Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সার্বিক ভাবে মানুষের পরিচ্ছন্নতার বোধ কোথায়

মোদীর স্বচ্ছতার স্লোগানের বাস্তব রূপায়ণ? বারাণসী ঘুরে এসে আশার আলো দেখাতে পারলেন না জয়ন্ত ঘোষাল।স্যামুয়েল বেকেট তাঁর ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ নাটকে নায়ক বা ঘটনাস্থলের কোনও স্থায়ী নাম দেননি। প্রথম অঙ্কের নাম দ্বিতীয় অঙ্কে বদলে যাচ্ছে। উত্তর আধুনিকতার সে ছিল এক অভিনব পরীক্ষা। পরবর্তীকালে প্রশ্ন উঠল, চরিত্রের নাম অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে, কিন্তু মানুষের ঈশ্বরের জন্য প্রতীক্ষা তো অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে না। নিৎসে বললেন, ঈশ্বর মৃত। তা বলে কি নৈতিকতা মৃত? বেকেট বললেন, না। মানুষই এ বার নীতি তৈরি করবে। গোডো-কেও আপনি ঈশ্বর ভাবছেন, কিন্তু ঈশ্বর হলে আমি ওই চরিত্রের নাম তো ঈশ্বরই দিতাম! তিনি বললেন, আমাদের জীবনে কোনও কিছুই দু’বার ঘটে না।

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

স্যামুয়েল বেকেট তাঁর ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ নাটকে নায়ক বা ঘটনাস্থলের কোনও স্থায়ী নাম দেননি। প্রথম অঙ্কের নাম দ্বিতীয় অঙ্কে বদলে যাচ্ছে। উত্তর আধুনিকতার সে ছিল এক অভিনব পরীক্ষা। পরবর্তীকালে প্রশ্ন উঠল, চরিত্রের নাম অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে, কিন্তু মানুষের ঈশ্বরের জন্য প্রতীক্ষা তো অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে না। নিৎসে বললেন, ঈশ্বর মৃত। তা বলে কি নৈতিকতা মৃত? বেকেট বললেন, না। মানুষই এ বার নীতি তৈরি করবে। গোডো-কেও আপনি ঈশ্বর ভাবছেন, কিন্তু ঈশ্বর হলে আমি ওই চরিত্রের নাম তো ঈশ্বরই দিতাম! তিনি বললেন, আমাদের জীবনে কোনও কিছুই দু’বার ঘটে না।

অতএব, যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির ভবতি ভারত হলেই অবতার নেমে এসে সব সমস্যার সমাধান করে দেবে এমনটা ভাবা অবৈজ্ঞানিক। বেকেট-এর কথাটা এই প্রসঙ্গেই মনে এল।

বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯১৬ সালে যখন তিন দিনের উদ্বোধনী উৎসব হল তখন সেখানে এসেছিলেন কাশীর মহারাজা, আবার অন্য দিকে ছিলেন ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। মদনমোহন মালব্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, এ কথা আমরা জানি। কিন্তু অনেকে জানি না, সে দিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন অ্যানি বেসান্ত এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ করে আসা কম পরিচিত মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। সে দিন বক্তৃতা দিতে উঠে গাঁধী বললেন, বিশ্বনাথের মন্দিরে সন্ধ্যাবেলা গিয়ে সেখানকার সরু গলিতে ঘুরতে ঘুরতে আমার যে অনুভূতি হয়েছে, এক জন হিন্দু হিসাবেই সে কথা আজ আমি বলব। সেই অনুভূতিটা হল, আমাদের পবিত্র মন্দিরগুলো এই ভাবে নোংরা করে রাখাটা কি উচিত কাজ? সরু সরু গলির ভিতর দুর্গন্ধ আবর্জনা। আমাদের মন্দিরগুলি কেন অপরিচ্ছন্ন? আমাদের স্বায়ত্তশাসনের অর্থ কী? আমাদের মন্দিরগুলি কি পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা এবং শান্তির প্রতীক হয়ে উঠতে পারে না? সে দিন গাঁধীজী আরও বলেছিলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মহারাজা বক্তৃতা দিয়েছেন, ভারতের দারিদ্র নিয়ে কথা বলেছেন। আমি তো বলব রাজাদের ধনসম্পদ অলঙ্কার তাঁরা যত দিন নিজেদের সিন্দুকে রেখে দেবেন, তত দিন এ দেশে গরিব মানুষও থাকবেন। এই সব অলঙ্কারকে তাদের আগে ত্যাগ করতে হবে। সে দিনের সভায় গাঁধীর বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে হাঙ্গামা বেধে যায়। দ্বারভাঙার মহারাজা সেখানে উপস্থিত। তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অ্যানি বেসান্ত দ্বারভাঙার মহারাজার দিকে তাকিয়ে তার পর গাঁধীকে বলেন, আপনি এখনই থেমে যান। ছাত্ররা বলতে থাকে গাঁধীর বক্তৃতা তাঁরা আরও শুনতে চায়। (ঘটনা সূত্র: রিচার্ড ল্যানয়-এর বেনারস আ ওয়র্ল্ড উইদিন আ ওয়র্ল্ড গ্রন্থ)।


দশাশ্বমেধ ঘাট

এখন ২০১৫ সাল। বেনারস নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচন কেন্দ্র। সরকারের ৯ মাস অতিবাহিত। তিন দিনের জন্য ঘুরে এলাম এই সভ্যতার প্রাচীন জনপদে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর স্বচ্ছতার স্লোগানের বাস্তব পরিণতিটা কী? উত্তরে খুব আশার আলো দেখাতে পারছি না। রেলস্টেশনের কাছে ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হয়েছে বটে। বারাণসীর ৮৪টি ঘাট আগের তুলনায় কিঞ্চিৎ পরিচ্ছন্ন। দশাশ্বমেধ ঘাটে গ্যামাক্সিন ছড়ানো হচ্ছে চোখে পড়ল। বহু রাস্তায় ঝাড়ু লাগানো শুরু হয়েছে। কিন্তু সার্বিক ভাবে মানুষের পরিচ্ছন্নতার, নৈতিকতার কোনও পরিচয় দেখতে পেলাম না। আর তাই স্যামুয়েল বেকেট আর নিৎসের কথা মনে পড়ল। এই ঈশ্বরের শহরে ঈশ্বরও এসে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারলেন না!

যত দিন না পর্যন্ত মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়া যুবকটি পানের পিচ যত্রতত্র ফেলাটা বন্ধ করবে, গাঁদা, বেলপাতা নারকোল অর্থাৎ বাবা বিশ্বনাথের পূজাসামগ্রী গঙ্গার ধারে জমে জমে দীর্ঘ পচন ঘটাবে তত দিন স্বচ্ছতা দূরাশা। কিন্তু হিন্দু ধর্ম মানে তো নোংরা থাকা নয়। পাতঞ্জলির যোগসূত্র রচনার আদিতে পরিচ্ছন্নতার কথা বলা হয়েছিল। যোগে দু’ধরনের পরিচ্ছন্নতার কথা বলা হয়। একটা অন্তরের, আর একটা বাহিরের। পাতঞ্জলি এ-ও বলেছিলেন, একটি অন্যটির পরিপূরক। সারনাথে গিয়ে বৌদ্ধস্তূপ যখন দেখেছি, যে বোধিবৃক্ষের নীচে বুদ্ধ তাঁর প্রথম প্রবচন দিয়েছিলেন সেই এলাকায় ঘুরছি, তখন ভেবেছি সেই জায়গাটি কী ভাবে এত পরিচ্ছন্ন থাকে? বারাণসীতে পার্শ্বনাথের জন্মস্থান। সেই জৈন মন্দিরটিও পরিচ্ছন্ন। রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের ভিতরের দৃশ্যপট অসাধারণ পরিচ্ছন্ন। ভিড়ে ঠাসা গৌদোলিয়ায় প্রাচীন সেন্ট টমাস চার্চ। সেখানে সন্ধ্যার প্রার্থনায় গেলাম। নীরবতা এবং পরিচ্ছন্নতা— দুইই আছে। তবে বেনারসের মুসলমান প্রধান এলাকাগুলি, বিশেষত প্রাচীন মসজিদ এলাকাটি (জ্ঞানবাপী মসজিদ ছাড়া অন্য এলাকাগুলিও) একই রকম আবর্জনাময়, ঘিঞ্জি, দুর্গন্ধযুক্ত কোলাহলমুখর। প্রশ্ন হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম, এমনকী জৈন ধর্মে যে পরিচ্ছন্নতা, সেটা কি তবে হিন্দু এবং মুসলিম ধর্মে নেই? অনেকে বলেন বিশ্বনাথের গলি পরিচ্ছন্ন হয়ে গেলে বারাণসীর চরিত্রটাই থাকবে না। অতএব জয়বাবা ফেলুনাথের মজা রাখতে গেলে এই আবর্জনা এবং দূষণও বজায় রাখা প্রয়োজন!


সারনাথ বৌদ্ধস্তূপ


বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়

আমি একমত নই। অতীতে হরপ্পা সভ্যতার মানুষ খুব পরিচ্ছন্ন ছিলেন বলে ইতিহাস বলে। পরবর্তী কালে বৈদিক সভ্যতাতেও পরিচ্ছন্নতা ছিল না, তা নয়। এমনকী, মুসলিম যুগেও বেনারসের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতেও কিন্তু দেখা যায়, বারাণসী শিক্ষা-সংস্কৃতি-সভ্যতার পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন শহরও ছিল। তা হলে এই অপরিচ্ছন্নতা কবে কী ভাবে এ শহরকে গ্রাস করল? তা বোঝা যায় না। ১০৩৩ সালে মহম্মদ গজনীর ছেলের মুসলিম সেনাপতি নিয়াল তাজিন জাহাজে করে গঙ্গার ধারে এসে পৌঁছন এক বিশাল আফগান সেনাবাহিনী নিয়ে। তাদের কাছে তখনও বারাণসী ছিল এক অজানা ভূখণ্ড। সেই সময়েও যে বারাণসীর বর্ণনা পাওয়া যায় তাতেও কিন্তু বার বার বলা হয়েছে যে সেটি ছিল খুব পরিচ্ছন্ন একটি শহর। আকবরের সময় এক ব্রিটিশ পর্যটক র‌্যালফ ফিচ তাঁর রচনাতেও সেই একই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, এখানে গরুও আছে ময়ূরও আছে। বাঁদর আছে সিংহও আছে। কিন্তু মানুষও আছে শান্তিতে। সন্ধ্যায় গৌদোলিয়ার কাছে একটা লখনউ চিকনের দোকানে দেখা গেল একটি বিশাল চেহারার গরু সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোকানটিতে প্রবেশ করল। দোকানদার তাকে কিছু খাবার দিল। তার পর কাউকে বিব্রত না করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল জনপথে। এই সংস্কৃতিটার আমি বিরোধিতা করছি না। রাস্তায় ষাঁড়েরা যে ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং গাড়ি-ঘোড়া তাদের বিরক্ত না করে চলে যায়, সেটা দেখে মনে হয় এই গোটা শহরে ষাঁড় এবং গরুরা বলছে এটা আমাদেরই জায়গা। তোমরা পরে এসেছ! এই সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচ্ছন্নতার সংঘাত বাধবে কেন? আর এটাও বুঝে গেলাম, নরেন্দ্র মোদী তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রকে পরিচ্ছন্ন করার ডাক দিতে পারেন, কিন্তু মহাদেব এসে একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে বারাণসী পরিষ্কার করে দিয়ে যাবেন আর তত দিন আমরা গঙ্গায় কাপড় কাচব, আবর্জনার সলিল সমাধি করব মা গঙ্গার কাছে, এটা বোধহয় হয় না।

ছবি: লেখক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE