Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

মিনি-কাজিরাঙার অরণ্যদেব

ব্রহ্মপুত্রের ধু-ধু বালুচরে পরম যত্নে লাগাতেন গাছের চারা। চল্লিশ বছর পর সেখানে এখন সাড়ে পাঁচশো হেক্টর সবুজ অরণ্য, হাতি, বাঘ, গন্ডার, বন্যপ্রাণের আশ্রয়। যাদব পায়েং আর এক সবুজ বিপ্লবের নাম।ব্রহ্মপুত্রের ধু-ধু বালুচরে পরম যত্নে লাগাতেন গাছের চারা। চল্লিশ বছর পর সেখানে এখন সাড়ে পাঁচশো হেক্টর সবুজ অরণ্য, হাতি, বাঘ, গন্ডার, বন্যপ্রাণের আশ্রয়। যাদব পায়েং আর এক সবুজ বিপ্লবের নাম।

সহাস্য: স্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলছেন যাদব পায়েং। ছবি: পরীক্ষিৎ শইকিয়া

সহাস্য: স্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলছেন যাদব পায়েং। ছবি: পরীক্ষিৎ শইকিয়া

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

তখন রাজ্য জুড়ে উত্তাপ। রক্ত-বারুদে মাখামাখি অসমের মাটি। সেই সব থেকে দূরে, ছোট্ট মোলাই তার গরুর পাল নিয়ে রোজ পাড়ি দেয় ব্রহ্মপুত্রের চর থেকে চরে। ছোট্ট মোলাই শুনে আসছে, বালুচর বন্ধ্যা। তবু কিশলয় মন পরম যতনে চারা পুঁতে আসে বালির বুকে। হয়তো বা সেই আদরের পলির হাতযশ, তাই চারা এক দিন গাছ হয়ে ওঠে। ওই একটা গাছ কিশোরের মনে বাগান গড়ার স্বপ্ন দেখায়।

বছর কয়েকের মাটি কামড়ে থাকা চেষ্টায় সেই বাগানও হল। আর তার পরেই এল বান। ধুয়েমুছে গেল সবুজের সব চিহ্ন। কিন্তু তত দিনে মোলাই জেনে গিয়েছে জঙ্গল গড়ার মন্ত্র। তাই সবার চোখের আড়ালে শুরু হয় তার জঙ্গল গড়ার একলা কারখানা।

চল্লিশ বছর পার হয়েছে। সেই পাঁচশো হেক্টরের জঙ্গলের নাম এখন মোলাই কাঠনিবাড়ি।

বালি থেকে বন গড়ে ফেলা সেই একলা বিপ্লবীর ঊর্ধ্বাঙ্গে কখনও স্যান্ডো গেঞ্জি, কখনও ময়লা জামা। সর্বদা কোমরে কষে বাঁধা গামছা। পায়ে জুতোর বালাই নেই। মাটি ছুঁয়ে থাকে তাঁকে। তিনি ছুঁয়ে থাকেন গাছ— তাঁর একমাত্র হাতিয়ার। সেই হাতিয়ারে ভরসা করে, একলা মানুষটি ঘটিয়ে ফেলেছেন বিপ্লব। যে বিপ্লবের রং সবুজ।

যাদব পায়েং, ওরফে মোলাই। চার দশক ধরে, ব্রহ্মপুত্রের বন্ধ্যা বালুচরে লক্ষাধিক গাছকে লালন করে সাড়ে পাঁচশো হেক্টরের অরণ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। অবশেষে তাঁর ঝুলিতে এসেছে ‘পদ্মশ্রী’। বিস্তর সংবর্ধনা, সম্মাননা জুটছে এখন। সাফসুতরো পোশাক, পায়ে জুতো পরে আসতে হচ্ছে সভায়। কিন্তু বেপরোয়া মনটা এখনও বাগ মানেনি। তাই ইনামের পরোয়া না করে যাদব পায়েং মুখের উপর মন্ত্রীর সমালোচনা করেন। বনকর্তাদের ডাকনাম দেন ‘তুঘলক’।

উজানি অসমের যোরহাট জেলার উত্তর-পশ্চিমে কোকিলামুখের কাছে অরুণা চাপোড়িতে তাঁর বাস। বাড়ি থেকে ছোট্ট নৌকায় ছ’কিলোমিটার গেলেই মিলবে যাদববাবুর জঙ্গল ওরফে ‘মিনি-কাজিরাঙা’।

আরও পড়ুন: দুশো বছর পেরিয়ে এসেছে ব্রহ্মসঙ্গীত

পঞ্চাশ পার-করা যাদববাবু সেই ছোটবেলা থেকে, যোরহাটের উত্তর-পশ্চিমে, ব্রহ্মপুত্রের বালুচরে গরু চরাতে যেতেন। দেখতেন, খাদ্যের অভাবে গবাদি পশু কী ভাবে চর থেকে চরে ঘুরে বেড়ায়। কিশোর যাদব তখন ভাবত, বালুচরে ঘাসজমি গড়ে তুললে বড় ভাল হয়। ১৯৭৯ সালে বন দফতর প্রথম বার বনসৃজন প্রকল্পের জন্য ঠিকা ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করে। যাদবও সেই দলে ভিড়ে যায়। বাকিরা গাছ পোঁতা শেষে ফিরে যায়। একাই বৃক্ষরোপণ করতে থাকে যাদব। তখনই ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় ভেসে যায় যাদবদের গ্রাম ও আশপাশের সব লোকালয়।

যাদব স্মৃতিচারণ করেন, “জল নামতেই চারপাশে যেন আগুনের হলকা। শয়ে-শয়ে মরা সাপ বালিচরে আটকে। গবাদি পশু গরমের ঠেলায় জলে ঝাঁপ দিচ্ছে। কোথাও কোনও ছায়া নেই। ঠিক করি, বালির চরে ছায়া দেওয়া গাছের আশ্রয় বানাব।” লোকে বলে বালির চর বন্ধ্যা। তাতে সবুজ ফলে না। কিন্তু কৃষি বিজ্ঞানী যদু বেজবরুয়ার উৎসাহে, বালির বুকেই তিনি লাগাতে শুরু করেন ঘাস। নিয়ে আসতে থাকেন বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা। কেউ মরে, কেউ বা বেঁচে যায় প্রকৃতির আপন খেয়ালে।

এ ভাবেই কেটে যায় তিন দশক। তত দিনে, বালুচর পরিণত হয়েছে সাড়ে পাঁচশো হেক্টরের জঙ্গলে! সেই জঙ্গলের একলা সৃষ্টিকর্তা যাদব ততদিনে চল্লিশোর্ধ্ব। বিয়ে হয়েছে। এসেছে দুই সন্তান। কিন্তু জঙ্গলেই পড়ে থাকেন তিনি। স্থানীয় মানুষ সেই জঙ্গলের নাম দিয়েছে ‘মোলাই কাঠনিবাড়ি’।

যোরহাট থেকে মাজুলি অবধি ঘোরাফেরা করা হাতির পাল প্রথম সেই জঙ্গলকে সরকারের চোখে ফেলল। বনরক্ষীরা দেখেন, মাজুলি থেকে যোরহাট আসার পথে বেশ কিছু দিনের জন্য হাতির পাল কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের পিছে ধাওয়া করেই দেখা গেল ব্রহ্মপুত্রের বুকে এক সবুজ দ্বীপ, যার অবস্থান মানচিত্রে নেই! খবর গেল উপরমহলে। তলব হল যাদববাবুর। তাঁর নিরলস বন গড়ার গল্প শুনে রেঞ্জার হতবাক। কেবল হাতি নয়, তত দিনে সেই অরণ্যে নিশ্চিন্ত আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে বুনো মোষ, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, সাপ, পাখি এবং সপরিবার রয়্যাল বেঙ্গল। এমনকী এসেছে গন্ডারও!

এ বার সমস্যা, অরণ্য তুমি কার? উদার যাদববাবু নিজের সন্তানসম এই অরণ্যকে সানন্দে বনবিভাগের হাতে তুলে দিতে রাজি। তাঁর আর্জি, কাঠনিবাড়িতে গড়া হোক চেক-পোস্ট। সুরক্ষিত হোক সেখানে আশ্রয় নেওয়া বন্যপ্রাণ। কিন্তু মানচিত্রে যা বালুচর, সরকারি ভাবে তাকে অরণ্য হিসাবে মানতে চায় না বনবিভাগ। তাই সরকারি সুরক্ষা মেলে না।

তত দিনে আশপাশের চরের গ্রামবাসীরা ক্ষিপ্ত। গো-পালনের পথে থাকা বালুচরকে জঙ্গল বানিয়ে বাঘ টেনে আনায় সব গ্রামবাসী যাদববাবুকে একঘরে করে দেন। তবু পরোয়া করেন না তিনি। হাতির পাল গ্রামের বাড়ি ভাঙে। আশপাশের গ্রামবাসীরা এসে গাছ কাটে। বাধা দিলে মেলে ‘জানে মেরে ফেলব’ হুমকি। তবু দমেন না যাদব। কাজিরাঙা থেকে আসা গন্ডার চরের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। পিছু ধাওয়া করে আসা শিকারির দল গন্ডার মেরে খড়্গ নিয়ে যায়। একাকী অসহায় যাদব নিষ্ফল ক্রোধে নিজে তিন দিন মুখে অন্ন তোলেন না।

২০১২ সালে, ‘মিনি-কাজিরাঙা’র সৃষ্টিকর্তা যাদব পায়েং ওরফে মোলাইকে ‘ফরেস্ট ম্যান অব অসম’ সম্মানে ভূষিত করে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। এর পর রূপকথা! রাষ্ট্রসঙ্ঘের আমন্ত্রণে রীতিমতো বিমানে চেপে প্যারিস পাড়ি। সেই প্রথম বার যোরহাটে গিয়ে কিনলেন বুটজুতো। ‘ফরেস্ট ম্যান’-এর জীবন ফ্রেমবন্দি করেছেন জাতীয় পুরস্কারজয়ী পরিচালক তমাল দাশগুপ্ত। কিন্তু, খুঁটির উপরে চাং-ঘরে সপরিবারে থাকা যাদববাবু সাফ বলেন, “প্যারিস থেকে সুইৎজারল্যান্ডের পথে যে বৈচিত্র, তার চেয়ে ঢের বেশি জীববৈচিত্র রয়েছে নিমাতি থেকে মাজুলি যাওয়ার পথে।”

পদ্মশ্রী পাওয়ার পরে ব্যস্ততা বেড়েছে। কিন্তু মাটির টান কমছে না। যাদববাবুর পানসি নিত্যদিন চলে মিনি-কাজিরাঙার উদ্দেশে। একটি চরকে অরণ্য বানিয়ে থামেননি যাদব। অন্য চরেও হাত বাড়িয়েছেন। এক জীবনে, একা হাতে একটা জঙ্গল গড়াই তো চরম প্রাপ্তি। কিন্তু, মোলাই অন্য ধাতুতে গড়া। এ বার তাঁর পরিকল্পনা— ডিব্রুগড় ও ধেমাজি জেলার ৩৭ নম্বর ও ৫২ নম্বর জাতীয় সড়কের দুই পাশে গাছ লাগাতে হবে। কারণ, রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে বিস্তর গাছ কাটা পড়েছে। ইতিমধ্যেই এই পরিকল্পনায় সাহায্যের ভরসা দিয়েছে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশমন্ত্রক। ভরসা দিয়েছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও।

যাদব থামতে জানেন না। বলেন, “ভারতের কোথাও জঙ্গল গড়ার ডাক পেলেই ছুটে যাব আমি। গোটা বিশ্ব আমার ঘর। তাকে সবুজ দিয়ে সাজাতে হবে।” এখানে কোনও স্বার্থ নেই। নেই পুরস্কারের প্রত্যাশা বা অর্থানুকুল্যের সুযোগ। স্ত্রী বিনীতা, তেরো বছরের ছেলে সঞ্জয় আর আঠারো বছরের মেয়ে মুনমুনি— সবাই এখন তাঁর পথেরই পথিক।

শহুরে পাঠ্যক্রমের কাছে যাদবের আর্তি, স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে সব ছাত্রছাত্রীর জন্য একটি গাছের চারা পোঁতা বাধ্যতামূলক করা হোক। দশম শ্রেণি অবধি সেই গাছকে লালন-পালন করতে হবে পড়ুয়াদের। গাছের যত্নে জড়িয়ে দেওয়া হোক নম্বরের হাতছানি। গাছ বাঁচানোর শিক্ষা পাওয়া ছেলেমেয়েরা বাকি জীবন গাছ ধ্বংসের কথা মনেও আনবে না।

এত বড় সম্মান পেলেন, সরকার নিশ্চয়ই সাহায্যের ঝুলি নিয়ে হাজির হবে। কিছু সাহায্য চাইবেন না? পায়েং-এর সপাট জবাব, “বনমন্ত্রীর অনুরোধে আমি জঙ্গল বানাইনি, তাই তাঁর কাছে কিছু চাওয়ারও নেই। মন্ত্রীর মেয়াদ ৫ বছর। আর আমি ৪০ বছর ধরে জঙ্গলকে লালন করছি।”

পায়েং-এর ক্ষোভ, মন্ত্রীরা নিজেরা কখনও মাটিতে নেমে দেখেন না, বাস্তবটা কী। বরং ‘মহম্মদ বিন তুঘলক’দের হাতে দেদার টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। তারা সেই টাকা নয়ছয় করছে। মাজুলিতে ক’টা চর আছে, কোথায় কী উদ্ভিদ রয়েছে, তার প্রামাণ্য মানচিত্রই বনবিভাগের হাতে নেই। ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতি আর প্রকল্পসর্বস্ব বনকর্তাদের কাছে তাঁর কোনও প্রত্যাশা নেই। তিনি বলেন, “ভোটের আগে মানুষের জন্য ৩ টাকা কিলো চালের কথা ভাবা হয়। কিন্তু, হাতিদের জন্য পর্যাপ্ত গাছের সংস্থান করলে তারা যে আর লোকালয়ে হানা দেবে না, সেই কথা কোনও দলই ভাবছে না।’’

কোনও দিন সেই দ্বীপে আসে স্কুলের ছেলেমেয়েরা, কখনও উৎসাহী পরিবেশপ্রেমী। গাছের গায়ে হাত বোলাতে-বোলাতে এগিয়ে চলেন মোলাই। বলতে থাকেন একটি চারা থেকে আস্ত অরণ্য গড়ে তোলার অলীক কাহিনি। শহরের দিকে পা-বাড়ানো নাগরিক সাংবাদিকের দিকে হাত বাড়ান অরণ্যদেব। কলম-ক্যামেরা সামলে, মাটি লেগে-থাকা হাত ধরতে সঙ্কোচে খানিক দেরি হয়। তিনি সবই বোঝেন। তাই কারও কাছে তাঁর কোনও দাবি নেই। তাঁর ভরসা শুধুই সবুজে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE