Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

খাঁটি বাঙালি খাবার পাই কোথা?

মাংসের আলু, ঝালের লঙ্কা, চাটনির টোমাটো, চিংড়ির মালাইকারি সবই তো অন্যদের অবদান। বাঙালির রসনাসংস্কৃতি বরাবরই বহুমাত্রিক। উৎসা রায়মাংসের আলু, ঝালের লঙ্কা, চাটনির টোমাটো, চিংড়ির মালাইকারি সবই তো অন্যদের অবদান। বাঙালির রসনাসংস্কৃতি বরাবরই বহুমাত্রিক। উৎসা রায়

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

নববর্ষ মানেই খাওয়াদাওয়া। গত কয়েক বছরে নববর্ষের কয়েক দিন আগে থেকে কাগজ খুললেই আমরা মূলত দুটি জিনিস দেখতে পাই। নববর্ষে পরতে হবে সাবেক ধুতি-পাঞ্জাবি, শাড়ি। খেতে হবে খাঁটি বাঙালি খাবার। এই খাঁটি বাঙালি খাবার, যেমন ধোঁকার ডালনা, চিংড়ির মালাইকারি, বা রসগোল্লার পায়েস যদি বাড়িতে বানানো যায়, তা হলে তো কথাই নেই। কিন্তু আজকের যুগে সময় পাওয়া যাচ্ছে না এত কিছু করার। কুছ পরোয়া নেহি! রেস্তরাঁ রয়েছে, যেখানে ধুতি-পাঞ্জাবি বা লালপাড় সাদা শাড়ি পরে পুরুষ এবং মহিলারা পরিবেশন করে যাবেন পোলাও, ছোলার ডাল, মাছের পাতুরি, চাটনির মতো খাঁটি বাঙালি খাবার।

ভাবতে মজা লাগে, এক সময় বাঙালি রেস্তরাঁয় যেত নতুন খাবারের স্বাদ নিতে। এমন খাবার, গেরস্তের রান্নাঘরে যার প্রবেশ নিষেধ ছিল। কিন্তু আজ নতুনের হাতছানির সঙ্গে রেস্তরাঁয় খাঁটি সাবেকি রান্নাও! দু’ধরনের খাওয়াতেই মজেছি আমরা। কিন্তু এই যে সাবেক বাঙালি রান্না, তার উপাদান থেকে শুরু করে রন্ধনপ্রক্রিয়া, অনেক কিছুই কিন্তু ব্রিটিশ আমলের দান। এমনকী প্রাক-ব্রিটিশ যুগেও এত ধরনের মিলমিশ শুরু হয়ে গিয়েছে যে ‘খাঁটি’ বাঙালি খাবার পাওয়া বোধহয় একটু মুশকিল।

সত্যি বলতে, কোনও দেশের রন্ধনশৈলী আদি-অকৃত্রিম ধারায় অনাদি কাল ধরে চলে আসছে, এ কথা ভাবাই হাস্যকর। মধ্যবিত্ত বাঙালির খাওয়াদাওয়ার ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে দেখেছি, সারা পৃথিবীতে এক ছবি। খাঁটি কেউ নেই। আজ আমরা যে মেক্সিকান রান্না খাই, তার সঙ্গে কি আজটেকদের রান্নার কোনও সম্বন্ধ আছে না কি? এই যে ‘খাঁটি, অকৃত্রিম’ বাঙালি রান্নায় আলু দেওয়া হবে, টমেটো দেওয়া হবে, লংকা দেওয়া হবে, এগুলি বাংলার মাটিতে ফলত না কি?

ঔপনিবেশিক বাংলায় যাঁরা রান্নাবান্না নিয়ে লিখেছেন, যেমন প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী, বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় বা আর একটু পরের দিকে বীণাপাণি মিত্র, তাঁরা এত অকৃত্রিম বাঙালি খাবার-টাবার নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তাঁরা যেমন বলে দিচ্ছেন শুক্তো কী করে তৈরি হবে, একই ভাবে টিপসি পুডিং-এরও প্রণালী বলে দিচ্ছেন। প্রজ্ঞাসুন্দরী যেমন একটি রান্নার নামকরণ করলেন ‘ফিরিঙ্গি কারি’। এই ফিরিঙ্গি কারি-র মূল উপাদান কী? পটল। বীণাপাণি মিত্র আবার তাঁর বইয়ে আমাদের শেখালেন ক্ষীরের টফি তৈরি করতে। এই যে ফিরিঙ্গি, তাঁরা কারা? বলবার প্রয়োজন নেই যে বাঙালিরা যাঁদের ‘ফিরিঙ্গি’ বলে সম্বোধন করে থাকেন তাঁরা কিন্তু ইউরোপীয় নন, আবার ভারতীয়ও নন। তাঁরা এই দুইয়ের সংমিশ্রণ। অনায়াসেই পটল তাঁদের খাদ্যের একটি উপাদান হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাঙালিরাও কি শুধুই খাঁটি এবং অকৃত্রিম? আমরা যা খাই, যা পরি, কোনটাকেই বা সে অর্থে সনাতন বলা চলে? এই যে নববর্ষে সবাই রে-রে করে পোলাও খাবেন, তা-ই কি আবার বাঙালি নাকি? সত্যি বলতে কী, এই কোনওটাকেই বাঙালি বলতে কোনও বাধা নেই, যদি আমরা স্বীকার করে নিই, বাঙালি জাতির পরিচিতি ধর্ম-বর্ণ-জাত সমস্ত কিছুর সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে। জাতীয়তাবাদীরা দয়া করে আমার গর্দান নেবেন না। ‘ভারতমাতা’ ছবির স্রষ্টা স্বয়ং অবন ঠাকুর তাঁর বাবুর্চি তালেব আলির রান্না মুরগির স্টু খেতে বড় ভালবাসতেন।

আজকে আমরা ঘরে-ঘরে যে চা খাই, সে-ও তো ঔপনিবেশিক আধুনিকতারই দান। চিংড়ির মালাইকারির অস্তিত্ব প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে পাওয়া যাবে কি? সাহেবরাও এ দেশে এসে মহানন্দে খেয়েছেন আম দিয়ে মুরগি, ডালের চচ্চড়ি, সুজির মতো খাবার। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে— এই না হলে বাঙালি কি ইংরেজ কেউই তৈরি হয় না। বস্তুত, অনেক দোষ সত্ত্বেও বাঙালির রসনাসংস্কৃতি চিরকালই বহুমাত্রিক, আজও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Food
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE