Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ভয়ঙ্কর এক প্রত্যাশার চক্রব্যূহে আটকে মোদী

বর্ষপূর্তিতে উৎসব পালনের চেয়েও বিজেপি-র অনেক বেশি প্রয়োজন আত্মানুসন্ধানের। বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষালদেখতে দেখতে নরেন্দ্র মোদী সরকারের একটি বছর হয়ে গেল। ২৮২টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। বহু বছর পর ভারতের রাজনীতিতে আবার কোনও একটি দল এত আসন পেয়ে ক্ষমতাসীন হল। আর বিজেপি-র রাজনৈতিক ইতিহাসে তো এটা প্রথম। অতীতে এ রকম একক ভাবে ক্ষমতায় কোনও দিন তারা আসেনি। এই বিপুল জয়ের ফলে প্রত্যাশাও ছিল বিপুল। বিজেপি-রই এক নেতার ভাষায়, একে বলা যেতে পারে ভয়ঙ্কর প্রত্যাশা। স্বভাবতই, এক বছর পর আমজনতার মনে স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কাও প্রবল হয়ে ওঠে।

ম্যাঁয় নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী…।

ম্যাঁয় নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী…।

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

দেখতে দেখতে নরেন্দ্র মোদী সরকারের একটি বছর হয়ে গেল।
২৮২টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। বহু বছর পর ভারতের রাজনীতিতে আবার কোনও একটি দল এত আসন পেয়ে ক্ষমতাসীন হল। আর বিজেপি-র রাজনৈতিক ইতিহাসে তো এটা প্রথম। অতীতে এ রকম একক ভাবে ক্ষমতায় কোনও দিন তারা আসেনি।
এই বিপুল জয়ের ফলে প্রত্যাশাও ছিল বিপুল। বিজেপি-রই এক নেতার ভাষায়, একে বলা যেতে পারে ভয়ঙ্কর প্রত্যাশা। স্বভাবতই, এক বছর পর আমজনতার মনে স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কাও প্রবল হয়ে ওঠে। ভারতের রাজনীতিতে মূল সমস্যাগুলি যে আসলে কোনও রাজনেতার পক্ষেই এক লহমায় সমাধান করে দেওয়া সম্ভব নয়, সেটা আমরা আমজনতা বুঝেও বুঝতে চাই না। জিনিসপত্রের দাম কি আসলে কখনও কমে? প্রকৃতির নিয়মে মূল্যবৃদ্ধি আর মুদ্রাস্ফীতি স্বততই ঊর্ধ্বমুখী।
নেহরু যখন বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখতেন, তখনও তিনি বলেছিলেন, দেশের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা দু’টি। একটি মুদ্রাস্ফীতি, অন্যটি দুর্নীতি। মজার ব্যাপার, আজও এই দু’টি সমস্যাই ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমি কিন্তু মনে করি না, নরেন্দ্র মোদীর সদিচ্ছা নেই। অন্যান্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় তাঁর বয়সও কম। ৪৭ সালের পর জন্মেছেন এমন প্রধানমন্ত্রী এই প্রথম। গুজরাতে তিনি হ্যাটট্রিক করেছেন। সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়েছেন— এটাও সত্য। যেটা গুজরাতে করতে পেরেছেন, সেটা তিনি গোটা দেশে করে দেখাবেন, এমনটাই তাঁর মনোবাসনা। তাঁর উৎসাহে কোনও ঘাটতি নেই। কর্মকুশলতা আছে। এটাও সত্য, দিল্লির নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লকে বহু বছর ধরে যে দালালতন্ত্র সক্রিয় দেখেছি, তাদের এখন দেখা যাচ্ছে না। মন্ত্রী থেকে অফিসার, সবাই ভয়ে তটস্থ। সকলেরই মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নজর রাখছেন।

এগুলো ভাল কথা। এতদসত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মনে হচ্ছে, তাঁরা যতটা আশা করেছিলেন, তা পূরণ হচ্ছে না। শেয়ার বাজার তেজি নয়। গত এক বছরে বিদেশি বিনিয়োগের নজির খুব তাৎপর্যপূর্ণ নয়। অরুণ জেটলির বাজেট যে করকাঠামোর বিন্যাস করেছে, সেটা নিয়েও সমালোচনা বিস্তর। মুকেশ অম্বানী অখুশি। আমলাতন্ত্র নারাজ। এমনই একটা ধারণা খবরের কাগজের পাতায় পাতায়।

প্রধানমন্ত্রী অবশ্য মনে করেন, সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম তাঁর প্রতি অবিচার করছে। অজস্র ভাল কাজ হচ্ছে। কিন্তু সেগুলি সংবাদের শিরোনামে উঠে আসছে না। তিনি প্রথম বছরটা বিদেশনীতির রূপায়ণে সক্রিয় হয়েছেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে, তিনি বিদেশ ভ্রমণে উৎসাহী। তিনি স্বচ্ছতা অভিযানের মাধ্যমে এক নতুন পরিচ্ছন্ন ভারত গঠনের চেষ্টা করছেন, কিন্তু অভিযোগ হচ্ছে লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী কেন টয়লেট পরিষ্কারের কথা বলছেন? আর এই সব প্রচারে প্রধানমন্ত্রী খুব বিব্রত। ফলে চিনে গিয়েও ফল ঘোষণার বর্ষপূর্তির দিনে কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতেই তিনি এই সব অভিযোগের জবাব দিয়েছেন।

আসলে বিজেপি এ বার ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদীর ছবি দেখিয়ে। আবার সরকারটাও কিন্তু সম্পূর্ণ নরেন্দ্র মোদীকেন্দ্রিক। ফলে সাফল্য যেমন মোদীর, ঠিক সে ভাবে এই সরকারের যাবতীয় ব্যর্থতার দায়ও তিনিই নিচ্ছেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি নিজেকে অন্যান্য মন্ত্রী ও মন্ত্রক থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রাখতেন। গোধরা কাণ্ড হল, দোষ দিলেন নরেন্দ্র মোদীকে। সংসদে জঙ্গি আক্রমণ হল, সমালোচনার প্রধান শিকার হলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। এই কৌশলটি একদা পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুও অবলম্বন করতেন। এখন কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের জন্য আড়ালে আবডালে মোদীর ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন সতীর্থ মন্ত্রীরা। কিন্তু তাঁদের কোনও সামগ্রিক দায়ও নেই।

ফলে মাসরত আলমের মতো জঙ্গিকে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে সমালোচনা হলে তার আঁচ রাজনাথের গায়ে এসে লাগছে না। কিন্তু তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর নিরাপত্তার বহর বাড়ছে। নতুন গাড়ি আসছে। বিএসএফ-এর বিমানে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাজেট নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। কিন্তু আক্রমণের লক্ষ্য অরুণ জেটলি নন। লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রীই। নরসিংহ রাওয়ের সময়েও অর্থনীতির লাভ ও লোকসান, দুটোই নিয়েছিলেন মনমোহন সিংহ। বিজেপি-র অনেক নেতা বলছেন, এই এক বছরের মাথায় যখন মোদীর ঝড় স্তিমিত, তখন প্রধানমন্ত্রীর উচিত কেন্দ্রীকরণের বদলে বিভিন্ন মন্ত্রীদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে দেওয়া।

একটা ধারণা ছিল নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বকে প্রকাশ্যে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না। তাঁর ক্ষমতার কর্তৃত্ব এতটাই যেমনটি ছিল ইন্দিরা গাঁধীর। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ইন্দিরা গাঁধীকেও সিন্ডিকেটের হ্যাপা কম সামলাতে হয়নি। নরেন্দ্র মোদীর কাছে কার্যত যাঁরা নিতান্তই তুচ্ছ চরিত্র, স্বাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি অথবা গিরিরাজ সিংহ বা সাক্ষী মহারাজ, এঁদের মুখ বন্ধ করতে তিনি সক্ষম হচ্ছেন না। রাম জেঠমলানী থেকে অরুণ শৌরি, সরকারের সার্বিক নীতির সমালোচনায় মুখর। এই পরিস্থিতিটা সংবাদমাধ্যমের সৃষ্ট বললে বোধহয় ভাবের ঘরে চুরি করা হবে।

জমি বিল সংসদে পাশ করাতে গেলে যৌথ অধিবেশন ডাকা ছাড়া আর কোনও পথ নেই। কিন্তু যৌথ অধিবেশন ডেকেও এই সব বিল পাশ করলে প্রবীণ তোগাড়িয়ার মতো নেতারা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, তা হলে রামজন্মভূমির জন্য যৌথ অধিবেশন ডাকা হবে না কেন? এমনকী, উত্তরপ্রদেশে অযোধ্যা থেকে এই বিল যৌথ অধিবেশনে পাশ করার দাবি জানিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একটি নতুন পদযাত্রার কর্মসূচি গ্রহণ করবে বলছে।

এ সব খবর সাত নম্বর রেস কোর্স রোডে এসে পৌঁছেছে। আরএসএস নেতৃত্ব এই এক বছরের মাথায় যে খুব খুশি তা নয়। কিন্তু এখনও তারা সরকারের সঙ্গে কোনও রকম সংঘাতে না গিয়ে রামমন্দির থেকে ৩৭০— সব শিকেয় তুলে রেখেছে। আগামী দিনে রাজনৈতিক মধুচন্দ্রিমা শেষ হয়ে গেলে তখন যদি সরকার আরও দুর্বল হয়ে যায়, কংগ্রেস তথা প্রতিপক্ষ যদি আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, তখন কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারও ঘোলা জলে মাছ ধরার সুযোগ ছাড়বে না। অতীত ইতিহাস তাই বলে।

নরেন্দ্র মোদী এই পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছেন। তাই তিনি বর্ষপূর্তিতে রাজধানীতে কোনও বড় ধরনের উৎসব করার বিপক্ষে মত দিয়েছেন। কেউ কেউ পরামর্শ দিলেও বিজ্ঞান ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করতেও রাজি হননি। মন্ত্রীদের বলছেন, রাজ্যে রাজ্যে গিয়ে সামাজিক কর্মসূচিগুলি আমজনতার কাছে গিয়ে জানাতে। তাই বর্ষপূর্তিতে উৎসব পালনের চেয়েও বোধহয় বিজেপি-র অনেক বেশি প্রয়োজন আত্মানুসন্ধানের।

ছবি: এএফপি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE