ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের লেখা Annals of Rural Bengal পাঠকের কাছে অতি পরিচিত এক গ্রন্থ। হান্টার শিক্ষালাভ করেন প্যারিস এবং বন-এ। ১৮৬৯-এ সিভিল সার্ভিসের কর্মসূত্রে তাঁকে ভারতবর্ষের সংখ্যাতাত্ত্বিক সমীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর তিনি ১২৮ খণ্ডে স্থানীয় গেজেটিয়ার সম্পাদনা করেন। এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬৮ সালে। ঔপনেবেশিক প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন তিনি।
গ্রামীণ বাংলার এই ইতিহাস এখন পড়তে খুব ভাল লাগছে আবার ক্ষণে ক্ষণে মন বেদনাতুর হচ্ছে। একটা জিনিস খুব স্পষ্ট, সে দিনের বাংলার মানুষও ছিল বড় গরিব।
ভবিষ্যতের পথসন্ধানে অতীতের প্রাসঙ্গিকতা সবসময়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই অতীতচারিতায় বাংলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির শিকড় খুঁজে পাওয়া যায়। এই বই থেকে জানা যায়, ১৭৬৯ সনের শীতকালে বাংলার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যার জের দুই পুরুষ ধরে চলেছিল। দুর্ভিক্ষ কমিশন গঠিত হয় তখন। ১৭৬৮ সনের ফলনের ক্ষতির ফলে ১৭৬৯ সনের প্রারম্ভে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। পরবর্তী সময়ে বিষ্ণপুরের দেশীয় অধ্যক্ষ লেখেন, ধানের খেত হয়ে ওঠে শুকনো খড়ের মাঠ।
চরম দারিদ্র্য বা স্বভাবগত চরিত্রদোষের জন্যও কিছু ব্যক্তি লুণ্ঠনকার্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঠগ ও ডাকাতদের নিজেদের কাজের জন্য কোনও লজ্জাবোধ ছিল না। ওয়ারেন হেস্টিংস সাজাপ্রাপ্ত ডাকাতদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। তাই ব্রিটিশ সমাজের সূত্রপাতে বাংলার অবস্থা ছিল শোচনীয়। এই বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেখেছে। ষাটের দশকে এসেও বাংলা খাদ্যসঙ্কটের মুখোমুখি। অনেকে বলেন, কলকাতায় যে মায়েরা সবসময় বলেন, ওরে দু’মুঠো ভাত খেয়ে যা, অথবা ভাত ফেলিস না, ওটুকু খেয়ে নে! এ সব কথাবার্তার মধ্যেও বাংলার অন্ন সঙ্কটের এক জীবন্ত বেদনার ইতিহাস আছে। খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে আজও আলোচনা চলছে। ভোটের সময় তাই দু’টাকা কিলোয় চাল একটা বড় নির্বাচনী ইস্যু হয়।
পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে, এই ক্ষুধার্ত বাংলার চিত্রটি বোধহয় বদলানোর নয়। এ আমাদের ভবিতব্য। কংগ্রেস বাংলায় শাসন করেছে, সিদ্ধার্থ রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস তাণ্ডবের সাক্ষী বঙ্গসমাজ। এর পর সিপিএমের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসন। জেলায় জেলায় রাজনৈতিক হিংসা বাংলার রাবীন্দ্রিক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সিপিএম প্রথম শিল্পমুখী বাংলা তৈরির কথা বলেন। বুদ্ধবাবু সফল হননি। বরং বাঙালি তাকেও ইতিহাসের এক বিয়োগান্ত নায়কে পরিণত করে। মমতার রাজনৈতিক আন্দোলন দেখে মনে হয়েছিল এই ক্ষুধার্ত বাংলা হয়তো উন্নয়নের নতুন রাস্তা নেবে।
পাঁচ বছর পর কী দেখছি?
সিপিএমের ফেলে আসা পথ দিয়েই কি হাঁটতে চাইছে তৃণমূল? সে দিনের হার্মাদবাহিনী আর আজ সিন্ডিকেট বাহিনী, সর্বত্রই পেশীশক্তির দলীয় আধিপত্যকামিতা। আবার সিপিএম-কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে বাংলাকে নতুন নতুন শিল্প কারখানায় মুড়িয়ে দেবে— এমনটা ভাবতে গেলেও বিষম খাই।
পোস্টার আর বিজ্ঞাপনি প্রচারে ‘মিথ’ তৈরি হতে পারে, মানুষকে অবতার সাজানো যায়, কিন্তু তারপর মাটির প্রতিমার রং উঠে যায়, খড়ের কাদার কাঠামো বেরিয়ে পড়ে দাঁত বের করে হাসে। সোমনাথ হোড় বলেছিলেন, যখনই কোনও মূর্তি রচনা করি, মনে হয় আমার আঙুলের মধ্যে দিয়ে বাংলার বেদনা মূর্ত হচ্ছে প্রতিটি মূর্তিতে। সম্প্রতি একটা বই পড়ছি। Chinese propaganda posters— from the collection of Michael Wolf. মাওয়ের শাসনে ৩০০টা পোস্টার তৈরি করা হয় কমিউনিস্ট মূল্যবোধের প্রচারে। সে সব পোস্টার চিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি দেখায়। মাওয়ের স্ত্রী Jiana chung একটি ছবি তৈরি করেন। কিন্তু হঠাৎ মাওয়ের মৃত্যুর জন্য ছবিটি মুক্তি পায়নি। কিন্তু সে ছবিটিতেও এক উজ্জ্বল চিনের ভবিষ্যৎ কাহিনি তুলে ধরা হয়। হিটলারের জীবন নিয়েও এক প্রোপাগান্ডা তথ্যচিত্র তৈরি হয়। সে-ও ছিল দারুণ সফল তথ্যচিত্র।
ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও এই উজ্জ্বল ছবি তুলে ধরা স্বপ্ন বিক্রির সওদাগর তো সব দলের নেতারাই। কেউ বেশি, কেউ কম। আজকাল আধুনিক প্রযুক্তি সোস্যাল মিডিয়াকেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
কিন্তু ক্ষুধার্ত বাংলার স্মৃতি থেকে বাঙালি মুক্ত হবে, এমন নিশ্চয়তা আজও পাচ্ছি কই?
চাই কর্মসংস্থান। চাই ভারি শিল্প। চাই বেকারি মুক্তি। চাই খাদ্য সুরক্ষা।
নির্বাচনী ফলাফল সেই বাংলা রচনার নিশ্চয়তা দেবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy