Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

বাচ্চাটাকে বাঁধো, সাহেব কুমির মারবে

বাঘ শিকারের জন্য এস্টেটের কর্মীর ছেলেকে কপিকলে বেঁধে বনে নামিয়ে দিচ্ছেন রাজবাহাদুর— আছে বিখ্যাত বাংলা ছোটগল্পে। উনিশ শতকে হিংস্র পশু শিকারের জন্য জ্যান্ত মানবশিশুর ব্যবহার মোটেই বিরল ছিল না। বাঘ শিকারের জন্য এস্টেটের কর্মীর ছেলেকে কপিকলে বেঁধে বনে নামিয়ে দিচ্ছেন রাজবাহাদুর— আছে বিখ্যাত বাংলা ছোটগল্পে। উনিশ শতকে হিংস্র পশু শিকারের জন্য জ্যান্ত মানবশিশুর ব্যবহার মোটেই বিরল ছিল না।

টোপ: হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে শিশু, পিছনে কুমির। অদূরে বন্দুক হাতে সাহেব। উনিশ শতকে এমন ঘটনা ঘটত প্রায়ই

টোপ: হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে শিশু, পিছনে কুমির। অদূরে বন্দুক হাতে সাহেব। উনিশ শতকে এমন ঘটনা ঘটত প্রায়ই

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

লতাপাতা সরালেই দেখা দেয় পাঁচতারা বনবাংলো। তার ঘরে স্বর্গ আর বারান্দায় মৃত্যু। নীচে তরাইয়ের প্রাচীন অরণ্য, চকচকে পার্বত্য স্রোতস্বিনী। সুন্দর, ভয়ংকর। চারশো ফুট নীচের সেই খাদে মানুষ পৌঁছতে পারে না, তাই লেজ আছড়ে ঘোরে ডোরাকাটা বাঘ, হায়েনা। চাতালের ওপর থেকেই বন্দুক দিয়ে সেই নিবিড় অরণ্যে প্রকাণ্ড রয়্যাল বেঙ্গল মারতেন রামগঙ্গা এস্টেটের রাজবাহাদুর। ঠান্ডা হুইস্কিতে গলা ভিজিয়ে, বন্দুকের মাছিতে চোখ রেখে, তেরচা ক্রূর হাসতেন। কারণ, শিকার ফাঁদে পড়বেই। তাকে ডাকতেই তো কপিকলে বেঁধে নামিয়ে দিচ্ছেন হিন্দুস্তানি ‘কিপার’-এর জীবন্ত সন্তান। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’ গল্পের শেষে এই বুনো সত্য-ফাঁসে, খোদ পাঠকের বুকে চিরকালের জন্য ঢুকে যায় রাজামশাইয়েরই সংগৃহীত একখানি ক্ষুরধার নেপালি ভোজালি।

সেই কষ্টই এক্ষুনি চাগিয়ে উঠবে যদি জানা যায়, এই উপনিবেশে হিংস্র পশু শিকারের জন্য জ্যান্ত শিশুর ব্যবহার বিরল ছিল না। প্রবর্তক? ব্রিটিশরাজ! উনিশ শতকের শেষ থেকে শুরু। তত দিনে সাহেবরা প্রায় নিশ্চিত, এখানে তাঁরা গায়ের চামড়ার অধিকারে দলন করতে এসেছেন। অনেকেরই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের নদীনালা, বনানী। এও তো কম সম্পদ নয়। এত ঘড়িয়াল, বনগরু (বাইসন), চিতল হরিণ, কৃষ্ণসার, সম্বর, বাঘ, সিংহ ঘুরছে। সেগুলোও তো লুণ্ঠন করা চাই। স্যাঙাত হিসেবে জুটল দেশি রাজারা। দু’পক্ষেরই ভারী খুন আর শিকারের নেশা। সে ছেলেমানুষ হোক, বা মেয়েমানুষ, কিংবা পশু। তাঁবুর ছায়ায়, আরামকেদারায়, মদিরার পাত্রের ঠোকাঠুকির সঙ্গে এ অন্যের বদগুণগুলো অদলাবদলি করে নিলেন। গোরা সাহেব হাওদায় বসে হেলেদুলে মৃগয়ার রীতি রপ্ত করলেন। আয়েশি রাজদুলালরাও কম যান না।

কিছুটা লেখা আছে পাশ্চাত্যের নানা সংবাদপত্রে। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বা ‘টাইমস’-এর মতো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত, ফ্লোরিডার হ্রদের কুমিরগুলো মারতে মোটাসোটা নিগ্রো বাচ্চা ব্যবহৃত হচ্ছে। রাঙামুখো সাহেবদের কেমন বদ্ধমূল ধারণা ছিল, আফ্রো-আমেরিকান কালোকুলো বাচ্চা দেখলে ছাপছোপওয়ালা কুচকুচে কুমিরগুলো ছুটে আসে। এই বিশ্বাস নিয়েই তাঁরা গেলেন আফ্রিকা। গেলেন সিংহল। ১৮৮৮ সালে লন্ডনের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দ্য গ্রাফিক’ তিনটি আশ্চর্য ছবি ছাপে। তোলা নয়, আঁকা ছবি। নীচে লেখা: ‘স্পোর্ট ইন সিলোন— শুটিং ম্যানইটিং ক্রোকোডাইল।’ প্রথম ছবিতে এক ইওরোপীয়কে দেখা যাচ্ছে সৈকত এলাকায়। একটু ঝুঁকে কাদামাটিতে কুমিরের ছাপ মাপছেন। কত লম্বা হতে পারে জানোয়ারটা? দ্বিতীয় ছবিতে তাঁকে স্থানীয়দের থেকে শিশু ভাড়া করতে দেখা যাচ্ছে। তিন-চারটে বাচ্চা তাঁর সামনে। সাহেবের ভঙ্গিতে বোঝা যায়, দর কষছেন। তিন নম্বর ছবিতে বাচ্চাটা হামাগুড়ি দিয়ে জল থেকে ডাঙার দিকে উঠে আসছে, চোখ বিস্ফারিত। পিছনে ভীষণ মুখব্যাদান করে বাচ্চাটাকে সড়সড়িয়ে ধাওয়া করছে অতিকায় কুমির। এক ধারে ডালপালার আড়ালে বন্দুকের নল নিয়ে তৈরি শিকারি। এর পরে ঠিক কী হয় সেই ছবি নেই। তবে প্রতিবেদনে লেখা, সাহেবরা বেছে বেছে হৃষ্টপুষ্ট, ছিঁচকাঁদুনে শিশুকেই টোপ করতেন। শিশুদের কান্না শুনলে নাকি পশুরা হানা দেয়?

রামসেতু পেরিয়ে এই অভ্যেস ভারতে ঢোকায় ইংরেজ। দক্ষিণ থেকে পাপের বোঝা বয়ে আনে উত্তর ভারতে। উত্তর পূর্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত অনাহারক্লিষ্ট জঙ্গলে। সে সময় সেখানে কত শিশু হারিয়েছে, কত জনকে অপহরণ করা হয়েছে তা নিয়ে আজও তর্ক চলে। ব্রিটিশ জমানার পুলিশ এ সব অভিযোগে বরাবরই আমল দেয়নি। তবে বিশ শতকের প্রথমের দিকের কাগজেও বেরিয়েই চলেছে শিশু-টোপের গপ্প। বেশ ব়ড়, আট-দশ বছরের বাচ্চাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে জন্তু শিকার চলছে, এমন ‘কার্টুন’ও বেরিয়েছে। এ নিয়ে বাঁধা হয়েছে গানও। ইংরেজি সে গানের বাংলা তরজমা অনেকটা এ রকম— ‘মায়ের কোলের ছোট্ট সোনা, কুমির খাবে চারাপোনা।’ এ সময়ের সংবাদপত্রে শিকারের জন্য শিশু চেয়ে বিজ্ঞাপনও বেরত। পূর্ণবয়স্ক মানুষকে ফাঁদে আটকে খেলা চলেছে, সে দৃষ্টান্তও মেলে।

ব্রিটিশ সৈন্যের এক অফিসার ফলাও করে লিখেছেন, ভারতে গিয়ে কী ভাবে হিন্দু বাচ্চাদের টোপ হিসাবে ব্যবহার করতেন। এই বাচ্চারা ভাত খায়, তাই নধরকান্তি। অফিসারের বয়ান, শিশুকে টোপ হিসাবে দিতে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত জনজাতিগুলির মধ্যে। মা-বাবারা খুশিমনেই দিন প্রতি ছয় সেন্টে দুধের শিশুকে বনে দিয়ে আসতেন। সাহেবের টিপের প্রতি যে তাঁদের অটল বিশ্বাস ছিল, তা ঠিক নয়। বাচ্চা না ফিরলেও তাঁদের নাকি খুব অসুবিধা ছিল না।

তা দেশি মা-বাপরা কি এত বোঝে? অতগুলো পেটের দানা জোগাতে দুপুরে কচিটাকে হুজুরের আর্দালির কাছে দিয়ে আসত। সে ফিরলে তারই রোজগারের শিলিং-সেন্টে সে দুধভাত পেত। সন্ধে গড়ালে ঝুপড়িতে গেলে দেখা যেত, বাঘ-কুমিরের গ্রাস থেকে ফিরে এ বার খিদের মুখে পড়ে বাচ্চাটা কেমন হাত-পা ছুড়ছে। ওই রকমই কান ফাটিয়ে বন জাগাতে পারলে পর দিন আবার টোপ হতে যেতে পারবে সে।

ব্রিটিশ আর্মির সেই নায়ক-অফিসার তো বলেছেন, শের হোক বা কামট, নরখাদকের মুখে ছুড়ে দিলে শিশুমনের কিচ্ছুটি বিকার হয় না। ওদের তো ভয়ের চেতনাই তখনও জন্মায় না। তবে, খবর কাগজের ছবিটিতে বাচ্চাটার চোখ ও ভাবে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কেন? সাহেবের সাফাই, সে তো রাইফেল শটের আওয়াজে। কানের পরদায় যত জোর লাগবে, তত পরিত্রাহি চেঁচাবে বাচ্চা। শিকারের সুবর্ণ সুযোগ।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনিটিতেও যে এই ধরনেরই কোনও নৃশংসতার ছায়া ঘনিয়েছে, তার কোনও ঐতিহাসিক দলিল নেই। কিন্তু লেখকের ছেলেবেলা ও পরিপার্শ্বের দিকে নজর দিলে সন্দেহ ঝেড়ে ফেলা যায় না। তিনি কুড়ির দশকে বাংলাদেশের দিনাজপুরে বড় হয়েছেন। জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলের ভীমপ্রতাপ রয়্যাল এস্টেটগুলি সেখান থেকে গরুর গাড়ি চেপেই যাওয়া যেত। গেঁয়ো শিশুর মাথায় আপেল বসিয়ে টিপ অনুশীলনের ছবিটা তখনও পুরনো হয়নি। ও দিকে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলের বড়-বুড়োদের মুখে কিন্তু আজও রূপকথা ওই চত্বরের রাজামশাইরা। তাঁদের সাহেবি কেতা, অব্যর্থ নিশানাবাজি, বাজবহেরীর খ্যাতি এবং তারই সঙ্গে সাহিত্য-পৃষ্ঠপোষকতার কাহিনি কালাপানি ছাড়িয়েছিল। পরে বৃদ্ধ বয়সে তাঁরা নিজেরাও বিলেতে গিয়ে সুখে দিন কাটিয়েছেন। স্বাধীনতার আগে-পরে রাজত্ব লোপ পেলেই বা কি? দাপট তো আর যায় না। তা হলে, নখ-দাঁত ভোঁতা হওয়া-মাত্র লক্ষ টাকার ফরাস-জাজিম, খানসামার খাসমহলা ছেড়ে হঠাৎ সাত-সমুদ্দুর পাড়ের কোনও তেপান্তরের লন কিংবা কোনও বিদেশি নিশ্চিন্দিপুরের নিশ্চিন্তিতে গা ডুবোতেন কেন তাঁরা? নাকি গা-ঢাকা দিতেন? অতীতের কোনও বাঘের বাচ্চার নাগাল এড়ানোর প্রচেষ্টা? কেউ জবাব দেয় না। শুধু কানাঘুষো শোনা যায়, গদিতে বসার দিনে প্রজারা এই নবাব-সাহেবদের যম মানত। এঁদের অনেকেই আক্ষরিক অর্থে দুরাচারী। স্থানীয় ভাষায়, মানুষের ছাল ছাড়ানো জুতো পরতেন। মুখে রিভলভার পুরে সাক্ষীকে, গলা অব্দি টাকার তোড়া ঠেসে পুলিশকে নিজের ইচ্ছের দাস বানাতেন। ঘোর ঘেন্না করতেন স্বদেশিদের। আতঙ্কেই সে অত্যাচার লিখতে কারও কলম সরেনি। অন্য দিকে নথি বলছে, সরকারি নির্দেশে অরণ্য অভয়ারণ্য হওয়ার আগে এই তল্লাটেরই এক মহারাজা শুধু বাঘই মেরেছেন চারশোর মতো। আর তাঁর অতিথি সাহেবসুবোরা? অসংখ্য। মধ্যপ্রদেশের এক প্রাতঃস্মরণীয়ের বুলেটে বাঘের রেকর্ড প্রায় বারোশো। বারাশিঙা, মৃগনাভি— অন্য দুর্লভ পশুর অপ্রিয় প্রসঙ্গ না হয় বাদই থাক। কিন্তু এরা সবাই কি শুধু বারুদের গন্ধেই ধরা দিয়েছিল? সে বিষয়টিও থাক। তবে, এই সব শোনা কথা ও ইতিহাসের পঞ্জি মিলিয়ে দেখলে, বন্দুকপ্রিয়, কবিমানুষপ্রেমী এবং ম্যানিলা চুরুট ফোঁকা রাজবাহাদুরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক সমসাময়িক ইতিহাসবিখ্যাত শিকারি-রাজচক্রবর্তীকে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। এন আর চৌধুরী— নামের আদ্যক্ষর সামান্য বদলে কি কারও প্রতি ইঙ্গিত রেখে গেলেন লেখক?

নাকি ‘টোপ’ শুধুই একটি গল্প? উত্তর জানতে কান পাততে হবে তরাই জঙ্গলের বুকে। চোখ মেলে দেখতে হবে কোচ-রাজবংশীদের লোকোৎসব। যেখানে মুখোশ পরে ওঁরা বাঘ-মানুষ নাচ দেখান। আজ শুধু এটুকু ভেবে নেওয়া যাক, সে দিন যে শিশুটিকে কপিকলে করে শ্বাপদের মুখে নামিয়ে দিয়েছিলেন মহারাজাধিরাজ, রক্তের খিদেতে নয়, নেহাত কৌতূহল বশে মুখ নামিয়ে তাকে দেখতে এসে মরেছিল সেই বাঘবাহাদুর। রাজার লোক কপিকলের সুতো গুটিয়ে বাঘের শব তুলে আনার পর, অরণ্যই বড় করে তুলে এক দিন ফিরিয়ে দিয়েছিল সেই শিশুকে।

সাহেবসুবোই হোক কি এ দেশীয় রাজারাজড়া, শিকার করতে গিয়ে কেউ কৃষ্ণাঙ্গ, কেউবা ‘নেটিভ’ মানুষের জীবন নিয়ে লোফালুফি করেছে অক্লেশে। এদের পাশে কৃষ্ণসার শিকার করা সলমন খানকে নিতান্ত নিরীহ মনে হয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tiger hunting Children Tiger
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE