Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কৃষ্ণানন্দের হাত ধরে বাংলার ঘরে এলেন কালী

তার আগে কালীপুজো হত ঘটে, যন্ত্রে কিংবা শিলাখণ্ডে। শ্মশান, নদীতীর বা গভীর অরণ্যের নির্জনতাই ছিল কালীপূজার  স্থান। শ্মশানবাসিনী ক্রমে ঠাঁই নিলেন বাঙালির ঘরে।তার আগে কালীপুজো হত ঘটে, যন্ত্রে কিংবা শিলাখণ্ডে। শ্মশান, নদীতীর বা গভীর অরণ্যের নির্জনতাই ছিল কালীপূজার  স্থান। শ্মশানবাসিনী ক্রমে ঠাঁই নিলেন বাঙালির ঘরে।

রণরঙ্গিণী: নদিয়ার শান্তিপুরে পূজিত আগমেশ্বরী কালীপ্রতিমা

রণরঙ্গিণী: নদিয়ার শান্তিপুরে পূজিত আগমেশ্বরী কালীপ্রতিমা

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৭ ০৮:০০
Share: Save:

ভোর রাতে এমন একটা স্বপ্ন দেখে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললেন গঙ্গার ‌ঘাটের দিকে। গোপপল্লির মধ্যে দিয়ে কিছুটা এগোতেই দেখতে পেলেন এক গোপবধূকে (মতান্তরে বাগদিবধূ)। ডান পা সামনে বাড়িয়ে, বাঁ হাতে এক তাল গোবর নিয়ে, ডান হাতে একমনে মাটির ঘরের দেওয়ালে গোবরের প্রলেপ দিতে ব্যস্ত ছিল সে। হাঁটুর উপর পর্যন্ত তার পরনে ছিল একটি ছোট শাড়ি। কোমর ছাপানো এক মাথা ঘন কালো চুল, হাঁটু ছুঁই-ছুঁই করছে প্রায়।

কৃষ্ণানন্দ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর মনে পড়ে গেল দৈব স্বপ্নের কথা। তিনি লক্ষ করলেন, বধূটির কপালে ফুটে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘামে ধেবড়ে গিয়েছে সিঁদুরের টিপটি। তাঁর দু’হাতেই তখন গোবর, কৃষ্ণানন্দকে দেখে হতচকিত মেয়েটি তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টানার চেষ্টা করলেন, লজ্জায় জিভ কাটলেন। আর কৃষ্ণানন্দ যেন সেই মুহূর্তেই তাঁর আরাধ্য দেবী কালীর অদেখা রূপটি দেখতে পেলেন। ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, আলুলায়িত কেশ, দিগম্বরী... বাঁ হাঁতে খড়্গ আর ডান হাতে বরাভয়। তাঁর মনে পড়ে গেল তন্ত্রে বর্ণিত দেবীর ধ্যানমন্ত্র: করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম, কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাং...

তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন তাঁর আরাধ্য দেবী কালীর রূপটি কেমন তা জানতে। রাতের পর রাত আসনে বসে ছটফট করেছেন দেবীদর্শনের জন্য। কিংবদন্তি এমনই, এক দিন আধো-ঘুম আধো-জাগরণে কৃষ্ণানন্দ দৈববাণী শুনতে পান যে ভোরের প্রথম আলোয় তিনি খুঁজে পাবেন নিজের আরাধ্য দেবীর রূপ।

কৃষ্ণানন্দের আগে বাংলায় কালীপুজো হত ঘটে, যন্ত্রে কিংবা শিলাখণ্ডে। মূর্তিতে কালীপুজোর প্রচলন তখনও হয়নি। বাড়িতে নয়, পুজো হত শ্মশানে, রাস্তার তেমাথায়, নদীতীরে বা গভীর অরণ্যে। ‘কণ্ঠাবসক্ত-মুণ্ডালীগলদ্রুধিরচর্চ্চিতাম্‌। কর্ণাবতংসতানীতশবযুগ্মভয়ানকাম্‌। ...মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্‌।’ ধ্যানমন্ত্র অনুসারে যাঁর গলায় শোভা পায় মুণ্ডমালা, দুই কানে দু’টি শব, যিনি মহাকালের সঙ্গে বিপরীত রতাতুরা, কৃষ্ণানন্দের প্রভাবে সেই শ্মশানবাসিনী কালী হয়ে উঠলেন বাঙালির আদরিণী শ্যামা। যে কালীপুজো এক সময়ে গৃহে ছিল নিষিদ্ধ, কৃষ্ণানন্দের হাত ধরেই সেই দেবী প্রবেশ করলেন বাংলার ঘরে ঘরে।

এ সব কিছুর ঘটনাস্থল শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান তথা বৈষ্ণবতীর্থ নবদ্বীপ। অনেকেই মনে করেন কৃষ্ণানন্দ শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক। আবার কারও মতে তিনি চৈতন্য-পরবর্তী যুগের মানুষ। শ্রীচৈতন্যের ভক্তিরসের প্রভাবে সমগ্র বাংলা যখন বিভোর, ঠিক তখনই কৃষ্ণানন্দের প্রভাবে আমূল পরিবর্তন এসেছিল বাংলার শক্তিসাধনায়। তিনিই গৃহী মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন অতি গোপন কালীপুজোর পদ্ধতি। কাপালিক, বামাচারী কিংবা অঘোরিদের আরাধ্য ভয়ংকরী দেবীর মধ্যে যে কল্যাণময়ী মাতৃরূপ রয়েছে, সেটাই সাধারণের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিলেন কৃষ্ণানন্দ।

চৈতন্য-পরবর্তী যুগে বৈষ্ণবধর্মের আকর্ষণ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। প্রবল হয়ে ওঠে তন্ত্রাচারের প্রভাব। আর তন্ত্রাচারের নামে বাড়তে থাকে অশুভ শক্তির চর্চা। এমনই অস্থির এক সময়ে কৃষ্ণানন্দ তন্ত্রশাস্ত্র সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তন্ত্রের ভয়ংকর দিকগুলি সরিয়ে গৃহী মানুষের জন্য শক্তিসাধনার সহজ পথটি খুঁজে বের করা। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দুর্লভ তন্ত্রগুলিকে সংকলন করে তিনি রচনা করলেন ‘তন্ত্রসার’। অনেকেই মনে করেন, কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যায় দক্ষিণাকালীর পুজোর প্রবর্তক কৃষ্ণানন্দই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখায় উল্লেখ রয়েছে, রা়ঢ়বঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রের রচয়িতাদের মধ্যে কৃষ্ণানন্দের রচনা সবচেয়ে মার্জিত।

নবদ্বীপের এক পণ্ডিত বংশে জন্ম হয়েছিল কৃষ্ণানন্দের। জনশ্রুতি, তাঁর পূর্বপুরুষ বিদ্যাচর্চার জন্য নবদ্বীপে এসেছিলেন। তাঁর বাবার নাম মহেশ্বর গৌড়াচার্য। দুই পুত্রের মধ্যে বড় কৃষ্ণানন্দ ছিলেন শক্তির উপাসক, আর ছোট ছেলে মাধবানন্দ ঘোর বৈষ্ণব। এই নিয়েও প্রচলিত আছে চমৎকার এক কাহিনি। এক বার বাড়ির গাছে এক কাঁদি কলা হয়েছে। কৃষ্ণানন্দ ও মাধবানন্দ দুই ভাই-ই মনে মনে ঠিক করেছিলেন, নিজেদের ইষ্টদেবতাকে ভোগ হিসেবে গাছের ফল নিবেদন করবেন। ফল যখন পাকল, কৃষ্ণানন্দ বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন না। মাধবানন্দ গোপালের ভোগে দেওয়ার জন্য কলার কাঁদিটি নিয়ে যান ঠাকুরঘরে। বাড়ি ফিরে কৃষ্ণানন্দ খুব রেগে গিয়ে মাধবানন্দের ঠাকুরঘরে ঢুকে দেখতে পান, স্বয়ং দেবী গোপালকে কোলে বসিয়ে ভোগ খাওয়াচ্ছেন!

নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে বাংলায় শাক্তধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। সেই প্রভাবেই নদিয়া এবং সংলগ্ন এলাকায় বৃদ্ধি পেতে থাকে কালীপুজো। শ্রীরামপুর খ্রিস্টীয় মিশনের পাদ্রি ওয়ার্ড সাহেবের তথ্য অনুসারে জানা যায়, সে সময় নদিয়ায় প্রতি বছর কার্তিকী অমাবস্যায় দশ হাজার কালীপুজো হত। প্রাচীন নবদ্বীপের গঙ্গার প্রায় উলটো দিকে বেলপুকুরে কৃষ্ণানন্দ-প্রবর্তিত এই কালীপুজোর ধারা ছড়িয়ে পড়েছিল ঘরে ঘরে।

নবদ্বীপের আগমেশ্বরীপাড়ায় কৃষ্ণানন্দের প্রবর্তিত এবং প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে আজও পঞ্চমুণ্ডির আসনে কালীপুজো হয়ে আসছে। নিয়ম মেনে আজও কার্তিক মাসের কৃষ্ণাপঞ্চমীতে খড় বাঁধা দিয়ে মূর্তি নির্মাণের সূচনা হয়। একাদশীতে খড়ের তৈরি বিশেষ ধরনের অবয়ব বিরাটাকার প্রতিমার বুকে স্থাপন করা হয়। অমাবস্যাতে হয় চক্ষুদান। অতীতে পুজো শেষ হলে সঙ্গে সঙ্গে বিসর্জন হয়ে যেত।

সে সময় শাক্ত এবং বৈষ্ণবের ঘোরতর বিরোধ ছিল। শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্যের উত্তরপুরুষ মথুরেশ গোস্বামী সেই বিরোধ মেটাতে কৃষ্ণানন্দের প্রপৌত্র সার্বভৌম আগমবাগীশের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। তবে বৈষ্ণব কন্যাকে বিয়ে করায় নবদ্বীপের তৎকালীন শাক্ত সমাজ সার্বভৌমকে একঘরে করেছিল। এমনই এক অবস্থায় মথুরেশ তাঁর মেয়ে-জামাইকে শান্তিপুরে নিয়ে আসেন। এর পর বড়গোস্বামীবাড়ির অদূরে পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে সার্বভৌম সেখানে কালীপুজোর প্রচলন করেন। শান্তিপুরের বড়গোস্বামীপাড়ায় পূজিত সেই কালীমূর্তির নামও আগমেশ্বরী। অতীতে এই পুজোয় কার্তিকী অমাবস্যায় এক দিনে মূর্তি গড়ে পুজোর রীতি ছিল। এখন আগে থেকে প্রতিমা তৈরি হলেও, দেবীর চক্ষুদান করা হয় পুরোহিত পুজোয় বসার আগে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE