Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

বোনেদের বিয়ে দিতে ছেলেদের ধরে আনতেন তিনি

রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন এ রকমই ডাকাবুকো। তাঁর বিয়েতেও তাই পুলিশি বন্দোবস্ত। এ দিকে গলার জোরও প্রবল, হিন্দুমেলায় ছোট ভাইয়ের লেখা কবিতা পড়ে দিলেন তিনিই। দীপঙ্কর ভট্টাচার্য রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন এ রকমই ডাকাবুকো। তাঁর বিয়েতেও তাই পুলিশি বন্দোবস্ত। এ দিকে গলার জোরও প্রবল, হিন্দুমেলায় ছোট ভাইয়ের লেখা কবিতা পড়ে দিলেন তিনিই। দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭ ১২:৫০
Share: Save:

১৮৬৮ সালের ১১ এপ্রিল, হিন্দুমেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে স্বরচিত কবিতা পাঠ করবেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাইক তখন কল্পনাতীত। এ দিকে তাঁর গলার স্বর তেমন জোরালো নয়। তা হলে উপায়? ভাইয়ের হয়ে উচ্চ স্পষ্ট স্বরে কবিতা পড়ার দায়িত্ব নিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও সারদাসুন্দরী দেবীর তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে ডাকাবুকো, জেদি, বেপরোয়া, মস্তান ছেলেটা। শুধু কি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ? খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রকথা’ থেকে জানা যায়, ১৮৭৫-এ আবার হিন্দুমেলার অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘হিন্দুমেলার উপহার’ কবিতাটি উচ্চ কণ্ঠে পাঠ করেন হেমেন্দ্রনাথই।

শুধু গলার জোরে নয়, ঠাকুরবাড়ির যে কোনও অসম্ভব কাজ সম্ভব করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। জোড়াসাঁকোর ঠাকুররা পিরালি ব্রাহ্মণ, তার ওপর ব্রাহ্ম। যতই অর্থ থাকুক বা মান, এই দুই কারণে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের উঁচু ঘরের বর জোটা মুশকিল ছিল। এ ক্ষেত্রেও মাঠে নামেন হেমেন্দ্র। কুলীন ছেলেদের প্রলোভন ও ভয়, দুটো দাওয়াই দিয়ে রীতিমতো পাকড়াও করে আনতেন তিনি। উনিশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় দেবেন্দ্রনাথের ভক্তবন্ধু সাঁত্রাগাছি নিবাসী হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে নীপময়ীর সঙ্গে। তাঁর বিবাহ অনুষ্ঠানও ছিল ঘটনাবহুল। শোনা যায়, ব্রাহ্ম মতে এই বিয়ের সময় সামাজিক গোলযোগের আশঙ্কা ছিল। তাই পুলিশ পাহারায় বিয়ে হয়েছিল ।

দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছেন, কিন্তু ঠাকুরবাড়িতে তখনও পারিবারিক শালগ্রাম শিলা উপস্থিত। শোনা যায়, সিংহাসন থেকে শালগ্রাম শিলা তুলে পুকুরে ছুড়ে ফেলার দুঃসাহসিক কাজটিও হেমেন্দ্রনাথ করেছিলেন।

হেমেন্দ্রনাথ মাঝপথে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে রাতদিন মেতে থাকতেন ছোট ভাইবোনদের পড়ানো নিয়ে। সে দলে টেনে নিলেন বাড়ির বউদেরও! অচিরেই হয়ে উঠলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ, স্বর্ণকুমারী দেবী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর গৃহশিক্ষক। শিক্ষক হেমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, প্রয়োজনে ছাত্রছাত্রীকে ধমক না দিলে বিদ্যাদান সম্পূর্ণ হয় না। তাঁর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন ঠাকুরবাড়ির পড়ুয়ারা। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘পুরাতনী-তে লিখেছিলেন, ‘বিয়ের পর আমার সেজ দেওর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইচ্ছে করে আমাদের পড়াতেন। তাঁর শেখাবার দিকে খুব ঝোঁক ছিল। আমরা মাথায় কাপড় দিয়ে তাঁর কাছে বসতুম আর এক একবার ধমক দিলে চমকে উঠতুম।’ বয়সে হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনীর চেয়ে মাত্র বছর ছয়েকের বড়!

ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার প্রতি প্রবল প্রেম থাকলেও শুধু ইংরেজি শিক্ষার প্লাবনে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা ভেসে যাক, এ ইচ্ছে ছিল না হেমেন্দ্রনাথের। জ্ঞানদানন্দিনী লিখছেন, ‘আমার যা কিছু বাংলা বিদ্যা তা সেজঠাকুরপোর কাছে পড়ে। মাইকেল প্রভৃতি শক্ত বাংলা বই পড়াতেন।’ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জীবনস্মৃতি’-তে লিখেছেন, ‘যখন চারিদিক খুব করিয়া ইংরেজি পড়াইবার ধুম পড়িয়া গিয়াছে, তখন যিনি সাহস করিয়া আমাদিগকে দীর্ঘকাল বাংলা শিখাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেই আমার স্বর্গত সেজদাদার উদ্দেশে সকৃতজ্ঞ প্রণাম নিবেদন করিতেছি।’

১৮৮৪-এর ১২ জুন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মারা যান হেমেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের তখন ২৩ বছর বয়স। দশ বছর আগে চলে গেছেন তাঁদের মা সারদাসুন্দরী দেবী। ঠিক কী কারণে মৃত্যু হয়েছিল সারদাসুন্দরীর, তা আজও স্পষ্ট নয়। প্রফুল্লময়ী দেবীর আত্মকথা থেকে জানা যায়, হাতের উপর লোহার সিন্দুকের ডালা পড়ে ব্যথা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত বার দুয়েক অস্ত্রোপচার হয়। পরে ক্ষতে দূষণই মৃত্যুর কারণ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে জানা যায়, আঙুলহাড়া পেকে গিয়ে সেপটিক হয়ে মৃত্যু হয় সারদাদেবীর। ইন্দিরা দেবীর কথায়, স্বর্ণকুমারীর মেয়ে হিরণ্ময়ী ছোটবেলায় হামা টানতে-টানতে কর্তাদিদিমার হাত মুচকে দিয়েছিলেন। হাতে আঘাতের কারণ যা-ই হোক না কেন, হাতে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল। এই অস্ত্রোপচারে গ্রাফটিং-এর প্রয়োজন হয়েছিল। হেমেন্দ্রই সেই সময় বাহুমূল থেকে মাংসখণ্ড কেটে সাহায্য করেছিলেন মায়ের অপারেশনে।

নিয়মিত কুস্তি লড়তেন হেমেন্দ্র, শরীরচর্চায় ছিল তাঁর প্রবল উৎসাহ। এমন একটা মজবুত লোক মাত্র চল্লিশেই ফুরিয়ে গেলেন কেন? ঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। জ্ঞানদানন্দিনী ‘পুরাতনী’-তে জানাচ্ছেন, ‘সেজঠাকুরপোই বেশি কুস্তি করতেন। বোধহয় ছেড়ে দেবার পর যে বাতে ধরল তাতেই অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে মারা গেলেন।’

পরিবারের প্রতি ভালবাসা ও কর্তব্যপরায়ণতার কারণেই সম্ভবত দেবেন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম উইলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে হেমেন্দ্রনাথকেও এগজিকিউটর নিযুক্ত করেন। যে মানুষটা তাঁর পরিবার নিয়ে এতটা আবেগপ্রবণ ছিলেন, তাঁর মৃত্যুতে আশ্চর্য নীরব ঠাকুরবাড়ি। ‘জীবনস্মৃতি’র ওই বাক্যটি ছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেজদাদা সম্পর্কে তেমন কিছু লেখেননি কোথাও! মৃত্যুর ২৭ বছর পর পুত্র ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে হেমেন্দ্রনাথের লেখাগুলি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘হেমজ্যোতি’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE