ড্রয়ারে টাকা থাকলে আমি লিখি না!’

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি, আমি তখন ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত। ওখানে ভোরবেলায় ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে রোজ ‘নিউজ ব্রিফ’ আসত। এ রকমই এক ভোরে তৎকালীন প্রেস কাউন্সিলার আমার হাতে মর্মান্তিক নিউজ ব্রিফটি তুলে দিলেন। অগণিত পাঠককে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছেন সৈয়দ মুজতবা আলী।

বিয়াল্লিশ বছর পেরিয়ে গেল, চাচা আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর ‘চাচা কাহিনী’ থেকে যাবে তত দিন, যত দিন জীবিত থাকবে বাংলা ভাষা।

লেখক ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাই কমিশনার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE