Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শিলঙের ছেলে তৈরি করলেন এটিএম

শেফার্ড ব্যারন তখন লন্ডনে। সেই সময় সপ্তাহে এক বার মোটে ব্যাঙ্ক থেকে পাউন্ড তোলা যেত। তাঁর আবিষ্কার দূর করে দিল সেই অসুবিধা। এ বার যখন-তখন মেশিন থেকে টাকা। সায়ন্তনী ভট্টাচার্য শেফার্ড ব্যারন তখন লন্ডনে। সেই সময় সপ্তাহে এক বার মোটে ব্যাঙ্ক থেকে পাউন্ড তোলা যেত। তাঁর আবিষ্কার দূর করে দিল সেই অসুবিধা। এ বার যখন-তখন মেশিন থেকে টাকা। সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

হাতেখড়ি: শেফার্ড ব্যারন-এর আবিষ্কৃত এটিএম-এর উদ্বোধনে রজার ভার্নি ও অন্যরা

হাতেখড়ি: শেফার্ড ব্যারন-এর আবিষ্কৃত এটিএম-এর উদ্বোধনে রজার ভার্নি ও অন্যরা

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ওটাকে হাঁটা বলে না। প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছিলেন তিনি। হাতে আর মাত্র কয়েক মিনিট। এ দিকে ঘড়ির কাঁটাও যেন রেস লাগিয়েছে।

যে ভয়টা পেয়েছিলেন ব্যারন, সেটাই হল। পৌঁছে দেখেন, ব্যাঙ্কের দরজায় তালা পড়ছে। পাক্কা এক সপ্তাহ পরে এ-মুখো হওয়ার নোটিস ঝুলছে সদরে।

সালটা ১৯৬৫। লন্ডন। কাহিনির নায়ক, বছর চল্লিশের শেফার্ড ব্যারন, পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে যা বললেন, তা আর এখানে কহতব্য নয়।

না। সে বছর মহারানির দেশে কোনও নোট বাতিল হয়নি। এমন ফতোয়াও জারি হয়নি, যার জেরে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারও ধারে সংসার টানছে। আসলে তখন ব্যাঙ্কের লেনদেনের নিয়মটাই ছিল অন্য রকম। প্রতি সপ্তাহে একমাত্র শনিবার করেই গ্রাহকদের পাউন্ড তুলতে দেওয়া হত। মানে, সপ্তাহের ওই দিনটিতে কোনও কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাঙ্কে মুখ দেখাতে না পারলে, নিজের হকের পাউন্ড পকেটস্থ করতে পাক্কা আর এক সপ্তাহের ধাক্কা।

মিনিট খানেক বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকার পর গুটিগুটি পায়ে ঘরমুখো হন ব্যারন। কিন্তু ব্যাঙ্কের ভূত আর মাথা থেকে নামে না। বাড়ি ঢুকেই সোজা বাথরুম। বেশ টের পাচ্ছিলেন, খানিক জল না ঢাললে মাথা ঠান্ডা হবে না।

সেই মতোই বাথটবে নেমে উষ্ণ গরম জলে এলিয়ে দিলেন শরীরটা। মনে ভাবনা, ব্যাঙ্ক থেকে পাউন্ডগুলো পাওয়ার কি কোনও উপায়ই নেই তবে? চোখ বুজে এ কথা-সে কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হল, ইস, মার্কেটের ওই চকোলেট বার কাউন্টারগুলোর মতো যদি পাউন্ডেরও বার কাউন্টার হতো! কী রকম কয়েকটা পেনি ফেললেই, চকোলেট বেরিয়ে আসে। যদি উলটোটাও হত!

যদি হত কেন, হতেই তো পারে। বিদ্যুতের গতিতে মাথায় খেলে গেল কথাগুলো।

আর্কিমিডিসীয় চালে ‘ইউরেকা’ বলে লাফিয়ে উঠেছিলেন কি না ব্যারন, ইতিহাসে লেখা নেই। তবে আইডিয়াটা বেশ মনে ধরেছিল তাঁর। মনে মনে ঠিকও করে ফেলেছিলেন, কিছু একটা করতেই হবে।

সে বছরই পরের দিকে এক দিন লাঞ্চ করতে বেরিয়ে রাস্তায় ধাক্কা লাগল বার্কলে ব্যাঙ্কের চিফ জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দু’মিনিটও খরচ করেননি ব্যারন। রাস্তাতেই সটান প্রস্তাবটা পেড়ে ফেলেন। রাশভারী ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে জানিয়ে দেন, ‘সোমবার দেখা করুন।’

দেখা হল। কথাও হল। ব্যারনের পরিকল্পনাটা মনেও ধরল ম্যানেজারের। ছ’টি ক্যাশ মেশিন বসল ব্যাঙ্কের গা ঘেঁষে। ব্যারনকেই দায়িত্ব দেওয়া হল তদারকির। ১৯৬৭ সালের ২৭ জুন উত্তর লন্ডনের এনফিল্ড-এ প্রথম এটিএম-এর উদ্বোধন করলেন অভিনেতা রজার ভার্নি। ১০ পাউন্ড তুলেছিলেন তিনি।

ধীরে ধীরে ব্যাপারটা এমন হল, সপ্তাহে সাত দিন ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকবে এটিএম। পাউন্ড তোলার অঙ্কটা বেঁধে দেওয়া হল। পদ্ধতিটা অবশ্য এখনকার মতো ছিল না।

বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে ছিলেন ব্যারন। নিজের সেনা-নম্বরটা মাথায় রেখে এটিএমের পিন প্রথমে ৬ সংখ্যার করেছিলেন ব্যারন। কিন্তু এক দিন রান্না করতে করতে স্ত্রী বললেন, ছ-ছ’খানা নম্বর মনে রাখা অন্তত তাঁর কম্ম নয়। বড়জোর চারটে নম্বর মনে রাখতে পারবেন তিনি। তা হলে উপায়? ৬ অঙ্কের পিন কমিয়ে ৪ অঙ্কের করে দিলেন ব্যারন।

তখনও ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ দেওয়া প্লাস্টিক কার্ড তৈরি হয়নি। ব্যারন যে যন্ত্র বানিয়েছিলেন, তা থেকে পাউন্ড তুলতে বিশেষ ধরনের চেক নিয়ে যেতে হত। C-14 (কার্বন-১৪) দিয়ে রাসায়নিক কোড দেওয়া এক ধরনের চেক। ক্যাশ-যন্ত্রের ড্রয়ারে চেকটা রাখলে যন্ত্র ওই রাসায়নিকটিকে চিহ্নিত করত প্রথমে। পরে পিন দিলে যন্ত্র চেকের সঙ্গে পিন মিলিয়ে পাউন্ড বের করে দিত। এক বারে ১০ পাউন্ডের বেশি তোলা যেত না। সে কালে ১০ পাউন্ডও অনেক!

পরে অবশ্য ওই চেক নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। কার্বন-১৪ সামান্য হলেও তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক। ব্যাপার জানাজানি হতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অভয় দিয়ে ব্যারন জানান, অমন ১ লক্ষ ৩৬ হাজারটি চেক গিলে ফেললে তবেই কোনও লোক অসুস্থ হতে পারে। তার
আগে নয়।

কালে কালে আমূল বদলে গিয়েছে এটিএম। চেকের বদলে এসেছে প্লাস্টিক কার্ড। ব্যারনেরই সমসাময়িক এক মার্কিন ইঞ্জিনিয়ার ডোনাল্ড ওয়েটজেল বানান প্রথম আধুনিক ম্যাগস্ট্রাইপ মেশিন। কিন্তু এটিএম-এর স্রষ্টা হিসেবে রয়ে গিয়েছে জন্মসূত্রে ভারতীয় শেফার্ড ব্যারন-এর নামই। ১৯২৫ সালে ২৩ জুন শিলংয়ে জন্ম জন অড্রিয়ান শেফার্ড-ব্যারন’এর। বাবা উইলফ্রিড ব্যারন ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। বড় হয়ে ব্রিটেনে চলে যান ব্যারন। এডিনবরা ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা।

তার পর, মাত্র ৪০ বছর বয়সে এটিএম সৃষ্টি করলেন তিনি।

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

John Shepherd-Barron ATM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE