Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মানুষের মুক্তির পথই খুঁজে গিয়েছেন তিনি

ফুসফুসের রোগ নয়। দারিদ্র নয়। দেশছাড়া হওয়াও নয়। তাঁর যন্ত্রণা শুধু একটা প্রশ্নকে ঘিরে। কোন পথে আসবে মানুষের মুক্তি? কী ভাবে গড়ে তোলা যাবে তাঁর স্বপ্নের সমাজ? গত শুক্রবার ২০০ বছরে পা দিলেন কার্ল মার্ক্স। লিখছেন কুমার রানাফুসফুসের রোগ নয়। দারিদ্র নয়। দেশছাড়া হওয়াও নয়। তাঁর যন্ত্রণা শুধু একটা প্রশ্নকে ঘিরে। কোন পথে আসবে মানুষের মুক্তি? কী ভাবে গড়ে তোলা যাবে তাঁর স্বপ্নের সমাজ? গত শুক্রবার ২০০ বছরে পা দিলেন কার্ল মার্ক্স। লিখছেন কুমার রানা

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৭ ১০:০০
Share: Save:

‘আমার জীবন-জোড়া বিপুল সংঘাত-দ্বন্দ্ব, এবং স্বপ্নের মেলা

রফা বা আপোস নয়, স্রোতে ভাসা লোকেদের দলে আমি নেই।’

কী হত, যদি আঠারো বছরের এই কবি কবিতার খাতাগুলো নষ্ট করে দিয়ে কাঠখোট্টা সমাজবিজ্ঞানে চলে না যেতেন? অথবা, যদি তাঁর সমকালীন পৃথিবীতে যেমনটা স্বাভাবিক ছিল, প্রতি দশ জনে তিন জন শিশুর পাঁচ বছর বয়সে পৌঁছনোর আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া, তাঁর বেলাও যদি তাই হত? কিংবা যদি প্লুরিসির কারণে সদ্যযৌবনে বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদান থেকে ছাড় না পেতেন? অথবা বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী উকিল বা সরকারি চাকুরে হতেন? অথবা তাঁর সমসাময়িক, ডারউইন বা ডিকেন্স-এর মতো অন্য ভাবে খ্যাতিমান হতেন? আর কিছু না হোক, বিশ্বের তাবৎ ধনাঢ্যরা হয়তো শান্তিতে ঘুমোতে পারত। চৌষট্টি বছরের জীবনে তেমন পরিচিতি না পাওয়া এই মানুষটি পৃথিবীর বিত্তশালীদের কাছে যেন এক জীবন্ত দুঃস্বপ্ন, তাঁর নামটাই এখনও তাদের কাছে ত্রাস।

স্রোতে গা ভাসিয়ে না দেওয়ার প্রতিজ্ঞাটা যৌবনোদ্গমের অবধারিত আবেগ যে ছিল না, সেটা প্রমাণিত। এমনকী যাঁরা তাঁর নামটুকুও সহ্য করতে পারে না, তাঁরাও স্বীকার করেন, তিনি ছিলেন একেবারেই ভিন্ন ধারার মানুষ, যেমনটা তাঁর পিছনে লাগা পুলিশও বড়কর্তাদের জানিয়েছিল। আবার, বিপন্ন সময়ে, যেমন ২০০৭-৮ সালে বিশ্ব-অর্থব্যবস্থার সংকটের কালে সেই ধনিকশ্রেণিও তাঁর শরণ নেয়, তাত্ত্বিক দিশার জন্য। বস্তুত, ‘কী হত’-র উত্তরটা বিত্ত-ক্ষমতাবানদের ভয় ও ঘৃণা ছাড়িয়ে গোটা মানবসমাজে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। এমনকী রাশিয়া, চিন এবং অন্যত্র তাঁর উদ্ভাবিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগগুলো বিপরীত গতিপ্রাপ্ত হওয়ার পরও তা সত্য। এই ‘ব্যর্থতা’-য় ব্যক্তিস্বার্থকে সামাজিক স্বার্থের উপরে স্থান দেওয়া ধনতান্ত্রিক সমাজের উৎফুল্ল হওয়ার যত কারণই থাক, বিশ্ব আজ যে তত্ত্ব ও মতাদর্শগত সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ১৮১৮-র ৫ মে জন্ম নেওয়া এই মানুষটির দেখানো পথ ও বিশ্লেষণ-পদ্ধতি সমান বা অধিকতর প্রাসঙ্গিক। প্রমাণ, গত এক দশকে তাঁর লেখা বইপত্রের বিপুল পুনর্মুদ্রণ, অপ্রকাশিত বহু কৃতির প্রকাশ এবং সেগুলো নিয়ে বিদ্যাচর্চার জগতে গভীর আগ্রহী আলোচনা। আবার, সমাজতন্ত্রের আপাত ব্যর্থতার কারণগুলোও জানবার জন্য যেতে হচ্ছে সেই মানুষটির কাছে— তাঁর রেখে যাওয়া হাজার-হাজার পাতা পাণ্ডুলিপি, খসড়া, চিঠিপত্র এবং নানা টুকরো পাঠ-লিপিগুলো বিশ্ববিদ্যাচর্চাকে নতুন করে আলোকিত করছে। নানা ভাবে বিশ্লেষিত হচ্ছে তাঁর জীবন— বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেধাজীবীদের অনুসন্ধানে। সদ্যপ্রকাশিত গ্যারেথ স্টেডম্যান জোনস-এর লেখা, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত জীবনী নবতম, কিন্তু শেষ সংযোজন নয়। তাঁর বিদ্যাচর্চা ছিল মহাসাগরীয়; সেগুলোর সূত্র ধরে বহু আলোচনা বাকি। আবার, পুনঃপ্রকাশিত হচ্ছে তাঁকে নিয়ে ধ্রুপদী পণ্ডিতদের লেখা কৃতিগুলো, যেমন ১৯৩৯-এ বেরনো আইসাইয়া বার্লিনের লেখা জীবনী। অন্যদের, যেমন র‌্যাচেল হোমস-এর লেখা তাঁর ছোট মেয়ে এলিয়নর-এর জীবনী থেকেও তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে অন্য ভাবে।

তাঁর বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে ‘মানুষই তার ইতিহাস গড়ে, কিন্তু সেটা সে যে ভাবে চায় সে ভাবে গড়তে পারে না... তাকে তা গড়তে হয় বিদ্যমান— অতীত থেকে প্রবাহিত— পরিমণ্ডলের মধ্যেই।’ তাঁর নিজের নির্মাণটাও তাই। তাঁর জন্ম ট্রিয়ের শহরে; জন্মের মাত্র তিন বছর আগেই তা ফ্রান্সের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়েছে, ওয়াটারলুতে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর। আবার তাঁর জন্মের মাত্র তিন দশক আগেই ঘটেছে ফরাসি বিপ্লব। সারা ইউরোপ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা। জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একনায়কতন্ত্রী শাসন। তাঁর পারিবারিক পৃষ্ঠভূমিও জটিল। ঠাকুরদা ছিলেন ইহুদি পুরোহিত— রাব্বাই, জ্যাঠাও। রাজনৈতিক চাপে বাবা ও পরিবারের অন্যান্যদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে হয়। আবার মা ছিলেন ওলন্দাজ-ইহুদি। নয় ভাই-বোনের পাঁচ জনেরই মৃত্যু পঁচিশ বছর বয়সের আগে। কুড়ি বছর বয়সে বাবাকে হারান। বাবা জানতেন এই ছেলে ‘অসামান্য প্রতিভাবান’। তাই পেশাগত সাফল্য খোঁজার পারিবারিক দাবি। কিন্তু, তিনি তো স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির উপাসক। কান্ট-ভলতেয়ারের অনুরাগী বাবার ছায়া, ফ্রিডরিখ উইলহেল্‌ম জিমনাসিয়াম নামক যে স্কুলে বারো বছর বয়সে তাঁর প্রথাগত শিক্ষার শুরু, তার উদারমনস্ক হেডমাস্টারের প্রভাব, গ্রিক-ল্যাটিন চর্চা, পিতৃবন্ধু, এবং নিজের ভাবী শ্বশুরের কাছ থেকে শেক্‌সপিয়র-গ্যেটের পাঠ, এবং তৎকালীন পরিমণ্ডলে তাঁর বেড়ে ওঠা। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে হেগেল-এর দ্বন্দ্বতত্ত্বের সংস্পর্শ, যার দ্বারা তিনি প্রভাবিত, আবার যাকে অতিক্রমও করছেন। গবেষণার জন্য বেছে নিচ্ছেন গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস-এর কাজ। সেই সূত্র ধরে অ্যারিস্টটল, প্লেটো, বস্তুত গোটা ইউরোপীয় দর্শনে ব্যুৎপত্তি। এই ভিত্তি থেকে এক দিকে যেমন তাঁর মধ্যে বিকশিত হয়ে ওঠে মানুষের প্রতি অবিচ্ছেদ্য টান, তেমনই অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে এক প্রশ্নবাচী মন। স্কুলে ‘পেশা বেছে নেওয়া’ নিয়ে লেখা প্রবন্ধের ছত্রে ছত্রে পরহিত ব্রত: ‘মানুষের প্রথম এবং প্রধান কাজ হল অন্যদের জন্য কিছু করা।’ সেই সঙ্গে, ‘মানুষের উত্তরোত্তর পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া।’ এই পরিপূর্ণতার প্রতি ঝোঁকের কারণে তাঁর পৃথিবী বদলে দেওয়া বইটা বেরলো ১৮৬৭-তে, পরিকল্পিত তারিখের দু’দশক পর। বার্লিন লিখছেন, ‘তিনি নিখুঁত বিদ্যাচর্চায় বিশ্বাস করতেন।’ করতেন বলেই, কোনও কাজে ফাঁকি ছিল না—– তা সে গভীর দর্শনের আলোচনা, ঐতিহাসিক অনুসন্ধান বা বর্ণনা, কিংবা সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লেখাই হোক। জীবনের প্রায় শেষ চার দশক কেটেছে লন্ডন শহরে, ছাড়তে হয়েছে স্বভূমি; বিতাড়িত হয়েছেন ফ্রান্স, বেলজিয়ামের মতো দেশ থেকে। স্থায়ী রোজগার ছিল না, লেখালেখি করে, মায়ের উত্তরাধিকার থেকে পাওয়া অর্থে, এবং সারা জীবনের বন্ধু ও সহকর্মী ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস-এর নিরন্তর সাহায্যে সংসার চালিয়েছেন। বন্ধুর নাম তাঁর নামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য।

নিদারুণ দারিদ্র, পাওনাদারদের তাগাদা, সাত সন্তানের মধ্যে চার জনেরই শৈশবে প্রাণ হারানো, নিজের অসুস্থতা— ভয়াবহ যন্ত্রণার এক জীবন। কিন্তু, এ সব তো জাগতিক, তাই তুচ্ছ। তাঁর আসল যন্ত্রণা তো মস্তিষ্কে। এক জীবনীকার, ‘লাভ অ্যান্ড ক্যাপিটাল’-এর লেখিকা মেরি গ্যাব্রিয়েল-এর ভাষায়, তাঁর ‘মাথার মধ্যে অবিশ্রান্ত তুফান।’ তার উপশম জ্ঞানচর্চা, কোন পথে আসবে মানুষের মুক্তি? কোন পথ ধরে গড়ে তোলা যাবে তাঁর স্বপ্নের সমাজ? যে সমাজে, ‘আমি সকালবেলা শিকার করব, বিকেলে মাছ ধরব, সন্ধ্যায় গরু চরাব, এবং রাতের খাবারের পর সমালোচনা করব।’ সন্ধ্যায় গরু চরানো যায় কি না সে প্রশ্ন অবান্তর, এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত মানুষ, তার ইচ্ছামত জীবনযাপন করতে পারবে— তার কোনও একটি বিশেষ বৃত্তিতে আটকে থাকার দরকার নেই। সেই মানবসমাজের সন্ধানে লন্ডনে বসবাসের প্রায় পুরো সময়টাই কাটিয়েছেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পড়াশুনো করে— ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত, সরকারি রিপোর্ট, সংবাদপত্র পড়ে। অধুনা জানা যাচ্ছে, শুধু পুঁজিবাদী সমাজ নয়, চিন-ভারত-ইন্দোনেশিয়া-লাতিন আমেরিকার সমাজগুলো নিয়ে তাঁর সুগভীর অধ্যয়নের কথা। শেক্‌সপিয়র গোটা পরিবারের সঙ্গী— স্ত্রী, কন্যারা সকলেই শেক্‌সপিয়র-বিশেষজ্ঞ। বস্তুত, কপর্দকহীন এই পরিবারটির কাছে যে সম্পদ ছিল, তা সমকালে শুধু নয়, যে কোনও কালেই বিরল। জ্ঞানের আসামান্য আলোক, আর সেই আলোকে আরও আরও আলোর সন্ধান। সেই সন্ধানের নাম কার্ল মার্ক্স, যাঁর জীবনটাই এক অসামান্য আলোক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Karl Marx
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE