Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মনমোহনের ছিল কর্তৃত্ব, কিন্তু ক্ষমতার অধিষ্ঠাত্রী সনিয়াই

সঞ্জয় বারুর বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি নির্মম বাস্তব। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালপ্রাচ্যের কবি ও দার্শনিক খলিল গিব্রানের লেখায় এক অচেনা ডাইনির গল্প আছে। এক সুউচ্চ পাহাড়ের মাথায় ছিল এক প্রাসাদ। সেই প্রাসাদেই নাকি থাকতেন সেই ডাইনি। নীচে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এক গ্রামবাসী আর এক প্রতিবেশীকে বললেন, ওখানে এক ডাইনি থাকেন। তিনি ভয়ঙ্কর। অন্ধকারে তাঁকে দেখলে ভয় পাবে। অন্য জন বললেন, একদম বাজে কথা। ওই প্রাসাদে থাকেন এক অপূর্ব সুন্দরী রানি। তাঁর আশীর্বাদে গ্রামের মানুষ আনন্দে দিন কাটাচ্ছে।

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:২০
Share: Save:

প্রাচ্যের কবি ও দার্শনিক খলিল গিব্রানের লেখায় এক অচেনা ডাইনির গল্প আছে। এক সুউচ্চ পাহাড়ের মাথায় ছিল এক প্রাসাদ। সেই প্রাসাদেই নাকি থাকতেন সেই ডাইনি। নীচে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এক গ্রামবাসী আর এক প্রতিবেশীকে বললেন, ওখানে এক ডাইনি থাকেন। তিনি ভয়ঙ্কর। অন্ধকারে তাঁকে দেখলে ভয় পাবে। অন্য জন বললেন, একদম বাজে কথা। ওই প্রাসাদে থাকেন এক অপূর্ব সুন্দরী রানি। তাঁর আশীর্বাদে গ্রামের মানুষ আনন্দে দিন কাটাচ্ছে। তর্ক করতে করতে তাঁরা প্রায় প্রাসাদের কাছেই চলে এলেন। প্রাসাদের ভিতর থেকে এক নিরাপত্তাকর্মী বেরিয়ে এসে তর্কের অবসান ঘটিয়ে বললেন, এ বাড়িতে থাকতেন এক বিদূষী নারী। বেশ কয়েক বছর হল তিনি মারা গিয়েছেন। এ প্রাসাদে আজ আর কেউ থাকেন না। আমরা পাহারা দিই।

সত্যকে জানার পথ তাই সব সময়েই বেশ কণ্টকাকীর্ণ। প্রত্যেকই নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সত্যকে দেখেন। নানা মুনির নানা মত হলেও ওই প্রাসাদে বসবাসকারী নিরাপত্তারক্ষীর বক্তব্যই বোধহয় সত্যের সব থেকে কাছাকাছি।

প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু-র অধুনা প্রকাশিত ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ বইটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, এ সব লেখকের মনগড়া কল্পনাপ্রসূত তথ্য। আমরা যাঁরা প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় সঞ্জয় বারু এবং প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়কে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি তাঁরা কিন্তু সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করবেন, বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি নির্মম বাস্তব। সঞ্জয় বারু লিখেছেন, ক্ষমতার অলিন্দে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সকলেই জানতেন যে আসল ক্ষমতার উৎস দশ নম্বর জনপথ। মনমোহন সিংহের মতো ‘জো হুজুর’ প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত গুলজারিলাল নন্দ এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রীও ছিলেন না। রাজনীতি বিজ্ঞানের এক অধ্যাপক ছাত্রজীবনে বুঝিয়েছিলেন, ‘ক্ষমতা আর কর্তৃত্বের ফারাক কোথায়? এক পুলিশকে গালে থাপ্পড় মেরে সব লুঠ করে চোর পালিয়ে গেল, ক্ষুব্ধ পুলিশ সেই চোরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করল। সেই পুলিশটির আছে কর্তৃত্ব, যাকে বলে সিলমোহর। আর চোরের আছে ক্ষমতা।’ মনমোহন সিংহের ছিল আনুষ্ঠানিক কর্তৃত্ব। কিন্তু ক্ষমতার অধিষ্ঠাত্রী ছিলেন সনিয়া গাঁধী।

সঞ্জয় বারু-র কি এই বইটি লেখা অনুচিত হয়েছে? কেউ কেউ বলছেন ক্ষমতার ভিতরে থেকে সেই সব তথ্য অবসর নিয়ে প্রকাশ করা অনৈতিক। তথ্য অধিকারের যুগে এটিও কুযুক্তি। প্রথমত, প্রাক্তন গোয়েন্দা অফিসার মলয়কৃষ্ণ ধর যে ভাবে বিভিন্ন গোপন রিপোর্ট ফাঁস করে গোয়েন্দা বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি দিবালোকে এনেছিলেন তার সঙ্গে এই বইটির অনেক ফারাক। প্রধানমন্ত্রীর এবং প্রথম ইউপিএ সরকারের কাজকর্ম নিয়ে এটি মূলত এক মিডিয়া উপদেষ্টা তথা সাংবাদিকের স্মৃতিচারণ। সেই স্মৃতিচর্চার একটি প্রেক্ষিত রয়েছে। সেগুলির মধ্যে সঞ্জয় বারু-র অনুভব, উপলব্ধি মিশে রয়েছে। এই বইটি তাই একটি ‘সাবজেক্টিভ ন্যারেশন’। সে সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে সঞ্জয় বারুই ছিলেন তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। যিনি সনিয়া গাঁধী তথা কংগ্রেসের লোক নন, একান্ত ভাবে ছিলেন মনমোহন সিংহের লোক। বহু বার মনমোহন সিংহের সঙ্গে বিদেশে গিয়ে দেখেছি, সঞ্জয়ের প্রতি কী গভীর আস্থা-ভালবাসা ছিল মনমোহনের। তিনি অন্যদের মতো প্রধানমন্ত্রীকে ভয় পেতেন না। ভোটের মুখে বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত সঞ্জয় বারু-র নয়। এটি প্রকাশকের সিদ্ধান্ত। তবে অতি-অবশ্যই লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে। ভোটের আগে প্রকাশিত হলে বইটি ভাল বিক্রি হবে এটা ভাবা তো প্রকাশকের অন্যতম কর্তব্য। এর মধ্যেও বা অন্যায় কী রয়েছে! বিদেশেও তো বহু মিডিয়া উপদেষ্টাই বই লিখেছেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মিডিয়া উপদেষ্টাও সে সময়ে বই লিখেছিলেন। কাজেই এই ধরনের বই লেখার রেওয়াজ একেবারেই নতুন নয়। অতীতে হেনরি কিসিঙ্গারের গ্রন্থ থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন জমানার নানা কাহিনিও তো আমরা জেনেছি!

আসলে সত্যেরে লও সহজে বললেও কাজটি সহজ নয়। গত দশ বছর ধরে সাংবাদিকেরা আড়ালে-আবডালে এটাই আলোচনা করেছেন, আসলে মনমোহন সিংহ নাম্বার ওয়ান নন, তিনি নাম্বার টু। প্রথম ইউপিএ গঠনের পরে পরেই হায়দরাবাদে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়েছিল। সেখানে আর্থিক নীতি কী নেওয়া হবে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দলের সবিস্তার আলাপ-আলোচনা হয়। গৃহীত আর্থিক প্রস্তাবের কপিটি সে দিন হাতে পাওয়ার পর সতীর্থ সাংবাদিক অগ্নি রায় প্রথম যে প্রশ্নটি করেছিলেন সেটি হল, “এটা কি মনমোহনের অর্থনীতি না সনিয়ার? এটা বামপন্থীদের সমর্থনে টিকে থাকা ইউপিএ-র সমাজতন্ত্র না কি কংগ্রেসের নেহরুবাদী সমাজতন্ত্র?”

আজ এত বছর পর এটা বললে কি ভুল হবে যে ’৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রিসভার নাম্বার টু হয়েও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যতটা নিজের মতে চলতে পেরেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি তা করতে পারেননি। যে কারণে চিদম্বরম থেকে মন্টেক, সংস্কারবাদী ব্যক্তিরা বরং আপোস করেছেন, কিন্তু বৃদ্ধির রাজনীতি ধাক্কা খেয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, মনমোহনও নিজেকে পরিবর্তিত করেছেন। ’৯১ সালের মনমোহন আর ২০০৪-এর মনমোহন এক নন। অর্থনীতিতে তিনিও তখন মধ্যপন্থায়। আর এই সনিয়া-মনমোহনের জুটিই বরং ভারতের রাজনীতিকে এক ধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’-এর মধ্যে রেখেছে বলে অনেকে মনে করেন। এক দিকে সনিয়ার জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ আর অন্য দিকে মনমোহনীয় অর্থনীতি। এক দিকে দল অন্য দিকে সরকার। কমিউনিস্ট পার্টি বা বিজেপি-তেও কি এটা হয় না? আলিমুদ্দিন স্ট্রিট চিরকাল মহাকরণকে নিয়ন্ত্রণ করেনি? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পনীতিকে দলের সিলমোহর নিতে হয়নি? তা নিয়ে দলে বিতর্ক কম হয়েছে? বিজেপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন বাজপেয়ীকে আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার নিয়ন্ত্রণ করেনি? তাই এই সংঘাত ও সমন্বয় ভারতীয় রাজনীতির বহুত্ববাদের জন্যই ইতিবাচক। নেতিবাচক নয়। এমনটাও অনেকে মনে করেন।

তাত্ত্বিক সঙ্গম স্বাগত। কিন্তু তাই বলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি গোপন ফাইল দশ নম্বর জনপথে যে যেত না এমনটাও নয়। বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে যে এমনটা হত তা তো সনিয়ার ঘনিষ্ঠ মহল থেকেও অতীতে বারংবার বলা হয়েছে। রাজ্যপাল থেকে বিদেশ সচিব বহু নিয়োগের ক্ষেত্রেও কি দশ জনপথ নির্ধারক শক্তি ছিল না? প্রশ্ন একটাই, আপত্তি থাকলে মনমোহন তা জানাননি কেন? প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি নিজের মত প্রতিষ্ঠায় ভয় পেয়েছেন। সঞ্জয় বারু ইউপিএ-র প্রথম অধ্যায়ের কথা লিখেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়ে মনমোহন পাকিস্তান যেতেও দলের ছাড়পত্র পাননি। ওয়াশিংটনে যখন বারাক ওবামার সঙ্গে বৈঠক করছেন, তখন রাহুল গাঁধী অধ্যাদেশ নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করে কার্যত মনমোহনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন। সে দিন সঞ্জয় বারু টুইট করে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর উচিত ইস্তফা দেওয়া।

কেন প্রধানমন্ত্রী ইস্তফা দেননি, কেন তিনি মুখ বুঝে সহ্য করেছেন, তার জবাব একমাত্র মনমোহনই ভবিষ্যতে দিতে পারেন। এটা কি সরকার ও দলের সঙ্কট এড়াতে না কি নিজের দায়িত্বহীন কুর্সিকে সুরক্ষিত করতে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE