Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আকাশ তো বড়

আট বছরেরও বেশি সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলাম। অনেক গল্প জমে আছে।মনে পড়ে, কলেজে পড়ার সময়, কোনও এক পয়লা বৈশাখে বসুশ্রী সিনেমার লাগোয়া ফুটপাতে আমরা ছ’সাত জন বন্ধু মিলে কড়া রোদে ছাতা মাথায় হেমন্তর গান শুনলাম (তখন হলের বাইরে লাউডস্পিকার দেওয়া হত)। এত রোদের তেজ যে মাঝে মাঝে সামনের টিউবওয়েলের জলে ছাতা ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম। সুযোগ পেলেই ওঁর ফাংশন শুনতে ছুটতাম।

প্রবীর কুমার দত্ত
শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:১০
Share: Save:

মনে পড়ে, কলেজে পড়ার সময়, কোনও এক পয়লা বৈশাখে বসুশ্রী সিনেমার লাগোয়া ফুটপাতে আমরা ছ’সাত জন বন্ধু মিলে কড়া রোদে ছাতা মাথায় হেমন্তর গান শুনলাম (তখন হলের বাইরে লাউডস্পিকার দেওয়া হত)। এত রোদের তেজ যে মাঝে মাঝে সামনের টিউবওয়েলের জলে ছাতা ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম। সুযোগ পেলেই ওঁর ফাংশন শুনতে ছুটতাম। বিয়ের পর জানলাম, আমার সংগীতশিল্পী স্ত্রী ইন্দ্রাণীও হেমন্তর ফ্যান। কলামন্দিরে ওঁর একটি অনুষ্ঠান শুনে আমরা এতই মুগ্ধ হলাম, ওঁকে চিঠি লিখে ফেললাম। নীচে আমরা সই করলাম, আমাদের ছোট্ট ছেলে প্রবালকেও সই করালাম। প্রায় দু’সপ্তাহ বাদে দেখি, উনি উত্তর দিয়েছেন! বাংলা অক্ষরে টাইপ করা চিঠি, নীচে ওঁর সই। প্রথম লাইনেই উত্তর দিতে দেরি হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, কারণ কাজে বম্বে (তখনও মুম্বই হয়নি) যেতে হয়েছিল। ফোনে যোগাযোগ করে আমাদের দেখা করতে বলেছেন। এক কালীপুজোর সন্ধ্যায় ওঁর শরৎ চ্যাটার্জি অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে দেখা করতে গেলাম। বসলাম একটি ছোট্ট ঘরে— এক দিকে পুরনো আমলের লম্বা সোফা, অন্য দিকে বিছানা পাতা ছোট্ট তক্তপোশ। ঘরভর্তি বাক্স, ট্রাংক। আলনায় ঝুলছে ফুলহাতা সাদা শার্ট, লুঙ্গি। ঘরের চেহারা দেখে অবাক আর হতাশ হচ্ছি, তখনই উনি ঢুকলেন। আমরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে, বেশ জড়োসড়ো হলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলেকে আনোনি কেন?’ বললাম, ‘বছর চারেকের ছেলে। বিরক্ত করতে পারে।’ হেসে বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে, ছেলেমানুষ তো।’ নানা কথায় প্রায় ৪৫ মিনিট কেটে যাওয়ার পর আমরাই যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। উনি নিজে হাতে করিডোরে আলো জ্বেলে একেবারে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

এর পর অনেক মাস কেটে গেছে, নিজেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সম্ভবত ’৮১ সালের শেষ দিক, কোনও এক সূত্রের মাধ্যমে খবর পেয়ে হেমন্তদা হঠাৎ এক দিন গাড়ি পাঠালেন, আমাকে নিয়ে যেতে। শুনলাম, উনি একটু অসুস্থ বোধ করছেন। গিয়ে দেখি, ওঁর প্রেশার বেশ বেড়ে গেছে। ঘরে তরুণ মজুমদার, অজিত চট্টোপাধ্যায় ও আরও অনেকে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন, কারণ একসঙ্গে দুটি ছবির সুর তৈরি করছিলেন সেই সময়। কিছু ক্ষণ আগেই বম্বে থেকে ওঁর স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায় এসেছেন এবং তিনিও সামান্য অসুস্থ। দুজনকেই দেখে, ওষুধ-টষুধ লিখে দিলাম। ওঁর গাড়িতে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, চালক সনৎ মুখোপাধ্যায় জানতে চাইলেন, কত ‘ফিজ’ দিতে হবে। বললাম, ছেলেবেলা থেকেই আমি ওঁর ভক্ত, সেবা করার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য হলাম। ফিজ-এর প্রশ্নই ওঠে না।

সনৎ সম্পর্কে একটু বলে নিই। খুব ছোটবেলাতেই সনৎ বম্বের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন, পরবর্তী কালে হেমন্তদার গাড়ির চালক হন। উনি হেমন্তদার সারা ক্ষণের সঙ্গী ছিলেন। ফাংশনে হারমনিয়ম ও ফোল্ডিং টেবিল স্টেজে তোলা, বাদ্যযন্ত্রীদের হারমোনিয়ামে সুর দেওয়া, ভিড় থেকে দাদাকে আগলে রাখা, অসুস্থ হওয়ার পর নিয়ম মতো ওষুধ খাওয়ানো, চেয়ারে করে অন্যের সাহায্যে তিন তলার ফ্ল্যাটে দাদাকে তোলা, ফাংশনের কথা মনে করিয়ে দেওয়া— সব কাজই করতেন। এক কথায় তিনি ছিলেন দাদার বডিগার্ড ও সেক্রেটারি। হেমন্তদা গত হওয়ার পর সনৎ ও-বাড়ি ছেড়ে হৈমন্তী শুক্ল’র গাড়ি চালাতেন। শুনেছি মারাত্মক ধরনের ম্যালেরিয়া রোগে কয়েক বছর আগে মারা যান। হেমন্তদা সনৎকে টালিগঞ্জে একটি ছোট ফ্ল্যাট দিয়েছিলেন। তাঁর মেয়ের জন্য একটি ‘স্কেল চেঞ্জিং’ হারমোনিয়ামও করিয়ে দিয়েছিলেন।

হেমন্তদার বাড়ি যাওয়ার ঠিক দু’দিন বাদে সনৎ আবার হাজির— ‘দাদা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন, আলাপ করবেন।’ যেতেই হেমন্তদা প্রশ্ন করলেন, ফিজ নিলাম না কেন। উত্তরে মনের কথাটাই বললাম। এর পর আমার ও আমার পরিবারের সকলের সম্পর্কে নানা কথা জানতে চাইলেন। কথাবার্তায় মনে হল না, অনেক দিন আগের প্রথম সাক্ষাৎকারের ঘটনা মনে আছে। সনৎ এসে একটি প্লেটে মিষ্টি ও এক গ্লাস জল দিয়ে গেলেন। অর্ধেক খাওয়া হয়েছে, এমন সময় পাশের ঘর থেকে অজিত চট্টোপাধ্যায় এসে জানালেন, টিভি-তে ন্যাশনাল প্রোগ্রামে হেমন্তদার গান দিচ্ছে, আমরা শুনব কি না। তাড়াহুড়ো করে খাওয়া ফেলে পাশের ঘরে এসে বসলাম। হেমন্তর গান হেমন্তেরই পাশে বসে শুনছি— অবিশ্বাস্য অনুভূতি! হঠাৎ দেখি হেমন্তদা আমার আধখাওয়া মিষ্টির প্লেট ও জলের গ্লাসটি হাতে করে নিয়ে এসে পাশের টেবিলে রাখলেন। লজ্জায়, অস্বস্তিতে অস্থির হয়ে বললাম— ‘এ কী, আপনি নিয়ে এলেন!!’ উনি মৃদু হেসে বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে? খেতে খেতে প্রোগ্রাম দেখো।’

পরিচয় হওয়ার কয়েক মাস বাদে পয়লা বৈশাখের সকালে হেমন্তদা ও বেলাবউদি আমাদের বাড়িতে হাজির। খুব দামি একটি শাড়ি ইন্দ্রাণীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘কাল সকাল ঠিক সাড়ে ন’টায় এই নতুন শাড়িটি পরে তৈরি থেকো, তোমাদের বসুশ্রী হলে ফাংশনে নিয়ে যাব।’ যে মানুষটির গান শোনার জন্য ছাতা মাথায় বসুশ্রী হলের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতাম, তাঁরই সঙ্গে যাচ্ছি তাঁরই গান শুনতে! সেই শুরু, তার পর অসংখ্য অনুষ্ঠানে ওঁর সঙ্গে গেছি। এক দিন দাদারই সঙ্গে (আলাপ হওয়ার পর ‘দাদা’ বলেই ডাকতাম) মহাজাতি সদনে আমরা দুজন ওঁর প্রোগ্রাম শুনতে গেছি, সেখানে মান্নাবাবুও গাইবেন। উদ্যোক্তারা আমাদের দুজনকে একেবারে প্রথম সারিতে বসিয়ে দিয়েছেন। দুজনেরই খুব ইচ্ছে মান্নাবাবুর গান শোনার। কিন্তু কথা আছে দাদার সঙ্গেই ফিরব, তাই লজ্জায় দাদাকে কিছু বলতে পারিনি।

দাদা গান শেষ করে মঞ্চের সামনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমরাও ওঁর সঙ্গ নেব বলে উঠে দাঁড়ালাম, কিন্তু লম্বা দুটি হাত আমাদের দুজনের কাঁধে রেখে জোর করে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘উঠো না, জায়গা চলে যাবে। মান্নার গান শুনে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরো।’ পরে বলেছিলেন, তোমরা সংগীতকে ভালবাসো, তাই সে দিন সুযোগটা নষ্ট হতে দিইনি।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকর

তখন প্রতি বছর দোলের দিন সন্ধ্যায় দেশপ্রিয় পার্কে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আয়োজিত উৎসবে তিনি গান গাইতেন, বিনা পারিশ্রমিকে। এক বার, তাঁর পা ভেঙে গিয়েছে, কোমর পর্যন্ত প্লাস্টার। দাদা জোর করে স্ট্রেচারে করে এসে সেই সন্ধ্যায় কোনও মতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান করলেন, শুধুমাত্র মহারাজদের কথা দিয়েছিলেন বলে।

সম্ভবত ১৯৮৩ সালের জুন মাসের একটি মাঝরাত— বউদির ফোন পেয়ে ছুটে গেলাম তাঁর বাড়িতে। দেখলাম বুকের ব্যথা, অল্প শ্বাসকষ্ট ও অস্বস্তিতে অস্থির হয়ে পড়েছেন হেমন্তদা। পরীক্ষার পর হৃদ্‌রোগ অনুমান করে, ইঞ্জেকশন ও ওষুধ দিলাম। ঘণ্টা দুয়েক বাদে অনেকটা সুস্থ দেখে ফিরে এলাম। পরের দিন সকাল সাড়ে আটটায় ওঁকে নিয়ে কার্ডিয়োলজিস্টের কাছে যাব বলে ওঁর বাড়িতে গিয়েছি, দেখি উনি বেরিয়ে যাচ্ছেন! বললেন, দশটায় এইচএমভি-র স্টুডিয়োতে একটি ছবির কোরাস গানের রেকর্ডিং আছে। বার বার বললাম, ‘হেমন্তদা, এখুনি আপনার ইসিজি করা দরকার!’ কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, ‘অনেকে আশা করে বসে আছে। আজ মিস করলে আবার কবে ডেট পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই। ওদের আমি হতাশ করতে পারব না।’ তখন আর কী করি? বউদির সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করে, হেমন্তদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অজিত চট্টোপাধ্যায়কে ফোনে সব জানালাম। তিনি এইচএমভি-র রেকর্ডিং ক্যানসেল করে, নতুন ডেট নিয়ে, হেমন্তদার কাছে হাজির হলেন। দাদা খুবই বিরক্ত হলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। প্রখ্যাত কার্ডিয়োলজিস্ট ডা. পি কে সেনের কাছে নিয়ে গেলাম— ইসিজি-তে ধরা পড়ল মারাত্মক ধরনের হৃদ্‌রোগ। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ডা. সেনের তত্ত্বাবধানে উডল্যান্ডস নার্সিংহোমে ভর্তি করা হল।

অত বড় গায়ক, কিন্তু বাড়িতে কোনও দিন রেওয়াজ করতে দেখিনি। অসুস্থতার চার মাস বাদে, প্রথম অনুষ্ঠান করবেন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে; সঙ্গে মান্নাবাবু, অরুন্ধতী হোমচৌধুরী ও আরও অনেক নামী শিল্পী। বেলা বউদি প্রায়ই অনুরোধ করেন, হারমোনিয়ামে গলাটা তাতিয়ে নিতে। উনি রোজই বলেন ‘বসব’, কিন্তু বসেন না। এ দিকে বউদির খুব টেনশন। অনুষ্ঠানের দু’দিন আগে বউদি আমাদের বললেন, তোমরা এক বার বলো তো! আমি ও ইন্দ্রাণী দুজনেই দাদাকে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতে খুব অনুরোধ করলাম। এ বারে দাদা খুব বিরক্ত মুখে বললেন, ‘দেখো, ঈশ্বর আমার গলায় সুর ঢেলে দিয়েছেন। তিনি যদি সুর তুলে নেন, তা হলে গলা ভাল চলবে না— তাই শত রেওয়াজেও কিছু হবে না। তোমরা দেখে নিও, আমি ঠিকই উতরে দেব।’ মঞ্চে আমাকে পাশে বসিয়ে ওই দিন এমন অসাধারণ গাইলেন, মান্নাবাবু ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে এসে দাদাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ওহ্‌, কী গাইলেন! কে বলেছে আপনি অসুস্থ?’

দাদা তখন বম্বেতে। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘রানার’-এর রেকর্ড বেরল। শুনেছিলাম, দাদাকে না জানিয়েই সলিল চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে এই ‘রিমেক’ হয়, যার জন্য দাদা আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু মুখে কিছুই বলেননি। গানটা শুনে, আমার ভাল লাগেনি। দাদাকে চিঠি লিখে জানালাম, আপনার ‘রানার’-এর অভিব্যক্তি ও আবেদনের কাছে এটা আসে না। উত্তরে দু-চার কথা লেখার পর মাত্র একটি লাইন লিখলেন, ‘লতা তার মতো গেয়েছে, আমি আমার মতো।’ কখনও কোনও শিল্পীকে অসম্মান করতে দেখিনি।

দাদার ভদ্রতাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতার তুলনা হয় না। এক বার কথা হয়েছিল, দুপুর সাড়ে তিনটেয় আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এক জায়গায় যাবেন। উনি এলেন তিনটে পঁয়ত্রিশে। প্রথমেই গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললেন, ‘সরি, কয়েক মিনিট দেরি হয়ে গেল। গাড়িটা স্টার্ট নিচ্ছিল না।’ পাঁচ মিনিট দেরি করে অত বড় মানুষটা আমার মতো এক জন সাধারণ মানুষকে ‘সরি’ বলছেন! দাদার সঙ্গে শহরতলিতেও অনেক ফাংশনে গিয়েছি, লক্ষ করেছি, উনি নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা আগে সেখানে যেতেন। বলতাম, ‘আপনার মতো মানুষ এত আগে যাচ্ছেন? কত শিল্পী তো কত পরে আসছেন।’ উনি বলতেন, ‘উদ্যোক্তারা আমার নামে টিকিট বিক্রি করেছেন, আমি আগে এসে গেলে ওঁরা টেনশনমুক্ত হবেন। তা ছাড়া ‘হেমন্ত এসে গেছে’ ঘোষণা করলে শেষ মুহূর্তে আরও কিছু টিকিট বিক্রি হয়। ওঁরা আমাকে পারিশ্রমিক দিচ্ছেন, সুতরাং ওঁদের দিকটাও আমার দেখা দরকার। তা ছাড়া, ভালই তো, জার্নির পর বিশ্রাম নেওয়া যাচ্ছে, অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে গল্পগুজব হচ্ছে।’

আমার স্ত্রী ইন্দ্রাণীর কাছে একটি ঘটনার কথা শুনেছি। এক জন মহিলা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী প্রায়ই হেমন্তদার কাছে আসতেন, ওঁর সঙ্গে ছবি তুলতেন, তার পর সেই ছবিগুলোকে ব্যবহার করে নিজের প্রচার করতেন। পরে তিনি বেশ পরিচিতি পান। এর পর তিনি হঠাৎ দাদার কাছে আসা বন্ধ করেন। এক বার মহাজাতি সদনে কবিপক্ষে দাদা, ইন্দ্রাণী ও সেই শিল্পীর গান ছিল। ইন্দ্রাণী অনুষ্ঠান শেষ করে এসে দেখেন, মহিলাটি অন্য দিকে মুখ করে বসে আছেন, যেন দাদাকে চেনেনই না। এর পর তাঁর অনুষ্ঠান শেষে উদ্ধত ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ দাদা তাঁকে ডেকে বললেন, ‘কী রে, চিনতে পারছিস না? খুব ভাল গান করেছিস। ফিরবি কীসে? চ, তোকে নামিয়ে দেব।’ ওই মহিলা তখন সকলের সামনেই দাদার পা দুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।

এক বার, প্লাস্টিক ব্যাগে রাখা দশ হাজার টাকা দাদার বাড়ি থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। দিন সাতেক বাদে জানা গেল, বাড়িরই এক জন কাজের লোক নিয়েছে। সকলেই তাকে পুলিশে দেওয়ার কথা বললেন, কিন্তু দাদা কিছুতেই সায় দিলেন না। এ নিয়ে বেলাবউদির সঙ্গে মনোমালিন্যও হল। পরে এক দিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, আপনি পুলিশে দিতে আপত্তি করলেন কেন?’ দাদা বললেন, ‘ও বহু বছর আমার কাছে আছে, এখন বয়স হয়েছে। আমি ঠিকই করেছিলাম, ওকে কিছু টাকা দিয়ে বলব, এ বার দেশে গিয়ে জমি-বাড়ি করে বিশ্রাম নাও। তার আগে ও নিজেই নিয়ে নিল, আমার লোকসানটা কোথায়? তা ছাড়া, পুলিশে দিলে ওরা ওকে মারধর করত, সে আমি সইতে পারতাম না।’

হেমন্তদার বাড়ির সামনে ফুটপাতে এক জন চা, বিস্কুট, কেক ইত্যাদি বিক্রি করত। কার কাছে হেমন্তদা শুনলেন, তার পনেরো বছরের ছেলেটি খুব ভাল ফুটবল খেলে। তখুনি দাদা তার জন্য ফুটবলের সমস্ত সরঞ্জাম কিনে দিলেন। যাতে সে পুষ্টিকর খাবার পায়, তাই সপ্তাহে-সপ্তাহে টাকাও দিতেন। বছর সাত-আট আগে, আমি কোথা থেকে যেন ট্যাক্সি করে আসছি, ভাড়া দিতে গেলে ড্রাইভার হাসতে হাসতে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, চিনতে পারছেন না? আমি সেই নীলু, যাকে দাদা ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন। আমার খেলা হল না দেখে দাদা আমাকে লাইসেন্স করিয়ে দিয়েছিলেন, তাই ট্যাক্সি চালাচ্ছি। আপনি তাঁর ডাক্তারবাবু ছিলেন, আমি কিছুতেই ভাড়া নেব না।’

বরাবর দেখেছি, দাদার বাড়িতে সকলেরই অবারিত দ্বার। কত জন আসতেন ওঁর কাছে‌— কেউ গান শেখার আর্জি নিয়ে, কেউ ওঁর গান শোনার জন্য, কেউ ছবিতে গাইবার জন্য, আবার কেউ শুধুই তাঁকে দেখতে। কারও প্রতি ওঁকে কখনও বিরক্ত হতে দেখিনি, বরং রাত আটটা বেজে গেলে গাড়ি দিয়ে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিতেন। বলতেন, রাতে ফাঁকা রাস্তায় কোনও অঘটন ঘটে গেলে আমার আপশোসের সীমা থাকবে না। এঁরা তো আমার কাছেই এসেছিলেন, তাই খুব টেনশন হয়। এক দিন সন্ধেয় গিয়ে দেখি, এক ভদ্রমহিলা দাদার পা জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন, চোখে জল। কিছু ক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে, স্বামীর সঙ্গে চলে গেলেন। বেলাবউদির কাছে শুনলাম, দাদার গাড়ি সে দিন খারাপ, তাই উনি ট্যাক্সি করে হাজরা রোড দিয়ে বাণী ঠাকুরের বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথে দেখেন, খুব ক্লান্ত ঘর্মাক্ত অবস্থায় ওই মহিলা ট্যাক্সির জন্য ছোটাছুটি করছেন। দেখে মনে হয়, মহিলা গর্ভবতী। দাদা ওঁকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে তাঁর বাড়ি পৌঁছে দেন।

এক বার দাদার সঙ্গে দমদমের এক জায়গায় অনুষ্ঠানে গেছি। গান শেষ হয়ে গেছে, দাদা স্টেজ থেকে নেমে, যেখানে গাড়ি রাখা ছিল সেখানে যাচ্ছেন, একটা খুব সরু গলির মধ্যে দিয়ে। দু’ধারে সমস্ত বাড়ি থেকে সবাই ঝুঁকে দাদাকে দেখছে। সব বাড়ির জানলা, ছাদ, রোয়াক মানুষে ভর্তি। এই সময় এক অতি-বৃদ্ধার গলা শুনলাম, ‘কই, কোথায় হেমন্ত?’ হয়তো চোখে ভাল দেখেন না। সঙ্গে সঙ্গে দাদা দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার পর সেই বৃদ্ধার কাছে গিয়ে দু’হাত জোড় করে নমস্কার করে বললেন, ‘এই যে আমি।’ বৃদ্ধা কেঁদে ফেলে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘এ বার আমি শান্তিতে মরতে পারব।’

১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে বিপুল সংবর্ধনা ও ইলিশ মাছ নিয়ে দাদা-বউদি ফিরলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া সদ্য-ধরা কিছু ইলিশ মাছ কাঠের বাক্সে বরফ দিয়ে প্যাক করে উপহার দিয়েছিলেন। সেই রাত্রেই দুটি ইলিশ আমাদের বাড়ি পৌঁছে গেল। দাদার শরীর বিশেষ ভাল যাচ্ছিল না। ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়ছিলেন। তা সত্ত্বেও গায়ে অল্প জ্বর নিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠান করলেন। ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে বেলাবউদির ফোন পেয়ে আমরা দুজন ছুটে গেলাম। দেখলাম, বেশ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বাড়িতেই অক্সিজেন, স্যালাইন, ওষুধপত্তরের ব্যবস্থা করা হল। বিশেষ উন্নতি না হওয়াতে কন্যা রাণু ও পুত্রবধূ মৌসুমীর সঙ্গে আলোচনা করে নার্সিংহোমে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। কার্ডিয়োলজিস্ট ডা. কান্তি বক্সির সঙ্গে যোগাযোগ করা হল।

দাদার রেকর্ড বা ক্যাসেট বেরোলেই উনি তার ওপর নাম সই করে আমাদের দিতেন। ওই দিনই রিলিজ হয়েছে তাঁর ‘আনন্দ লহরী’ ক্যাসেটটি। এত কষ্টের মধ্যেও বউদিকে ডেকে বললেন, ইন্দ্রাণীকে ক্যাসেটটি দিতে। ইন্দ্রাণী বাধা দিয়ে বলল, আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন, তখন আমাদের নাম লিখে, আমাদের দেবেন। ও জানত না, দাদা কোনও দিনও নিজ হাতে ক্যাসেটটা দিতে পারবেন না। তখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে, তারই মধ্যে একটি ছেলে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এল। ঘরে তখন ইন্দ্রাণী ছাড়াও আরও দুজন পরিচিতা মহিলা। দাদা স্ট্রেচারে ওঠার সময় জানতে চাইলেন, এঁরা কী ভাবে বাড়ি যাবেন। আশ্বাস দেওয়া হল, গাড়ি করে সনৎ এঁদের পৌঁছে দেবে। সঙ্গে লোকজন নেই, বেলাবউদি স্যালাইনের বোতল হাতে নিলেন, আমি অক্সিজেন-মাস্ক ধরে রইলাম। অ্যাম্বুলেন্সে বেলভিউ নার্সিং হোম যাচ্ছি, পদ্মপুকুরের কাছে দেখি, দাদা খুব ঘামতে শুরু করেছেন। নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন। বার বার অস্পষ্ট স্বরে বলছেন ‘আর কত দূর?’ বুঝতেই পারলাম আর একটি মারাত্মক হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হলেন। নার্সিংহোমে পৌঁছে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হলেন। ডা. বক্সি দাঁড়িয়ে থেকে যা যা করণীয়, সব করলেন। ঘণ্টা দুয়েক বাদে অবস্থা একটু থিতু হল, কিন্তু বিপদ কাটল না। ইঞ্জেকশনের জেরে ঘোরের মধ্যে রয়েছেন দেখে ঠিক হল, বেলাবউদি ও রাণুকে নিয়ে আমি বাড়ি ফিরে যাব। মৌসুমী বললেন, বেলভিউতেই থাকবেন। রাত প্রায় বারোটা। হেমন্তদার গায়ে আলতো হাত রেখে বললাম, ‘দাদা, বউদি ও রাণুকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোন।’ অল্প একটু চোখ খুলে দাদা বললেন, ‘মোস্ট ওয়েলকাম।’ এটাই ওঁর শেষ কথা। ২৬ ভোররাতে মৌসুমীর কান্নাভেজা গলায় ফোন পেলাম— বাবা নেই!

duttapr2@yahoo.co.in

ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

hemant mukhopadhay prabir kumar dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE