Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সর্বস্ব দিয়েও কী পেলেন বিদেশিনী নিবেদিতা

স্বজাতির বিরক্তি, ভারতীয়দের অবহেলা। নিঃশব্দে তা মেনে নিয়ে, ভারতের সুখদুঃখে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ২৮ অক্টোবর তাঁর জন্মদিন, পূর্ণ হচ্ছে তাঁর জন্মের দেড়শো বছর।স্বজাতির বিরক্তি, ভারতীয়দের অবহেলা। নিঃশব্দে তা মেনে নিয়ে, ভারতের সুখদুঃখে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ২৮ অক্টোবর তাঁর জন্মদিন, পূর্ণ হচ্ছে তাঁর জন্মের দেড়শো বছর।

নিবেদিতা

নিবেদিতা

শংকর
শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

কু-ইংরেজ ও সু-ইংরেজ কথা দু’টি পরাধীনতার শেষ দশকে প্রায়ই শোনা যেত। আমার প্রতিবেশী ও বাল্যসখা, কালামাজু লুজলিফ কোম্পানির কেরানি বাদলকাকু বলতেন, সায়েব যখন খারাপ হয় তখন সে দুনিয়ার ওঁচা, আর সায়েব যখন ভাল হয়, বিশ্বসংসারে তার তুলনা নেই। যেমন কাকুর লিভিংস্টোন সায়েব অন্তর থেকে চাইতেন, ইন্ডিয়ার মোহনবাগান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবল টিম হোক।

সাতচল্লিশের স্বাধীনতার সময় বাদলকাকু বলতেন, দুঃখ একটাই, কু-ইংরেজের সঙ্গে সু-ইংরেজগুলোও দেশছাড়া হবে। তার পরে কয়েক বছরের ব্যবধানে, ওল্ড পোস্টাপিস স্ট্রিটের আদালতি কর্মক্ষেত্রে এ দেশের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার নোয়েল বারওয়েলকে আবিষ্কার, যিনি এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইলেন না এবং তাঁর ভারতপ্রেমিকা স্ত্রী ম্যারিয়ন বারওয়েল স্বামীর এই সিদ্ধান্তে ভীষণ খুশি হলেন।

আরও পড়ুন: বিশ্ববাংলা, নামমাত্র

কিন্তু সেই সময় চোখ খুলল, সায়েবের সিনিয়র বাবু বিভূতিদা দুঃখ করতেন, যে সব সায়েব আমাদের ওপর অত্যাচার করল তাদের আমরা লক্ষ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দিলাম সেলাম ঠুকতে ঠুকতে, আর যাঁরা আমাদের ভালবাসলেন অকারণে, আমাদের কাছে টানতে চাইলেন, তাঁদের আমরা দিলাম অকারণ কষ্ট। বারওয়েল সায়েবের ছাত্রজীবনের বন্ধু দীনবন্ধু অ্যান্ডরুজের কথা উঠত। কলকাতায় কেমব্রিজ ডিনারে নিমন্ত্রিত হয়ে তিনি না বললেন, কারণ প্রত্যাশিত ডিনার জ্যাকেট তাঁর নেই। শেষ পর্বে দেহাবসানের আগে দীনবন্ধুর যৎসামান্য যা ছিল তা উইল করবার জন্য তিনি বন্ধু নোয়েলকে হাসপাতালে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ভারতীয়দের অধিকার রক্ষার জন্য স্বার্থপর সায়েবদের বিরুদ্ধে ব্যারিস্টার বারওয়েল নিজে মামলা করেছিলেন, ফলে কলকাতার বিরক্ত ইংরেজ ব্যবসায়ীরা তাঁকে বর্জন করেছিলেন, আর ঠিক একই সময়ে ‘নতুন স্বদেশি’রা ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের সরকারি কাজ থেকে বঞ্চিত করে আর্থিক অনটনে ফেলেছিলেন। এর কিছু দিন পরেই আর এক জন সু-ইংরেজ, প্রাক্তন আইসিএস আর্থার হিউজ-এর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল সেকেন্ড ক্লাসের ট্রামে, খরচ বাঁচিয়ে কয়েক জন অনাথ বালককে মানুষ করবার জন্যে তিনি যে চেষ্টা করতেন তা কিন্তু কারও নজরে পড়ত না। আমার চোখ খুলে গিয়েছিল, বুঝেছিলাম, সু-ইংরেজও এ দেশে অত্যধিক কষ্ট পেয়েছেন, সর্বস্ব ত্যাগ করে এ দেশকে যাঁরা ভালবাসতে চেয়েছেন তাঁরা প্রায়ই পেয়েছেন স্বজাতির বিরক্তি এবং ভারতীয়দের অবহেলা। আমাদের দারিদ্র নিষ্ঠুর ভাবে তাঁদের আক্রমণ করেছে, তবু আমাদের অবজ্ঞা তাঁরা কেউ কেউ নিঃশব্দে মেনে নিয়ে আমাদের চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। এমনই এক বিরামহীন ত্যাগ এবং দারিদ্র-দহনের কাহিনি নিবেদিতার, যাঁকে আমরা ‘সিস্টার’ বলেই জানতাম ছাত্রাবস্থায়, মনে হত প্রাচীন এক সভ্যতার দুঃখ লাঘবের জন্য এবং স্বজাতির অপকর্মের কিছু ক্ষতিপূরণের জন্য তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে নিবেদন করেছিলেন।

বিদেশিনী নিবেদিতার এই নিঃশর্ত আত্মনিবেদনকে আমরা কী ভাবে নিয়েছিলাম, তার পরিবর্তে আমরা তাঁকে কী দিলাম, বা কী দিলাম না তার হিসেবনিকেশ একশো বছরেও হল না। তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে তাঁর তেতাল্লিশ বছরের নিদারুণ কষ্টের বিবরণ ঠিক মতো তৈরি হলে, ভবিষ্যতে কেউ আর নিজের মেয়ের নাম ‘নিবেদিতা’ রাখবে না, বুঝবে এই শব্দটির মানে শুধু দিয়ে যাওয়া, প্রতিদানে প্রায় কিছুই না পাওয়া এবং সেই সঙ্গে প্রশ্ন, মানুষের ইতিহাস কোন অদৃশ্য শক্তির ধারায় এমন সব আশ্চর্য বিদেশিনীর সৃষ্টি করে এবং তাঁরা অজানা দেশে নিজেদের তিলে তিলে নিজেদের উৎসর্গ করেন।

কোন অর্থসাহসে একত্রিশ বছরের মার্গারেট নোবল ইংল্যান্ডের নিশ্চিন্ত জীবন ত্যাগ করে অজানা ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন, তা আজও সম্পূর্ণ গবেষিত হয়নি। আমরা শুধু জানি, মধ্যবিত্ত পরিবারের এই কন্যা লন্ডনের খ্যাতনামা ইশকুলের শিক্ষিকা ছিলেন, ভারতবর্ষের দরিদ্রদের শিক্ষার জন্য এক সময় পরিচিতজনদের কাছ থেকে চাঁদা তুলেছিলেন। এবং স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশ অনুযায়ী স্বামী ব্রহ্মানন্দ মাঝে মাঝে তাঁকে রিপোর্ট পাঠাতেন। ব্রহ্মানন্দের এমন এক রিপোর্ট নিবেদিতার সদ্য-প্রকাশিত সহস্র পত্রাবলির গোড়ায় স্থান পেয়েছে, তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৭। পত্রলেখকের ঠিকানা বরানগর মঠ, এই মঠ তখনও রামকৃষ্ণ নামাঙ্কিত হয়নি, প্রতিষ্ঠানকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘সেন্ট্রাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউশন’ বলে, আদিতে যার সভ্যসংখ্যা এগারো, পরে বেড়ে হয়েছে তেইশ। আরও ছয় জন রয়েছেন ব্রহ্মচর্যের সাধনায়।

নিবেদিতা সঙ্গে করে কত অর্থ নিয়ে মোম্বাসা জাহাজে চড়েছিলেন তা আজও কারও স্পষ্ট জানা নেই, তবে আন্দাজ করা যায়, তাঁর প্রধান সমর্থক ছিলেন মিস হেনরিয়েটা মুলার, যিনি বেলুড় মঠের জমি কেনার অর্থ বিবেকানন্দকে জুগিয়েছিলেন। তবে ইঙ্গিতে মনে হচ্ছে, তিনি কলকাতায় নিবেদিতার সঙ্গে থাকবেন, মিস মুলারের এমন প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু বিদেশে পদাপর্ণের সেই ঐতিহাসিক ক্ষণে মিস মুলার কলকাতায় নেই। মিস মুলারের উপর মার্গারেটের বিশেষ নির্ভরতা স্বামীজির তেমন পছন্দ ছিল না, এই মহিলা যে এক সময় বিনা নোটিসে দলত্যাগিনী হতে পারেন তা বোধহয় স্বামীজি আগাম আন্দাজ করেছিলেন।

আলমোড়া থেকে মার্গারেটকে লেখা বিবেকানন্দের চিঠির বক্তব্য (২৯ জুলাই ১৮৯৮) খুবই স্পষ্ট। এ দেশে কোনও শ্বেতাঙ্গিনী রমণীর বসবাস কত কঠিন, তা দূরদর্শী স্বামীজির চোখের সামনে রয়েছে। এক দিকে এ দেশের দরিদ্র, অশিক্ষিত, নানা অন্ধবিশ্বাসে ভরা, দাসত্ব-মনোভাবের পুরুষ ও নারী, এবং অন্য দিকে স্থানীয় ইংরেজ সায়েব-মেমরা, যাঁরা দিশি পাড়ায় স্বেচ্ছায় বসবাসকারিণী বিদেশিনী মেয়েকে মাথা-খারাপ অথবা ছিটগ্রস্ত ছাড়া আর কিছুই ভাববেন না। যে ইংরেজি শব্দটি স্বামীজির স্মরণে এসেছে, সেটি হল ‘ক্র্যাঙ্ক’। ‘ঝাঁপ দেবার আগে আর একটু ভেবে দেখো’, এই সাবধানবাণীর সঙ্গে, স্বামীজি ধনবতী মিস মুলারের ব্যাপারে নিবেদিতাকে সোজাসুজি বলেছেন, কারও ছত্রচ্ছায়ায় থাকাটা ঠিক হবে না। ‘এই মহিলা ভাল মানুষ, কিন্তু তাঁর ধারণা, নেত্রী হওয়ার সব গুণ নিয়েই তাঁর জন্ম এবং এ জগৎকে বাগে আনতে যা একমাত্র প্রয়োজন তা হল টাকা। এই ঔদ্ধত্য মহিলার মাথায় বারবার ফিরে আসে এবং খুব অল্পদিনের মধ্যে তুমি বুঝতে পারবে এর সঙ্গে কিছু কাজ করা অসম্ভব।’ স্বামীজির কাছে আরও খবর আছে, নিবেদিতা এবং অন্য আমেরিকান মহিলাদের জন্যে মিস মুলার কলকাতায় যোগ্য বাসস্থান খুঁজছেন, কিন্তু ওঁর ভয়ংকর মেজাজ ও চঞ্চলমনস্কতা এই মহিলানিবাসের পরিকল্পনাকে নষ্ট করে দেবে। মার্গারেটের ভারতযাত্রার অনেক আগেই দূরদর্শী সন্ন্যাসীর সাবধানবাণী, ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কোনও পথই নেই।’

মার্গারেট নিশ্চয়ই সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা দেখছি, কলকাতায় মিস মুলারের কাছ থেকে ১৫ টাকার চেক তাঁর কাছে বেশ মূল্যবান। এর পরেও মুলারের চেক এসেছে কলকাতায়, কিন্তু সেই সঙ্গে শর্ত, এই টাকা মার্গারেটের জীবনধারণের জন্য, এর কোনও অংশ কোনও ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কলকাতায় পদার্পণের কয়েক দিনের মধ্যে, মার্গারেট চিঠিতে মিসেস এরিক হ্যামন্ডকে জানাচ্ছেন, ভাগ্যে আমার কাজের ব্যাপারে ওঁর দেওয়া অর্থের নির্ভরতা নেই, মিস মুলার আচমকা হিন্দুত্ব ত্যাগ করে তাঁর পুরনো ধর্মে ফিরে গিয়েছেন।

যে নিবেদিতা এ দেশের সুখদুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন তার একটা ছবি আছে, কিন্তু নেই তেমন নির্ভরযোগ্য ভারতীয় বর্ণনা। নিবেদিতার যেখানে যা বর্ণনা পেয়েছি, তার মধ্যে বিবেকানন্দ-অনুরাগী এবং মার্গারেট-বন্ধু, প্রতিভাবান সাংবাদিক-লেখক এরিক হ্যামন্ডের বর্ণনাটা আমার সবচেয়ে ভাল লাগে। মানসচক্ষে আমি এই ভারতভগ্নীর ছবিটা দেখতে পাই।

কলকাতা যাত্রার কিছু আগে এই বর্ণনা তৈরি করেছিলেন প্রিয় বন্ধু, বিবেকানন্দ-অনুরাগী এরিক হ্যামন্ড। ছবিটা আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে, আইরিশকন্যার এর থেকে ভাল বর্ণনা আজও আমার চোখে পড়েনি: ‘অনন্যসাধারণ জ্যোতির্ময়ী এক তরুণী। নীল উজ্জ্বল নয়ন। বাদামী স্বর্ণাভ কেশ। স্বচ্ছ উজ্জ্বল বর্ণ। মুখের মৃদু হাসিতে এক আকর্ষণীয় শক্তি। দীর্ঘ অঙ্গের প্রত্যেকটি পেশী যেন গতিশীল, আবেগচঞ্চল। আগ্রহ, উদ্যমে পূর্ণ হৃদয়, নির্ভীক।’

এই মার্গারেট নোবল মোম্বাসা জাহাজে কলকাতায় এসে পৌঁছলেন ২৮ জানুয়ারি ১৮৯৮, স্বয়ং বিবেকানন্দ উপস্থিত জাহাজঘাটে। প্রথম রাত্রি এসপ্ল্যানেডের কোথায় মার্গারেট ব্যয় করেছিলেন, তা ঠিক স্পষ্ট নয়। তাঁর সঙ্গে মুলারের সম্পর্কের ইতি হওয়ার গোড়ার দিকের চিঠিতে অর্থচিন্তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। এই পর্বে নিবেদিতার দু’টি মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে, এ দেশে বুদ্ধিজীবীদের উপার্জন কম এবং মাসিক ১৫ টাকার মধ্যে বাড়িভাড়া জামাকাপড় খাবার জোগাড় সম্ভব হলেও দৈনন্দিন যাতায়াতের খরচ রাখা সম্ভব কি না। সে কালের কলকাতায় খাবার সস্তা হলেও যানবাহনের খরচা কম ছিল না এবং পরবর্তী কালে তিনি ঠাকুর পরিবার থেকে একটা বাইসাইকেল উপহার পেয়েছিলেন বলে শোনা যায়।

এরই মধ্যে আরও দুঃসংবাদ। বোসপাড়া লেনের বাড়ি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে মার্গট জানাচ্ছেন স্বামীজির সঙ্গে হওয়া কথাবার্তা। ‘তিনি বললেন আমাকে বিলেতে ফিরে যেতে হবে, কারণ এখানে টাকা নেই এবং টাকা জোগাড়ের সম্ভাবনাও নেই।’ প্রস্তাবিত স্কুল সম্বন্ধে সন্ন্যাসীর আরও স্পষ্ট কথা, আবাসনে অন্তত ১০/২০ ছাত্রী জোগাড় করতে না পারলে সব চেষ্টা জলে যাবে। আরও কঠিন কথা ছাত্রীদের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা— ‘আমি হঠাৎ ঘরে গেলে ওরা কোথায় যাবে।’ জানা যাচ্ছে, স্বামীজি তাঁর শিষ্যার জাহাজের রিটার্ন টিকিট প্রায় কিনে ফেলেছিলেন।

অভিমানিনী নিবেদিতা তখন স্বামীজিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আমি কি আপনার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছি?’’ স্বামীজির উত্তর, ‘‘তুমি না, আমরাই ফেল করেছি।’’ টাকার কথা আবারও উঠেছে, নিবেদিতা সোজাসুজি বলেছেন, ‘‘এখনও তো তাঁর কাছে ৬৩০ টাকা রয়েছে, তাতে হাত দেওয়া হয়নি। স্বামীজি, আমার ভরনপোষণের চিন্তা করবেন না, আমার কাছে যা আছে তাতে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চলে যাবে।’’ স্বামীজি তখন রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।

এই সময়, তখনকার সুবিখ্যাত অ্যাটর্নি ও স্বামীজির অনুরাগী মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় সন্তোষিণী নামে এক ছাত্রীর জন্য কিছু অর্থসাহায্যে রাজি হয়ে গিয়ে এই সংকটের সাময়িক মোকাবিলা করলেন। নিবেদিতা ভাবছেন, যদি ১৫০ পাউন্ড জোগাড় করা যেত তা হলে পাঁচটি ছাত্রীকে এক বছর হস্টেলে রাখা সম্ভব হত। এই সব দুঃখের বিস্তারিত বিবরণ আমরা আজও তেমন ভাবে সংগ্রহ করিনি। আমাদের জেনে রাখা ভাল, ছাত্রী সন্তোষিণী নিবেদিতার শোওয়ার ঘরেই থাকতেন, মোহিনীবাবুর কাছ থেকে তার জন্য ছ’মাসের খরচ বাবদ নব্বই টাকার চেক পেয়ে নিবেদিতা যেন স্বর্গ হাতে পেলেন।

শিষ্যা: বিবেকানন্দের সঙ্গে নিবেদিতা।

মিস ম্যাকলাউডকে বাগবাজার থেকে লেখা এক চিঠিতে (২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯) নিবেদিতা সই করেছেন ‘ইওর ওনলি চাইল্ড মার্গারেট।’ ফুটনোট লিখছেন, ‘একমাত্র সমস্যা অর্থ, আমাকে যদি ফিরে যেতে হয়, মিসেস কুলস্টন কি আমার এখানকার দায়িত্বটা নিতে পারবেন?’

এ দেশের ইংরেজ মহলে দিশি পাড়ায় বসবাসকারী নিবেদিতার যে প্রবল সামাজিক নিন্দা হবে তা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমরাও যে সব সময় তাঁকে মাথায় তুলে রাখিনি, তার ইঙ্গিত রয়েছে নিবেদিতার বিভিন্ন চিঠিপত্রে। জানা যাচ্ছে, এখানে থাকার জন্য একটা বাড়ি কষ্টেসৃষ্টে জুটলেও কাজের লোক পাওয়া সহজ ছিল না। হিন্দু পরিচারিকা কেন খ্রিস্টানের বাড়িতে কাজ করতে আসবে? শেষ পর্যন্ত এক বুড়িকে পাওয়া গেল, কিন্তু ঝি-এর শর্ত— নিবেদিতা কখনও তার রান্নাঘরে ঢুকবে না, ‌অথবা তার উনুন ও জল স্পর্শ করবে না। নিবেদিতার চায়ের পাত্র স্পর্শ করবার জন্য এই পরিচারিকা যে স্নান করত, তার বর্ণনাও রয়েছে। পরে অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছিল, কিন্তু অন্য কোনও মেমসায়েব চা-এ এলে নিবেদিতাকেই অতিথির কাপ-ডিশ ধুতে হত। তাঁর জীবনীতে স্পষ্ট লেখা হয়েছে, হয়তো তাঁর মনে এর জন্য বেদনাও লেগেছে।

যে বিদেশিনী এই দেশকে ভালবাসেন, এবং পরিবর্তে নানা দুঃখ, অন্তহীন নিঃসঙ্গতা ও অকালমৃত্যু পেলেন, তাঁর সম্বন্ধে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্য প্রসঙ্গে বলা উক্তিটা বেশ মিলে যায়— ‘যারা শুধু দিল, পেল না কিছুই, সারাজীবন ধরে ভেবে পেল না কেন সব কিছু থেকেও কোনও কিছুতেই অধিকার নেই তাদের, তারাই আমার মুখ খুলে দিল।’ নিবেদিতা কিন্তু সব মুখ বুজেই সহ্য করেছেন।

তাঁর ৪৩ বছরের জীবনে নিবেদিতা যত আঘাত শত্রু ও আপনজনদের কাছ থেকে পেলেন তার নির্ভরযোগ্য বিবরণ সংগ্রহ করলে একটা পাঁচশো পাতার বই সহজেই হয়ে যায়। পরবর্তী কালে এ দেশের কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন পরিস্থিতি সামাল দিতে, প্রমাণ করতে এই বিদেশিনীর প্রতি কেউ তেমন অন্যায় করেনি, যা কিছু ঘটেছিল তার সবই পরিস্থিতির পাকে। কিন্তু ব্যাপারটা বোধ হয় অত সহজ নয়। কয়েকটা বিষয়ে দৃষ্টিপাত করে নেওয়াটা বোধ হয় অন্যায় হবে না।

দার্জিলিঙে তাঁর সমাধিফলক

নিবেদিতা সমস্ত জীবন ধরে কত আঘাত পেয়েছেন, কত অবহেলা অপমান সহ্য করেছেন তা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন স্মৃতিচারণে। স্বয়ং নিবেদিতা এক জন বিদেশিনীকে বলেছিলেন, যখন আলমোড়ায় স্বামীজির সঙ্গে ছিলেন তখন প্রায়ই তাঁকে কাঁদতে হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, সিস্টার ক্রিস্টিন স্কুলে আসার পর তিনি বেলুড় মঠে খুবই কম যেতেন, তাঁর মনে হয়েছিল স্বামীজি ক্রিস্টিনকেই শিক্ষা দেবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। নিবেদিতা আশংকা করেছিলেন, তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। সুতরাং তিনি স্কুলে থাকতেন, নিঃসঙ্গ যাতনায়।

৪ জুলাই স্বামীজির আকস্মিক তিরোধানের পর দিন সকালে বেলুড়ে নরেন্দ্র-জননী ভুবনেশ্বরীকে তিনি দেখেছিলেন। তবে দেহাবসানের কয়েক দিনের মধ্যে মঠের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ বড়ই তড়িঘড়ি হয়েছিল বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত, সেই সময় মিশনকে কোনও ভাবে রাজনীতিতে জড়ানো হলে মিশনের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারত। মিশন-সভাপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলেছিলেন, ‘‘বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবরটা নিবেদিতাই সংবাদপত্রকে জানিয়েছিল।’’ ব্যাপারটা হয়েছিল ১৯ জুলাই ১৯০২ সালে। যাকে ঠিক বিতাড়িত বলা বোধহয় ঠিক নয়। পরবর্তী কালে নিবেদিতা কিন্তু তাঁর এক প্রিয়জনকে বলেছিলেন, ‘‘ছাপার অক্ষরে যখন কথাগুলো দেখলাম, মনে হল এর আগে মরলাম না কেন?’’

এখানেই শেষ নয়, এর পরেও এক দশক ধরে সীমাহীন যন্ত্রণার সুদীর্ঘ ইতিহাস। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে বিশ্ব-মধ্যে উপস্থাপিত করার জন্য নিবেদিতা আবার অর্থসন্ধানে বেরিয়েছিলেন। এই প্রচেষ্টার মধ্যে এসে গিয়েছিলেন দীর্ঘ দিনের উপকারী বন্ধু সারা বুল ও তাঁর উইল, যেখানে জগদীশের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ রেখে যেতে চেয়েছিলেন মিসেস সারা বুল।

এই উইলের প্রতিবাদ জানিয়ে সারা বুলের কন্যা ওলিয়া আমেরিকার আদালতে যে মামলা করেছিলেন তাতে অনিচ্ছাকৃত ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন নিবেদিতা। সারার মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত থাকার জন্য নিবেদিতা ছুটে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। এই মামলার বিপুল প্রচার এবং হিন্দু সন্ন্যাসীদের আচরণ নিয়ে সত্যমিথ্যা যে সব রিপোর্ট দিনের পর দিন সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল, তার ধাক্কা সামলাতে বেশ সময় লেগেছিল। ওলিয়ার জয় হয়েছিল। গভীর আঘাত পেয়েছিলেন নিবেদিতা। সেই সঙ্গে এসেছিল নিঃসঙ্গতা। এরই মধ্যে ওলিয়ার অকালমৃত্যু এবং পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন।

জীবনের শেষ পর্বে নিবেদিতার অভিজ্ঞতা বড়ই বেদনাময়। তার বিস্তারিত বিবরণ আজও লিপিবদ্ধ হয়নি। আমরা শুধু জানি, নিবেদিতা আবার ভারতে ফিরে এসেছিলেন। তবে যা অনেক সময় নজরে পড়ে না, বেলুড় মঠের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনও ব্যাহত হয়নি। নতমস্তকে তিনি প্রায়ই মঠে আসতেন এবং সন্ন্যাসীরা আসতেন তাঁর স্কুলে। শ্রীশ্রীসারদামণির সঙ্গে সম্পর্ক, সেও এক বিস্ময়! আমরা এখন জানি, নিবেদিতা মায়ের সঙ্গে সাধু বাংলায় কথা বলতেন। সেই নিয়ে রসিকতাও হত। যা সবাই জানে না, শ্রীমায়ের পা বাতে পঙ্গু হওয়ায় নিবেদিতা প্রায় তাঁকে কোলে করে উপরতলায় তুলতেন এবং এই কাজ করে তিনি সীমাহীন আনন্দ পেতেন।

মামলা-মোকদ্দমার দীর্ঘ ছায়া বিদায়কালেও দূর হয়নি। জগদীশ বসুর অতিথি হয়ে তিনি দার্জিলিং-এ রায় ভিলায় বসবাস করেছেন। সেখানে ১৩ অক্টোবর, ১৯১১ সালে সব যন্ত্রণার অবসান চুয়াল্লিশ বছর পূর্ণ করার আগে। মহাপ্রয়াণের মুহূর্ত খুব দূরে নয় বুঝেছিলেন নিবেদিতা। ১৯০০ সালে কলকাতায় এক পরিচিতকে বলেছিলেন, ‘‘আমি আর এগারো বছর বাঁচব।’’ দার্জিলিঙে মৃত্যুশয্যায় উইল রচনার ব্যবস্থা হল। এই উইলেও সারা বুল মামলার ছায়া। ‘বস্টন শহরনিবাসী উকিল মিস্টার ই বি থর্প আমাকে অথবা আমার সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ককে যা কিছু দেবেন, বেঙ্গল ব্যাঙ্কে আমার যে তিনশো পাউন্ড আন্দাজ জমা আছে, পরলোকগতা ওলি বুল পত্নীর সম্পত্তির মধ্যে আমার যে সাতশ পাউন্ড রয়েছে এবং আমার যাবতীয় বইয়ের বিক্রয়লব্ধ আয় সেই সব আমি বেলুড়ের বিবেকানন্দ স্বামীজির মঠের ট্রাস্টিদের দিচ্ছি। তাঁরা এই অর্থ চিরস্থায়ী ফান্ড হিসেবে জমা রাখবেন এবং ভারতীয় নারীদের মধ্যে জাতীয় প্রণালীতে জাতীয়শিক্ষা প্রচলনের জন্য তাঁরা মিস ক্রিস্টিন-এর পরামর্শ মতো তার আয় ঐ ব্যয় করবেন।’

তাঁর সৎকারক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় লিপিটি মিশনের দান নয়। এটি স্থাপন করেছিলেন অভেদানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, যেখানে ইংরেজিতে লেখা আছে, এখানে ভগিনী নিবেদিতা শান্তিতে নিদ্রিত— যিনি ভারতবর্ষকে তাঁর সর্বস্ব অর্পণ করেছিলেন। এই অবিশ্বাস্য নিবেদনের পরিবর্তে আমরা তাঁকে কী দিয়েছি বা এখনও দিতে পারি, তার হিসেব হতে পারে এ বারের সার্ধশত জন্মবছরে।
(পুনঃপ্রকাশিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE