লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির প্রচার দেখে অনেকের মনে হয়েছিল, এ বার বোধহয় আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির এক ভারতীয় অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। জগদীশ ভগবতী আর অরবিন্দ পানাগাড়িয়ার মতো অর্থনীতিবিদ তো ভারতের অর্থনীতির সুস্বাস্থ্য কামনায় সংস্কারের তেতো-কড়া দাওয়াই সুপারিশ করতেও শুরু করেন।
ভোটের ফলাফলে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন হয়, সে নরেন্দ্র মোদীর এক অভূতপূর্ব সাফল্য। কিন্তু তার পর দেড় বছর কার্যত অতিবাহিত। গোটা দেশের আর্থিক হাল যে খুব আশাব্যাঞ্জক তা নয়। শেয়ার বাজারেরও ক্রমিক অধোগতি। বৃদ্ধির হার হতাশাজনক। সংস্কারমুখী কোনও বিলই সংসদে পাশ করাতে পারছে না সরকার। কারণ, রাজ্যসভায় বিজেপি সংখ্যালঘু। ইউপিএ জমানায় বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি যে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে, আজ কংগ্রেস বিরোধী দল হয়ে তার বদলা নিচ্ছে।
তবে আর্থিক সংস্কার বিগ টিকিট রিফর্ম কাকে বলে? বিল পাশ করাই সংস্কার নয়। এ কথা সত্য, আর্থিক সংস্কারের জন্য শিল্পায়ন প্রয়োজন। তার জন্য জমি বিল বা রিয়েল এস্টেট বিল পাশ হওয়া প্রয়োজন। ল্যান্ড সিলিং আইনের সংশোধন জরুরি। কিন্তু সংস্কারের মূল অভিমুখ হল ভর্তুকি, দান-খয়রাতি বন্ধ করে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করে পরিকাঠামোর উন্নয়ন। কর্মসংস্থান এবং শিল্পায়নই হবে সংস্কারের প্রধান পথ।
দেড় বছর পর কিন্তু এক নতুন নরেন্দ্র মোদীকে দেখছি আমরা। তিনি যেন সেই ইন্দিরা গাঁধী, যিনি ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ করেছিলেন। স্লোগান দিয়েছিলেন গরিবি হঠাওয়ের। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থা মৃতকল্প। সেখানে অক্সিজেন জুগিয়ে সেই মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানোই যেন নরেন্দ্র মোদীর প্রাথমিক কাজ। এখন উল্টে নরেন্দ্র মোদী শিল্পপতিদের সমাবেশে গিয়ে বলছেন, আপনাদের আর্থিক সাহায্য দিলে ইনসেনটিভ আর গরিব চাষিকে আর্থিক সহায়তা দিলে তা ভর্তুকি? এ কেমন কথা? এই বক্তৃতার পর সেই সমাবেশে এক শিল্পপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন যে তিনি কোথায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। শিল্প সমাবেশ নয়, বোধহয় তিনি ভেবেছিলেন কৃষক সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছেন।
নরেন্দ্র মোদী না ভেবে কথা বলেন না। কোনও সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দেওয়ার আগে তিনি যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেন। কাজেই এ ক্ষেত্রেও তিনি সবেতন ভাবেই গরিবের বন্ধু হতে চেয়েছেন।
গোটা দেশ জুড়ে প্রচার হয়েছে, এ সরকার অম্বানী-আদানির সরকার, এ সরকার ধনীদের সরকার। তিনি এই ধারণা, এই ছবিটা সচেতন ভাবে বদলাতে চাইছেন। অরুণ জেটলির মতো আধুনিক সংস্কারপন্থী অর্থমন্ত্রীও এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, মার্গারেট থ্যাচারের মতো কঠিন কঠোর আর্থিক সংস্কার সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় স্তম্ভগুলিতেই সম্ভব। বাস্তবে ও সব রূপায়ণ করা যায় না। ভারতের মাটিতে গরিবদের দুঃখমোচন না করা, দারিদ্র দূরীকরণ না করে কোনও অর্থমন্ত্রীই ভর্তুকি বন্ধ করে, শুধু রেল ভাড়া বাড়িয়ে বাজেট পরিবেশন করতে পারেন না। বৃদ্ধি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতেই হবে। আসলে বিজেপি রাজনৈতিক দল হিসেবেই দক্ষিণপন্থী নয়। মৌলিক প্রশ্ন, হিটলার নিজেই দক্ষিণপন্থী ছিলেন কি? ভুলে গেলে চলবে না, হিটলারের দলের নামও কিন্তু ছিল জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল। হিটলার শক্তিশালী রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন, আবার স্তালিনের সমাজতন্ত্র-ও সেই টোটালিটারিয়ানিজম। পুঁজিবাদ তো রাষ্ট্রকে দুর্বল করে ব্যক্তি স্বাধীনতার ধ্বজা ওড়ানোর মতাদর্শের কথা বলে, যার শিকড় আছে অ্যাডাম স্মিথের লেসি ফেয়ার তথা অবাধ বাণিজ্যে।
গাঁধীর সমাজতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির পুরো উল্টো অভিমুখে হেঁটেছিলেন নেহরু। তিনি সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের মডেল অনুসরণ করে ভারী শিল্প চান। আবার আরএসএস-দর্শনও কিন্তু যত না দক্ষিণপন্থী, অর্থনীতির প্রশ্নে তার চেয়ে অনেক বেশি বামপন্থী।
বিমার বেসরকারিকরণ, টেলিকম সংস্কারে যখন বাজপেয়ী সরকার অগ্রণী হয়, তখন স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের গুরুমূর্তির ভূমিকা কী ছিল, আরএসএসের ভূমিকা কী ছিল, সেটা আমরা ভুলিনি। বিজেপির ট্রেড ইউনিয়ন বিএমএস তো সিটুর চেয়েও কিছু কম নয়।
তাই এখন বিজেপি মানেও বামপন্থী অর্থনীতি যেমন ইউপিএ জমানায় ১৯৯১ সালের মনমোহন সিংহ হারিয়ে যান— সনিয়া-মনমোহন তখন হয়ে ওঠেন বামপন্থী। বিশেষত, কংগ্রেস ও সনিয়া গাঁধীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বামপন্থী কোনও এনজিও-র ভূমিকা নেয়।
নরেন্দ্র মোদীও ভারসাম্যের অর্থনীতি কার্যকর করতে চান— এ হল সেই মিশ্র অর্থনীতির প্রভাব। বিজেপি নেতারাই বলছেন, গরিব মানুষের দুঃখমোচনে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভূমিকা পালন না করলে মাওবাদীদের প্রকোপ বাড়বে। বিচ্ছিন্নতাবাদ তীব্র হলে তার সুযোগ নেবে মাওবাদীরা। জর্জ ফার্নান্ডেজের বিরোধী নেতার ভূমিকায় তখন যেমন রেল ধর্মঘট হয়েছিল, গোটা দেশ জুড়ে আবার সে রকম রেল ধর্মঘট হবে যদি রেলের ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয় আর রেল কর্মচারীদের বেতনে ছাঁটাই হয়। এই কারণেই রেলকর্মীদের বেতন কমিশনের সুপারিশভিত্তিক বর্ধিত বেতনের আর্থিক জোগান দিতে ইচ্ছুক না হলেও বাজেটের আগে সে ব্যবস্থা করতে হচ্ছে অরুণ জেটলিকে। অতীতে রেলমন্ত্রীদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক পপুলিজমের জন্যই রেলের এ হাল তা সরকার জানে, কিন্তু তা বলে কর্মচারীদের বেতন প্রদান তো বন্ধ করা যাবে না।
এ এক বিচিত্র পরিস্থিতি। আর এই পরিস্থিতিতে আজ নরেন্দ্র মোদীও সাবেক ইন্দিরা গাঁধীর মতোই সমাজতন্ত্রী মডেলের অভিমুখেই হাঁটছেন। সংস্কার ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ভারসাম্যই আপাতত লক্ষ্য এ সরকারের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy