মে ঘনাদ ভট্টাচার্য ‘বধূতন্ত্র’ নামিয়েছেন। ‘দায়বদ্ধ’ আর ‘বাসভূমি’ করে তখন তিনি রীতিমত স্টার। নাটক দেখতে লোকের সে কী লাইন! জলের লাইন, কেরোসিনের লাইন সব হার মেনে যায়। ‘বধূতন্ত্র’ শুরু হওয়ার ক’দিন পর এক দিন আমার দোকানে চা খেতে এলেন। খানিকটা ইতস্তত ভাব নিয়েই বললাম, একটা কথা বলব? উনি বললেন, বলুন না। সাহসে ভর করে বলেই দিলাম, আপনার ‘বধূতন্ত্র’ চলবে না। কিছুু ক্ষণ হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে মেঘনাদবাবু বললেন, কী করে বুঝলেন চলবে না? নাটকটা দেখেছেন? এ বার বেশ উত্তেজিত হয়ে বললাম, দেখেছি যে শুধু তা-ই নয়, মোটামুটি সব নাটকই দেখি। বুঝলাম উৎসাহ পেয়েছেন। বললেন, কিন্তু না-চলার কারণটা কী? বললাম, অত ভেঙে তো বলতে পারব না, তবে এ নাটক বাঙালি দর্শক খুব একটা নেবে না।
‘বধূতন্ত্র’ কিন্তু সত্যিই খুব একটা চলেনি। এর পর মেঘনাদবাবু ‘সাঁঝবেলা’ নামালেন। এক দিন আমার দোকানে এসে চা খেয়ে বললেন, আমি নতুন নাটক নামিয়েছি। এই নিন টিকিট। নাটক দেখে কিন্তু আমাকে জানাতে হবে কেমন হয়েছে। আমি তো বেজায় খুশি। আনন্দ আর ধরে না। হলে ঢুকে সিটে বসতে গিয়ে তো একেবারে থ। এ যে দেখি একেবারে ‘এ’ রো-র টিকিট! উনি আমাকে দর্শক হিসেবে এতটা গুরুত্ব দিয়েছেন দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল।’
কথাগুলো বলছিলেন হরেনবাবু। গিরীশ মঞ্চের ঠিক উলটো দিকেই হরেন আর আরতি দত্তের চায়ের দোকান। তবে নাটকপাগল হরেনবাবু দিন-রাত থিয়েটারেই মজে থাকেন। দোকান চালান স্ত্রী আরতি। যদিও এখন হাঁটুর ব্যথা চাগাড় দেওয়ায় তিনিও দোকানে নিয়মিত বসতে পারেন না। দোকানের ভার মেয়ে ইন্দ্রাণীর হাতে। তা তিনিও নাটকেরই মেয়ে। ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’ দলে এক সময় অভিনয়ের তালিম নিয়েছেন।
সন্ধে নামলে দোকানের বাইরে একটা টুল পেতে বসেন আরতি। নাটকে আগ্রহী কাউকে পেলেই শুরু করে দেন আড্ডা। ‘থিয়েটার হল-এর লাগোয়া দোকান, কত অভিজ্ঞতা যে রয়েছে ঝুলিতে, শেষ হওয়ার নয়। নাটক ছাড়া অন্য কিছু এখন আর ভালও লাগে না। আজ দেখলেন তো, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত কাউন্টারে বসে ‘নাচনী’র টিকিট বিক্রি করছেন। এই বয়সেও উনি কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করছেন এ দেখলে মন ভাল না হওয়ার উপায় আছে বলুন?’ আপনাকে চেনেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত? ‘চেনেন না মানে?’ আরতি বলেন, ‘আমাকে বউমা বলে ডাকেন!’ তার পর গর্বের সুরে বলেন, ‘জানেন, ওঁর রিহার্সালে বাইরের কারও ঢোকা একদম নিষেধ, একমাত্র ও ছাড়া?’ ‘ও’ মানে হরেনবাবু। রুদ্রবাবু জানেন, হরেনের যাওয়া মানেই আর এক প্রস্থ চা। আরতি আরও জানান, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে হরেন দত্ত অভিনয় করেছিলেন। তা ছাড়া, কত যাত্রা-থিয়েটারে অভিনয় করেছেন, লেখাজোখা নেই।
‘একটা মজার গল্প বলি শুনুন’, হাঁক মেরে মেয়েকে দুটো চা দিতে বলে বেশ জমিয়ে শুরু করেন আরতি, ‘এক দিন সকালবেলা হঠাৎ হইহই করে এক দঙ্গল লোক সঙ্গে করে হাজির বিভাস চক্রবর্তী। এমনিতে আমাদের দোকানে সকালের দিকে ভিড়ভাট্টা তেমন থাকে না। শো থাকলে দুপুরের দিকে লোকের আনাগোনা শুরু হয়। প্রথমে দলের লোকেরা সেটের মালপত্র নিয়ে আসে, তার পর আসেন অভিনেতারা। সন্ধের দিকে দর্শকদের ভিড়। শো ভাঙলে আর এক প্রস্থ ভিড়। কিন্তু সাতসকালে নাটকের প্রশ্নই নেই, ফলে তোড়জোড়ের ব্যাপারও নেই। এমনই সময় দল জুটিয়ে বিভাসবাবু এসে হাজির। আমরা অপ্রস্তুত। তাড়াতাড়ি চায়ের জল চাপালাম। ও মা, উনি দেখি আমাদের দোকানের ভিতরে পাথরের স্ল্যাবটায় শুয়ে পড়লেন। দলের অন্যরা অবাক! কী করছেন, ও বিভাসদা? দুটো হাত মাথার নীচে রেখে বিভাসবাবু বললেন, ‘ওরে, এটা আমার আর একটা বাড়ি রে।’ ভেবে দেখুন, কতটা আপন ভাবলে তবে এমন করতে পারেন।’
হালের নাট্যব্যক্তিত্বরা আসেন না? ‘সবাই আসেন। ব্রাত্য বসু তো আমাকে বউদি ডাকেন। একেবারে ঘরের লোকের মতো। বলেন, আমাকে এটা করে দিতে হবে, ওটা করে দিতে হবে। শুনতে ভালই লাগে।’
ল্যান্সডাউন পদ্মপুকুর লাগোয়া মৃণাল সেনের চার তলার ফ্ল্যাটবাড়ির উলটো দিকে বিহার থেকে আসা চা-বিক্রেতার স্টল। চা বিক্রি করেন, আর মৃণালবাবুর কথা বলতে গিয়ে গর্বে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘ওঁর সঙ্গে কথা হয়?’ ‘আগে হত, তখন নিয়মিত বেরোতেন, কেমন আছি জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু ক’মাস আগে পড়ে গিয়ে হাড় ভেঙে গেল, অপারেশন হল, তার পর থেকে আর বেরোন না। আপনারা কি দেখা করতে যাবেন?’
বললাম, সে রকমই ইচ্ছা আছে। ‘তা হলে কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে, দুপুরবেলা উনি ঘুমোন। এক কাজ করুন, একটু পরেই এক জন মহিলা আসবেন, দেখাশোনা করেন। ওঁকে বলে রাখুন, উনি ব্যবস্থা করে দেবেন।’
ছবি: সুমন চৌধুরী।
তপন থিয়েটার লাগোয়া ফুটপাতেই চায়ের দোকান দীপা দেবীর। আর সেই দোকান ঘিরেই নাট্যরসিকদের যাবতীয় আড্ডা, মুহুর্মুহু চায়ে চুমুক। কোন নাটক কেমন হয়েছে, কতটা দর্শক টানছে, কাদের কাউন্টারে সেল কত, সব দীপার নখের ডগায়। চাইলেও দোকান বন্ধ রাখবার জো নেই তাঁর। নাট্য প্রযোজক সমর দত্ত, হলের মঞ্চসজ্জার দায়িত্বে থাকা অজিতবাবু, বিভিন্ন দলের কলাকুশলী, সবার সঙ্গেই এক তারে বাঁধা পড়ে গিয়েছেন তিনি।
বিয়ের অল্প ক’বছরের মধ্যেই স্বামী মারা যান। একরত্তি মেয়েকে নিয়ে অথই জলে পড়লেন দীপা। দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর, ঠিক তখনই, ২০০৪ সালের ১ ডিসেম্বর, খুলল তপন থিয়েটার। পরিচিত এক জন পরামর্শ দিলেন, হলের সামনে চায়ের দোকান খুলে বসতে। কিন্তু পুঁজি কোথায়? সাহায্যের হাত বাড়ালেন হল-কর্মীরা। তাঁরাই কাঠামো বেঁধেছেঁদে একটা দোকানের চেহারা এনে দিলেন। কিন্তু চা বানানোর সরঞ্জাম? বাড়ির রান্না মিটে গেলে সেই বাসনপত্রই দোকানে নিয়ে আসতেন দীপাদেবী। তাই দিয়েই সারা দিনের চায়ের জল চাপানো, দুধ জ্বাল দেওয়া।
প্রথম দিনই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাটক। অজিতবাবু বললেন, চিনি ছাড়া লিকার করে দিতে পারবেন? দাদা ওই চা পছন্দ করেন। ‘তখন সৌমিত্রবাবুর চা আসত রাসবিহারীর মোড়ের একটি দোকান থেকে। স্পেশাল চা বানিয়ে দিলাম। ব্যস, সবাই খুশি। বুঝলাম, উতরে গিয়েছি। দাদা খুব কম কথা বলেন, তবে ওঁর মেয়ে পৌলোমী আমাকে বউদি ডাকে। নাটক থাকলেই বলে, বউদি চা দাও। শুরুর সেই সময় তো মাধবী মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবীরাও অভিনয় করতেন। ওঁদেরও চা খাওয়াতাম। তাপস সেন আসতেন। আমার দোকানে চা না খেয়ে উনি হলে ঢুকতেনই না। আর আসতেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। বোধহয় শেষ চা-টা আমার হাতেই খেয়েছিলেন। অমন মাটির মানুষ আমি আর দেখিনি। বিভাস চক্রবর্তীও আমাকে খুব ভালবাসেন। এক বার হলে ঢুকতে গিয়ে বললেন, আরে, দীপার হাতে চা না খেয়ে তো ভিতরে ঢুকতেই পারব না।’
গিরীশ মঞ্চ-লাগোয়া আরতির দোকানে এখন বসেন তাঁর মেয়ে। ও দোকানই চালাবে, চাকরি করবে না? আরতি বললেন, ‘করত তো, স্টিফেন কোর্টে। তার পর সেই আগুন লেগে ওদের অফিসটাই পুড়ে গেল। তখন থেকে দোকানেই বসে। ও তো নাটকের দলে ছিল, ছোটবেলা থেকে নাটক দেখে বড় হয়েছে, তাই থিয়েটারের লোকজনের চা-চাহিদাও বোঝে। ওর নাটকপাগল বাবা তো ব্যবসায় সময় দিতে পারে না। আমারও বয়স হচ্ছে। হাঁটু-কোমরের ব্যথা বাড়ছে। ওকেই এখন দোকানের দায়িত্ব সামলাতে হয়। ভালই তো।’
ভালই। সব ঠিকই তো আছে। ব্যাটনটা শুধু পালটে যায়, এই যা।
ddasgupta122@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy