মিনেসোটা থেকে বাবা-মা’র সঙ্গে সানফ্রানসিসকো আসার পর থেকেই রাইলির কী যে হয়েছে! সব সময় মুখ ভার! মেজাজ তিরিক্ষি। নতুন জায়গা, নতুন ইস্কুল, নতুন দিদিমনি, নতুন বন্ধু— কিচ্ছুটি ভাল লাগছে না। এমনকী সাধের আইস হকিও নয়। বাবা-মা খালি বলেন, আমাদের সেই হাসিখুশি রাইলি সোনাটা কোথায় গেল? আরে, মন খারাপ থাকলেও জোর করে হাসতে হবে নাকি? বাবা-মায়েরা কখনও বাচ্চাগুলোর মনের ভেতরটায় উঁকি মেরে দেখেছে, ওখানে দিনরাত কী কারবার চলছে? এই অ্যানিমেশন ছবিটায় পরিচালক রাইলির এগারো বছরের মনের অফিসঘর, মানে ‘হেড কোয়ার্টার্স’-এর অন্দরে উঁকি দিয়েছেন।
অ্যানিমেশন ছাড়া এটা ঘটানোই যেত না। এমনি কাহিনিচিত্রে কত রকম মনের ভাব নিয়ে কতশত তাত্ত্বিক কথা চালাচালি হয়। কিন্তু এখানে অনেকটা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের কন্ট্রোল রুমের মতো দেখতে একটা ঘরের মধ্যে পাঁচটা আবেগ। ‘খুশি’, ‘ভয়’, ‘রাগ’, ‘বিরক্তি’, ‘দুঃখ’। সবাই মিলে একটা কন্ট্রোল প্যানেলের হাতল-বোতাম টেনে-টিপে রাইলিকে হাসাচ্ছে, রাগাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে, বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে দিচ্ছে, বা কষ্ট দিয়ে কাঁদিয়ে ভাসাচ্ছে। বাঁধনছাড়া কল্পনার হিস্টিরিয়া ছাড়া এটা ভেবেই ওঠা যায় না। ছবির গপ্প থেকে শুরু করে প্রোডাকশন ডিজাইন, সবটাই যেন এক মস্ত খোলা আকাশ। পরিচালকের কল্পনা যেখানে যেমন খুশি ডানা মেলেছে। রাইলির মগজ-অফিসে ‘খুশি’ বা ‘জয়’ই হল আসলি বস। ঝলমলে হলুদ রঙের ফ্রক পরে সে গোটা অফিস দাপিয়ে বেড়ায়। সে চায়, রাইলি সব সময় ফুর্তিতে থাকুক। ঘ্যানঘেনে একঘেয়ে সুরে কথা বলা, কেঁদে গড়িয়ে যাওয়া, বেঢপ সাইজের চশমা পরা নীলচে ‘দুঃখ’ যেন তাকে ছুঁতে না পারে। ‘দুঃখ’ মেয়েটার হাতের ছোঁয়া লাগলেই তো রাইলির মগজের র্যাকে থরে থরে সাজানো সোনালি স্মৃতির বলগুলোতেও কালচে নীল ছোপ পড়ে যায়। ‘খুশি’ তাই ‘দুঃখ’কে কন্ট্রোল প্যানেলের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না! সবজেটে ‘বিরক্তি’ আর মাথা দিয়ে আগুন ছিটকোনো টকটকে লাল ‘রাগ’-কেও সামলে রাখে।
কিন্তু সেটা কি সব সময় সম্ভব? এই তো মিনেসোটা ছেড়ে আসার পথে রাইলির মন ভাল করতেই খুশি তার কল্পনার স্টেশনে একটা স্বপ্নের ঝুড়ি এঁকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। রাইলির মুখে একটু হাসিও ফুটেছিল। কিন্তু সানফ্রানসিসকোয় তাদের আসল বাড়িটার সঙ্গে কল্পনার ছবিটা যেই মিলল না, অমনি কন্ট্রোলে ‘রাগ’ আর ‘বিরক্তি’র সে কী দাপাদাপি! আসলে এটাই তো ছবিটা বলতে চাইছে। জোরজার করে মনটাকে খুশি রাখতে চাইলেই তো হবে না! এগারো বছরের একটা মেয়ের মনের ভেতর কত রকম আবেগের মেঘ-রোদ্দুর। সব্বাইকেই তো কমবেশি কনসোল-এ বসতে দিতে হবে! রাইলির মা-বাবাও এই খেলাটার বাইরে নন। বাবার মগজের ভেতর আবেগগুলো গোঁফওয়ালা হুমদো। মায়েরগুলো চশমা-আঁটা গোমড়া। তিন জনের পনেরোটা আবেগ ‘হেড কোয়ার্টার্স’-এ কিচিরমিচির করছে, এ দিকে খাওয়ার টেবিলে রাইলি আর বাবা-মায়ের মধ্যে তক্কাতক্কি চলছে— দুর্দান্ত মজা।
রাইলির মনে, চক দিয়ে একটা গণ্ডি এঁকে ‘খুশি’ ‘দুঃখ’কে তার ভেতরে আটকে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সে কেবলই বেরিয়ে পড়ে। তাকে ঠেকাতে গিয়ে দুজনের ধস্তাধস্তি। তারই চোটে ‘খুশি’ আর ‘দুঃখ’ দুজনে বাতিল স্মৃতির গর্তে পড়ে যায়। ও দিকে কন্ট্রোল-প্যানেল সামলাতে গিয়ে ‘রাগ’, ‘বিরক্তি’ আর ‘ভয়’ সব ঘেঁটে ফেলে। ‘রাগ’-এর এক ভুলভাল আইডিয়ার ধাক্কায় রাইলি বাড়ি ছেড়ে মিনেসোটার পথে রওনা হয়ে যায়। শেষ অবধি ‘খুশি’র অনুরোধেই ‘দুঃখ’ কন্ট্রোল-এ বসে সবটা সামাল দেয়। ‘খুশি’ বুঝে যায়, শুধু সে-ই জরুরি নয়, মনের মধ্যে ‘দুঃখ’-কেও তার জায়গাটুকু দিতেই হবে।
sanajkol@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy