Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

চিন-ভারতের সেতু বেঁধেছিলেন কবি

রবীন্দ্রনাথের চেষ্টায় ১৯৩৭ সালে শান্তিনিকেতনে তৈরি হয় চীনা ভবন। উদ্দেশ্য, চিনের সঙ্গে এ দেশের গাঁটছড়া বাঁধা। ডোকলামের রণং দেহি বাজারেও আশি বছর পেরিয়ে গেল সেই ভবন।রবীন্দ্রনাথের চেষ্টায় ১৯৩৭ সালে শান্তিনিকেতনে তৈরি হয় চীনা ভবন। উদ্দেশ্য, চিনের সঙ্গে এ দেশের গাঁটছড়া বাঁধা। ডোকলামের রণং দেহি বাজারেও আশি বছর পেরিয়ে গেল সেই ভবন।

প্রতিষ্ঠাতা: তান-য়ুন শান।

প্রতিষ্ঠাতা: তান-য়ুন শান।

স্বপনকুমার ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৮ ০০:১৫
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ ১৯২৭ সালে গিয়েছেন চিন ভ্রমণে। এটা দ্বিতীয় বার যাওয়া, ১৯২৪-এ গিয়েছিলেন প্রথম বার। এ বার ভ্রমণের তালিকায় ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও অনেকগুলি জায়গাও। ঘুরতে ঘুরতে এলেন সিঙ্গাপুরে। এখানেই কবির সঙ্গে দেখা ছাব্বিশ বছরের এক চিনা যুবকের। উজ্জ্বল, সপ্রতিভ। নাম তান-য়ুন শান। সিঙ্গাপুরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তান-এর নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়। বিশ্বকবির ইচ্ছে, পৃথিবীর বহু ভাষা-সংস্কৃতির মিলনায়তন হয়ে উঠবে বিশ্বভারতী, এক নীড়ে বহু বৈচিত্রকে আশ্রয় দেবে সে। রবীন্দ্রনাথ চিনা তরুণ তান-কে বিশ্বভারতীতে চিনা ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। অপ্রত্যাশিত এই প্রস্তাবকে তান গ্রহণ করলেন কবির
আশীর্বাদ হিসেবে।

পরের বছর, ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বরে তান-য়ুন শান এলেন কলকাতায়। ৩ সেপ্টেম্বর জোড়াসাঁকোতে দেখা করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। রাতের ট্রেনেই চলে এলেন শান্তিনিকেতন। সঙ্গী ছিলেন পাঠভবনের তৎকালীন অধ্যক্ষ সত্যজীবন পাল। শুরু হল নতুন এক জীবন। কবির আমন্ত্রণে চিনা শিক্ষক হিসেবে শান্তিনিকেতনে এলেও, তান মনেপ্রাণে হয়ে উঠলেন এক জন ভারতীয় ছাত্র ও গবেষক। এক দিকে পড়ান চিনা ভাষা, অন্য দিকে নিজে পড়েন সংস্কৃত। রানী চন্দের স্মৃতিকথায় আছে ‘প্রফেসর তান’-এর কথা। প্রথমে একাই এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে, পরে স্ত্রী, দু’টি ছেলেমেয়েকেও নিয়ে আসেন। মেয়ে তানওয়েন বড় হয়ে বিশ্বভারতীতে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়, এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল সে। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন আর একটি মেয়ে হয় তান-দম্পতির, রবীন্দ্রনাথ তার নাম রেখেছিলেন ‘চামেলি’। আশ্রমের মাটিতে প্রথম চিনে-কন্যার জন্ম।

রবীন্দ্রনাথের কাছে চিন ছিল পরম আগ্রহের হীরকখণ্ড। তাঁর আন্তরিক এষণা ভারত ও চিন, দুই দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিবিড় সেতুবন্ধনের সূচনা করেছিল। কবির এই কাজে তাঁর সহযোগী ও সঙ্গী ছিলেন তান। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, চিনা ভাষা-সংস্কৃতির সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের সক্রিয় চর্চা হোক বিশ্বভারতীতে। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও ছাত্ররা চিনা ভাষা জানুক, চিনা সংস্কৃতি সম্পর্কে উৎসুক হয়ে উঠুক, সে দিকেও সবিশেষ দৃষ্টি দিয়েছিলেন। আর এই ভাষা-সংস্কৃতির চর্চার কেন্দ্র হিসেবে শান্তিনিকেতনে ‘চীনা ভবন’ স্থাপনা ছিল রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায়। রবীন্দ্র-জীবনকালেই, ১৯৩৭ সালের ১৪ এপ্রিল উদ্বোধন হয়েছিল চীনা ভবন— তান-য়ুন শান ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ।

বিশ্বভারতীতে বছর তিনেক কাজ করার পর ১৯৩১-এর সেপ্টেম্বরে তান চিন-এ যান, চীনা ভবন প্রতিষ্ঠার কাজেই। ১৯৩৩ সালে নানকিংয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সিনো-ইন্ডিয়ান কালচারাল সোসাইটি’। ভারতবর্ষে এই পরিষদের সভাপতি হলেন রবীন্দ্রনাথ। তান-য়ুন শান চীনা ভবন প্রতিষ্ঠার একটি খসড়া-পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। কবির মন্তব্য সহ সমস্ত খসড়া-পরিকল্পনাটি চিন ও ভারত দুই দেশেই চিনা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়।

চিনের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে চীনা ভবন প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন তান। সে দেশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী, এমনকী রাষ্ট্রপ্রধানেরও সহযোগিতা ও আন্তরিক সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে জোগাড় করেছেন অসংখ্য চিনা বই। চিনের সিনো-ইন্ডিয়ান কালচারাল সোসাইটি এক লক্ষ টাকার বই কিনে, উপহার হিসেবে তা তুলে দেন তানের হাতে। এ ছাড়াও তাঁর অন্যান্য বন্ধু ও প্রকাশকরা প্রায় হাজার পঞ্চাশ চিনা বই উপহার দেন। এর মধ্যে ছিল চৈনিক বৌদ্ধমত, চৈনিক ধ্রুপদী সাহিত্য ছাড়াও ইতিহাস, শিল্পকলা ও দর্শনের বই। চিনা, তিব্বতি ও সংস্কৃত— এই তিন ভাষায় লেখা ধ্রুপদী সাহিত্য সংগ্রহ, বিশেষ করে ত্রিপিটক থেকে অনুবাদ ও টীকার কাজে তানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। চিনা ত্রিপিটকের বিভিন্ন সংস্করণ নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সংগ্রহ করে এনেছিলেন কাঠের হরফে ছাপা (জাইলোগ্রাফ) তিব্বতি ত্রিপিটক। ১৯২২ সালে হাবদুন নামে চিনের এক ধনী ইহুদি বণিক চিনা ভাষায় অনূদিত সমগ্র ত্রিপিটক বিশ্বভারতীকে উপহার দিয়েছিলেন। পরে চিন-এর চব্বিশটি রাজবংশের বিপুল গ্রন্থসমূহ এখানে সংগৃহীত হয়। তান-য়ুন শান চীনা ভবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ ও দুষ্প্রাপ্য বৌদ্ধ গ্রন্থের সম্পাদনা ও অনুবাদের কাজ সুসম্পন্ন করেছিলেন। নিজেও উদ্ধার করেছেন বহু মূল্যবান নথিপত্র, যার মূল্য অপরিসীম।

বিশ্বভারতীর ‘চীনা ভবন’, সে কালে।

সংগৃহীত অর্থ ও সমস্ত বইপত্র নিয়ে ১৯৩৬-এ তান ফিরে আসেন শান্তিনিকেতনে। ওই বছরেই তাঁর উদ্যোগে চীনা ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়। বৌদ্ধ স্থাপত্যশৈলী চৈত্যের অনুকরণে ভবনটি নির্মিত। পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন আশ্রম-সচিব ও শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ কর। এ ছাড়াও নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেজ, বিনায়ক মাসোজী এবং কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা চীনা ভবনের স্থাপত্য, দেওয়ালচিত্র (ফ্রেস্কো) গড়ে তুলেছিলেন। রানী চন্দের বর্ণনা: ‘চীনভবনের বাগানে রাশি রাশি ফুল ফুটল। ঘরে ঘরে বৌদ্ধসন্ন্যাসীর বস্ত্রের উজ্জ্বল কমলা রঙে আলো ঝলমল করে উঠল। চীনে পণ্ডিত, চীনে শিল্পী, ছাত্র-শিক্ষকে বাড়ি ভরে গেল।’’

আশি বছর আগে, ১৯৩৭-এর ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিন চীনা ভবনের উদ্বোধন করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘এ দিনটি আমার কাছে বস্তুতই একটি স্মরণীয় দিন।... ভারতবাসী ও চীনবাসীর মধ্যে সংস্কৃতি ও বন্ধুত্ব আদানপ্রদানের একটি ব্যবস্থার পত্তন আজ করা গেল।...’’ পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানটি জ্ঞানতপস্বীদের এক মিলনকেন্দ্র হিসেবে রূপ নেয়। অনেক উৎসব-অনুষ্ঠান হয়েছে এখানে— রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই, এসেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরোজিনী নাইডু, দেশবিদেশের বহু গুণী-জ্ঞানী। এসেছিলেন জেনারেল চিয়াং কাইশেকও।

শান্তিনিকেতনে চীনা ভবনের যখন পত্তন হয়েছিল, তখন ভারতবর্ষে চিনা ভাষা চর্চার অন্য কোনও কেন্দ্র খুব সম্ভবত ছিল না। অনেক বছর পরে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে চিনা ভাষা চর্চা ও গবেষণার একটি বড় কেন্দ্র গড়ে ওঠে। চিনা দূতাবাসের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগও স্থাপিত হয়। বৃত্তি নিয়ে বহু ভারতীয় ছাত্রছাত্রী চিন-এ গিয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করে।

চীনা ভবনে এই মুহূর্তে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও গবেষণারত মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৬০। চিন ও ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মৈত্রী স্থাপনে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য চীনা ভবন-কে ‘পঞ্চশীল’ স্মারক সম্মান দিয়েছে চিন। গত ১৫ বছরে চীনা ভবন ভারত ও চিনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক মানের আলোচনাচক্র। চিনের ইউনান ও বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়, সাংহাই গ্রন্থাগারের সঙ্গে চলছে শিক্ষা-সংস্কৃতির আদান-প্রদান। সাংহাই গ্রন্থাগার বছরে একশোটি করে বই উপহার দিচ্ছে চীনা ভবন গ্রন্থাগারকে। সমকালীন চিনা সাহিত্য, চিনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, অর্থনীতি ও বিদেশনীতির বিষয়ে পঠনপাঠনের জন্য বহু মূল্যবান গ্রন্থ সংগৃহীত হয়েছে। চীনা ভবনের দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাগারটির আধুনিক রক্ষণাবেক্ষণের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে।

গত পনেরো-বিশ বছরে চিনের আবহাওয়া বদলেছে। মুক্ত উদারনীতির পালে হাওয়া লেগেছে, চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যও বেড়েছে লাফিয়ে। আবার উলটো দিকে, অরুণাচল প্রদেশ, ডোকলাম নিয়ে দুই দেশের রাজনীতি-কূটনীতির পরিসরেও মাঝেমধ্যেই ঘনাচ্ছে কালো মেঘ। এই সমস্ত কিছুর মধ্যেই, শান্তিনিকেতনে চীনা ভবন পেরিয়ে এসেছে গৌরবময় আশি বছর। ডোকলামের বাজারে ভারতীয়রা খেয়াল রাখেনি, চিন মানে শুধুই শত্রু নয়। আশি বছর আগেই শান্তিনিকেতনের মাটিতে সেই চিনের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত এক শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীন স্বপ্নের শরিক।

ছবি সৌজন্য: রবীন্দ্রভবন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE