ছবি: কুনাল বর্মণ
ইদানীং কি আপনি কম কথা বলছেন? গলা তোলার আগে এ দিক-ও দিক তাকিয়ে নেন চট করে?
নিজের বক্তব্য ফেসবুকে পোস্ট করার কয়েক সেকেন্ড পরে ডিলিট করে দিয়েছেন কখনও?
টিভি দেখে, কাগজ খুলে কি মনে হচ্ছে, যা ঘটছে তা লেখা হয়নি, আর যা লেখা হয়েছে তা ঘটেনি মোটেই?
তা হলে আর এক বার পড়ে ফেলুন জর্জ অরওয়েলের ‘নাইন্টিন এইট্টি ফোর।’ এ বছরের গোড়ায় ‘অ্যামাজন’-এর বেস্ট সেলার তালিকায় টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে এক নম্বরে ছিল বইটা, নতুন করে পঁচাত্তর হাজার কপি প্রিন্ট অর্ডার গিয়েছে।
কেন? কারণ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঠোকাঠুকিতে স্ফুলিঙ্গের মতো প্রশ্ন ছিটকে উঠছে, ‘এর মানে কী? কী মানে এর?’ এ বই হল সেই খোঁজ। চাপা ছটফটানি থেকে মুক্তি খোঁজার চেষ্টা।
আটষট্টি বছর আগের বই আজও উত্তর জোগাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত লন্ডনে বসে অরওয়েল যে উপন্যাস লিখেছেন— যেখানে রাষ্ট্রের চেহারায় স্তালিনের পার্টিসর্বস্ব সোভিয়েত রাশিয়ার ছাপ স্পষ্ট, যেখানে ‘বিগ ব্রাদার’ নেতা প্রতি মুহূর্তে নজর রাখে বুদ্ধিজীবী নাগরিকদের উপর, আর মদ-জুয়া-পর্নোগ্রাফি দিয়ে ভুলিয়ে রাখে আমজনতাকে— তা আবার আমাদের গল্প হয়ে উঠেছে। আজকের মার্কিন মুলুক আর ভারতকে বুঝতে ফিরে যেতে হচ্ছে অরওয়েলের ‘ওশেনিয়া’-তে।
গল্পের শুরু ওশেনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর লন্ডনে, এপ্রিলের এক শীতল সকালে, যখন সব ঘড়িতে তেরোটা বাজছে। (সে দেশে ভাষা নিয়ন্ত্রণ করে ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, একই কথার দু’রকম মানে করা চলে না। তাই দুপুর একটার জন্য তেরোটা ঘণ্টা বরাদ্দ)। গল্পের প্রধান চরিত্র উইনস্টন স্মিথ সাত তলায় নিজের ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উঠছে (লিফ্ট খারাপ), গোটা বাড়িতে সেদ্ধ বাঁধাকপির গন্ধ। আর প্রতিটি তলায় সাঁটা পোস্টারে মস্ত এক মুখ। নীচে লেখা, ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ।’ ঘরে ঘরে লাগানো ‘টেলিস্ক্রিন’, যা ছবি দেখায়, আবার প্রতিটি বাসিন্দার মুখের অভিব্যক্তি, ফিসফিস কথা, সব ধরে ফেলে। কখন কাকে দেখছে ‘থট পুলিশ’, কে জানে? টেলিস্ক্রিন আড়াল করে একটা সাদা খাতা খোলে উইনস্টন। লুকিয়ে লেখা অপরাধ, শাস্তি অন্তত পঁচিশ বছর লেবার ক্যাম্প। তবু সে লেখা শুরু করে, ‘এপ্রিল ৪, ১৯৮৪।’
যত গল্প এগোয়, তত দমবন্ধ-করা আতঙ্ক চেপে বসতে থাকে। উইনস্টন প্রেমে পড়ে জুলিয়ার, পার্টির নজর এড়িয়ে দুজনে মিলিত হয় নানা জায়গায়। বিগ ব্রাদারকে হঠানোর ষড়যন্ত্রে শামিল হয়। এক দিন দেওয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে পুলিশ। পার্টি ইলেকট্রিক শক দিয়ে ফের ‘শিক্ষিত’ করে উইনস্টনকে, তার ‘পাগলামি’ সারায়।
সত্যি বলতে কী, নাগরিকের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের এই ছবিটা বেশ চড়া ধরনের। নিরানন্দ, একঘেয়ে, পার্টিসর্বস্ব জীবনে সকলে ভয়ে বশ্যতা স্বীকার করেছে, এমন উত্তর কোরিয়া ধাঁচের শাসন আজ বিশেষ নেই। কিন্তু যেখানে ‘চয়েস’-এর ইয়ত্তা নেই সেখানেও জীবন বিকল্পহীন, যেখানে ‘ফ্রি মিডিয়া’ সেখানেও আছে সেন্সরশিপ।
অরওয়েলের কাছে তাই ফিরতে হয় অবরুদ্ধ জীবন-যন্ত্রণার সান্ত্বনা খুঁজতে। উইনস্টন স্মিথ বিপ্লবী নয়, শিল্পী-বিজ্ঞানী-পণ্ডিত কিছুই নয় সে। কিন্তু সত্যিটা জানা, আর নিজের কথাটা বলার ইচ্ছে এই সাধারণ যুবকটি কিছুতেই উপড়ে ফেলতে পারে না। এখানেই তার কষ্টের সঙ্গে আমাদের যোগ।
সেই যোগ ফের টের পাওয়া যাচ্ছে। এসেছেন নতুন সব বিগ ব্রাদার। যাঁরা মিথ্যেকে সত্যি করেন হেলায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করলেন তাঁর শপথে ঐতিহাসিক ভিড়, ক্যামেরা দেখাল ফাঁকা জমি। ট্রাম্পের মুখপাত্র বললেন, প্রেসিডেন্ট-বাক্য ‘বিকল্প সত্য।’ ভারতে ইতিহাস পাঠ্যে লেখা হল রানা প্রতাপ হারিয়েছিলেন আকবর বাদশাকে। অরওয়েল-এর ‘মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ’ এই ভাবেই ক্রমাগত বদলাত বই, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন। সত্যিটা কী, মনে রাখার উপায়টাই শেষ হয়ে যেত। নিরন্তর নজরদারিও ফিরছে। এডওয়ার্ড স্নোডেন যখন ফাঁস করেছিলেন কী বিপুল আকারে মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থা গোপনে তথ্য রাখছে নিজের নাগরিকদের, রাতারাতি বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’ বইয়ের। ‘বিগ ব্রাদার,’ ‘থট পুলিশ’, ‘ডাবলথিংক’ শব্দগুলো ইংরেজির বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
আর একটা শব্দ ভারী লাগসই। ‘ভার্সিফিকেটর।’ এমন যন্ত্র, যা তৈরি করে গান-কবিতা। সেগুলো অর্থহীন শব্দের সারি, কিন্তু দারুণ জনপ্রিয়। আজকাল কিছু ঘটতে না-ঘটতে কারা যেন কবিতা, গান লিখে ফেলে— যাতে বেজায় প্রতিবাদী ঝাঁঝ, অথচ কার সপক্ষে কার বিপক্ষে তার মাথামুন্ডু খুঁজে পাওয়া যায় না— তারা যন্ত্র নয় তো? নাকি মানুষ ‘ভার্সিফাই’ করতে পারে, জর্জ অরওয়েল ভাবতেও পারেননি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy