Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রাখে বনবিবি, মারে কে

সুন্দরবনের জল-জঙ্গলে দুই দেবতার রাজ। মানুষের জনপদ বনবিবির। আর গহন বাদাবনের জল-মাটি দক্ষিণ রায়ের থাবায়। শিশির রায় টালিগঞ্জের টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়ো থেকে কুঁদঘাট যাওয়ার রাস্তাতেই পড়ে মন্দিরটা। সাধারণ ছিরিছাঁদের মন্দির, মোড়ে মোড়ে থাকে যেমন। চোখ টানে না। কিন্তু এলাকার পুরনো, অতিবৃদ্ধ মানুষরা পাশ দিয়ে যেতে-আসতে হাত কপালে ঠেকান। ‘বনবিবির মন্দির’ বলে কথা!

অভয়দাত্রী: বনবিবি, পাশে জঙ্গলি শাহ। আছে বাঘরূপী দক্ষিণ রায়ও। ছবি: সুমন চৌধুরী

অভয়দাত্রী: বনবিবি, পাশে জঙ্গলি শাহ। আছে বাঘরূপী দক্ষিণ রায়ও। ছবি: সুমন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

টালিগঞ্জের টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়ো থেকে কুঁদঘাট যাওয়ার রাস্তাতেই পড়ে মন্দিরটা। সাধারণ ছিরিছাঁদের মন্দির, মোড়ে মোড়ে থাকে যেমন। চোখ টানে না। কিন্তু এলাকার পুরনো, অতিবৃদ্ধ মানুষরা পাশ দিয়ে যেতে-আসতে হাত কপালে ঠেকান। ‘বনবিবির মন্দির’ বলে কথা!

বনবিবি! দক্ষিণ কলকাতার ভিড়-ঠাসা রাস্তার ওপর বাদাবনের বিবি এল কোত্থেকে? মন্দিরে উঁকি দিলেও চোখে পড়ে শুধু একটা শিবলিঙ্গ, আর কিচ্ছু না। কিন্তু প্রাচীনরা জানেন, সে কালে দক্ষিণের সাগর-ছোঁয়া জল-জঙ্গল বিস্তৃত ছিল আদিগঙ্গার পাড় অবধি। খাঁড়ি, বাদাবন আর মউলি-মেছুয়ার জঙ্গলে দাপানো ‘বড় মিঞা’ বা ‘দক্ষিণ রায়’-এর রাজত্ব গড়িয়েছিল এখানেও। সেই দক্ষিণ রায়ের তর্জন-গর্জন থেকে বাঁচাবেন কে, এক বনবিবি ছাড়া? সিনেমাপাড়ার মন্দির তাই লোকবিশ্বাসটুকু বয়ে চলেছে, প্রতীক-বিগ্রহ-দেবলক্ষণ ছাড়াই।

বকখালির মন্দিরে অবশ্য তিনি জাঁকিয়ে বিরাজমানা। হাতে মুগুর আর ত্রিশূল, ব্যাঘ্রবাহনা দেবীকে দেখে জগদ্ধাত্রীর মতোই মনে হয়, যদিও ওই কৌলীন্য তাঁর সত্যিই আছে কি না, সন্দেহ। মধু, মোম, কাঁকড়া খোঁজা মউলেদের দেবীর আবার মর্যাদা!

বকখালির দেবী তাও শাড়ি-কাপড় গায়ে জড়ানো, সুন্দরবনের আদাড়-বাদাড়ে বহু মন্দিরে বনবিবির পরণে আবার পাজামা-ঘাগরা। অনেক জায়গাতে আবার বিবির পাশে মুগুর হাতে, বাবরিচুলো এক পুরুষ। বিবি কোথাও বাঘের ওপর, কোথাও মুরগির ওপর! এক পাশে একটা বাঘ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসার উপক্রম করছে।

শুধু ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রভূমি থেকে আবির্ভূত দেবতারাই অসুর-অশুভ নিধনের কাহিনি বলেন, এমন নয়। বাংলার জল-মাটি থেকে উঠে আসা লৌকিক দেবতাদেরও আছে নিজস্ব ‘ন্যারেটিভ’। বনবিবির জন্মবৃত্তান্ত যেমন বলে, তিনি মক্কার এক সুফি ফকিরের কন্যা। ফকিরের দুই বউ। প্রথম বউয়ের দেওয়া শর্তে, ঘটনাক্রমে দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজ দুই ছেলেমেয়েকে ফকির রেখে আসতে বাধ্য হন গহন বনে (কৈকেয়ীর শর্তে রামের বনবাস মনে পড়ে?)। পরে অবশ্য ছেলেটিকে ঘরে নিয়ে যান, পুত্র বলে কথা। একা মেয়ে বড় হয় এক হরিণী-মায়ের কাছে, নিবিড় করে চিনে নেয় জঙ্গলের সাদা-কালো। সেই মেয়েই বনবিবি। অনেক পরে ফকির বাবা নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাঁকে ঘরে (মক্কায়) ফিরিয়ে নিয়ে যান।

তবু ডাক আসে, আবারও। ‘আঠারো ভাটির দেশ’ সুন্দরবনে রাজ করে দানব দেবতা দক্ষিণরায়, তাঁর রাজত্বে পেটের টানে ঢুকে পড়া ভাটির মানুষদের বাঘ হয়ে খেয়ে ফেলে সে। বনবিবি আর তাঁর মুগুরধারী ভাই জঙ্গলি শাহ, সেখানে এসে যুদ্ধে হারায় দক্ষিণরায়কে। চুক্তিও হয়, বাদাবনের যে অংশে মানুষের বাস, তা থাকবে বনবিবির আঁচলের তলায়। আর গভীর দক্ষিণের জল-মাটি দক্ষিণ রায়ের থাবায়। সেই থেকে বাদাবন আর খাঁড়ি-জঙ্গলের মানুষের মা বনবিবি। রুটি-রুজির বড় বালাই, মানুষকে গ্রাম ছেড়ে বেরোতেই হবে, সেঁধোতেই হবে দক্ষিণ রায়ের ডেরায়। বনবিবি রাখলে, মারে কোন বাঘে?

মক্কা থেকে সুন্দরবন, লোকবিশ্বাসের তরী বেয়ে দেবতার এই দীর্ঘ যাত্রা অনবদ্য, অবিশ্বাস্য মনে হয়। মনে হয়, তাঁর সুফি পিতৃপরিচয়ের মধ্যেই ধর্মনির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান সমস্ত মানুষের পুজো-আরাধনার অভ্যেসটি নিহিত। নানান ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের প্রার্থনাস্থল হিসেব আজমেঢ় শরিফ ভারতবন্দিত, অথচ বাংলারই এক কোণে নিভৃত বনবিবির মন্দির আদর পায় না। সুন্দরবনের জঙ্গলে-খাঁড়িতে মাছ-মধুর খোঁজে ফেরে যে হতদরিদ্র মানুষ, যাঁরা জানেনই না ঠিক কখন নৌকোয় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিমেষে জঙ্গলে নিয়ে ফেলবে হলদে-কালো ডোরাকাটা, তাঁদের আবার ধর্ম কী! গাঁধী বলেছিলেন, পৃথিবীতে এমন ক্ষুধার্ত মানুষ আছে, ঈশ্বর যাদের কাছে শুধু এক টুকরো রুটি রূপেই ধরা দেন। ‘দক্ষিণ-দেশ’-এর মানুষ পেটে দাউদাউ খিদে নিয়েও পুজো চড়ান বনবিবির মন্দিরে, আবার ধপধপি স্টেশনের অদূরে দক্ষিণরায়ের মন্দিরেও। জীবন আর পেট চালাতে শান্ত ও রুদ্র, দুয়ের তুষ্টিই খুব জরুরি!

তবু বনবিবির মন্দিরে সচরাচর ব্রাহ্মণ পুরোহিত ঢোকেন না। দয়াপরবশ বা ধর্মভীরু অন্য জাতের কেউ পুজো করেন। ইদানীং আবার রব উঠেছে, দক্ষিণরায়ের মূর্তির পায়ে জুতো, ও কেমন কথা (কার্তিকের পায়ে নাগরা জুতো থাকলে অবশ্য চোখ টাটায় না)! এহ বাহ্য, আসল কথাটি হল: উচ্চবর্ণের তথা প্রামাণ্য হিন্দুধর্মের অনুষঙ্গ মানছে না যা, অন্য ধর্মের বর্ণ-গন্ধ-ছন্দ নিজেতে মিশিয়ে নিয়েছে যা, তাকেই চোখ রা‌ঙাও, সরিয়ে দাও মনোযোগের কেন্দ্র থেকে। কেউ কেউ এখন লোক-সংস্কৃতি ঘুলিয়ে দিয়ে বনবিবিকে খাঁটি হিন্দু দেবী
বানাতে চান।

বনবিবি, তাঁর ভাই, মায় শত্রু দক্ষিণ রায়ও এমন বিপদে আগে কখনও পড়েছেন আদৌ? ইতিহাস ঘেঁটেও বলা মুশকিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE