Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দলে বেনোজল আটকে রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে মমতাকে

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে মা দুর্গারূপী ইন্দিরা গাঁধীও ‘ডাইনি’ হয়ে গিয়েছিলেন। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল ভারতের বিজ্ঞাপন জগতের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব হলেন পীযূষ পাণ্ডে। নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির হয়ে ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রচার কৌশল রচনায় যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে পীযূষ অন্যতম। সম্প্রতি পীযূষ ‘পাণ্ডেমোনিয়াম’ শীর্ষক একটি বই লিখেছেন।

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৬ ০৪:০৪
Share: Save:

ভারতের বিজ্ঞাপন জগতের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব হলেন পীযূষ পাণ্ডে। নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির হয়ে ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রচার কৌশল রচনায় যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে পীযূষ অন্যতম। সম্প্রতি পীযূষ ‘পাণ্ডেমোনিয়াম’ শীর্ষক একটি বই লিখেছেন। এই বইটিতে বার বার নানা ভাবে তিনি একটা কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। সেটি হল, মানুষের সঙ্গে খুব সহজ ভাবে যোগাযোগ গড়ে তোলা প্রয়োজন। জনসংযোগের যদি জটিলতা না থাকে, তা হলে সেটি অনেক সহজেই অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে স্পর্শ করতে পারে।

পীযূষ লিখছেন, ২০১৩-র জুলাই মাসে একটি বেসরকারি টিভি সংস্থা গোটা দেশে জনমত সমীক্ষা করে। তখনও দেখা যায়, গোটা দেশ বিজেপিকে সমর্থনের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। বিজেপি এগিয়ে থাকলেও সরকার গঠনের মতো পরিস্থিতি ছিল না। বেশির ভাগ সমীক্ষাই বলতে শুরু করেছিল, কোনও একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে না। ফলে ত্রিশঙ্কু লোকসভার সম্ভাবনাও দেখছিল অনেকে। ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বিজেপি নরেন্দ্র মোদীর নাম ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসেবে। তার পরেই পরিস্থিতিতে বিরাট বদল আসে। তখন বিজেপির কমিউনিকেশন পার্টনার কে হবে, সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। অনেক প্রেজেন্টেশনের পর বিজেপি ‘সোহো স্কোয়ার’-কে অ্যাকাউন্টটা দেয়। এই ‘সোহো স্কোয়ার’ সংস্থাটি ‘ওগিলভি’ নামক বিজ্ঞাপন সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করছিল। পীযূষ পাণ্ডে ছিলেন এই সংস্থার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। সমস্ত সমীক্ষা চালিয়ে পীযূষ ঠিক করেন, সংযোগের স্লোগান হবে শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদীর নামে, অন্য আর কিছু নয়। ফলে স্লোগান তৈরি হল, ‘আব কি বার, মোদী সরকার’।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের সময় বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশ তাঁর বিরুদ্ধে ছিল। এক বার নীতীশ কুমারের বিজ্ঞাপন ম্যানেজার প্রশান্ত কিশোর, যিনি আগে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও কাজ কররেছেন, তাঁর সাহায্য নেওয়ার কথা হয়েছিল। পটনায় নীতীশ কুমারের বাড়িতে এক বার প্রশান্তের সঙ্গে মমতার কথাও হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রশান্ত কিশোরকে নির্বাচনী রণকৌশলের দায়িত্ব অর্পণ করতে রাজি হননি মমতা। মমতা নিজেই তাঁর নির্বাচনী প্রচার এবং মানুষের সঙ্গে সংযোগ ব্যবস্থার এক অভিনব নিজস্ব কৌশল রচনা করেছিলেন। ফলে মমতার নির্বাচনী প্রচারের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ছিলেন মমতা নিজেই। পীযূষ পাণ্ডে তাঁর বইতে আরও বলছেন, মোদীর পক্ষে যে সব মানুষ বিজ্ঞাপনের প্রচারে কথা বলছিলেন, তিনি চেষ্টা করতেন সেগুলি কোনওটাই সাজানো বা বানানো না হয়। জনসভা বা বিভিন্ন জায়গায় সত্যি সত্যি যে সব মানুষ তাঁর পক্ষে কথা বলেছেন, তাঁদেরই বক্তব্য রেকর্ড করে কাজে লাগাতেন।

পীযূষ বলেছেন, এক বার অমিতাভ বচ্চনকে দিয়ে একটি ক্যাডবেরির বিজ্ঞাপন করতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন, কী ভাবে ক্যাডবেরি খেয়ে সাধারণ মানুষের অভিব্যক্তিকে ধরা হয়েছিল। আর সেটি বিপুল ভাবে কাজে দিয়েছিল। কোনও বিজ্ঞাপন সংস্থা ছাড়াই মমতা খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে নিজেকে কানেক্ট করতে সক্ষম হন।

ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদী গত দু’বছরে কিন্তু এখন খুব চ্যালেঞ্জের মুখে। দেখা যাচ্ছে, লোকসভা ভোটের সময় তৈরি হওয়া হাইপ ও বিপুল প্রত্যাশা, সেটি এখন অনেক ক্ষেত্রে বুমেরাং হচ্ছে। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন সবে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছেন। এ বারের নির্বাচনী প্রচারের প্রতিপক্ষ খুবই বেশি মমতা-বিরোধী সমালোচনায় মুখর ছিল। মমতার একটি মস্ত বড় সুবিধা হচ্ছে, তাঁর গগনচুম্বী প্রত্যাশা নেই। ভোটের সময় সংবাদমাধ্যম এবং বিজ্ঞাপন— দুটোরই প্রয়োজন খুব বেশি হয়। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হল, বাস্তবে যদি তুমি কাজ করতে না পারো, মানুষের প্রত্যাশা পূরণ না হয়, তা হলে কিন্তু মা দুর্গারূপী ইন্দিরা গাঁধীও ‘ডাইনি’তে পরিণত হন। ‘মিস্টার ক্লিন’ রাজীব গাঁধী ‘বফর্স গাঁধী’তে পরিণত হন। ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ আর ‘ফিল গুড’ ফ্যাক্টরের প্রচারকেও ম্লান করে দিয়েছিল কৃষকদের আত্মহত্যা।

এটি ঠিক, এখন একটি মিডিয়া যুগের মধ্য দিয়ে চলছি, যেখানে প্রতি দিন রাজনেতাকে পরীক্ষা দিতে হয়, তিনি কী ভাবে নিজেকে ক্যামেরার সামনে প্রতিষ্ঠিত করছেন। যাকে বলে পারসেপশন। কিন্তু সেটির একটি আংশিক ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু মমতা যদি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের কাজে সফল না হন, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হয়, সমাজবিরোধী আর লুম্পেনদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে, তা হলে কিন্তু আগামী দিন তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের জন্য সুখের হবে না।

একটি জিনিস লক্ষ্য করছি, এ বারে মমতা অনেক বেশি সজাগ। ২০১১ সালের ২০ মে রাজভবনে যে দিন শপথ নিয়েছিলেন মমতা, সে দিন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাটের কোনও অভিজ্ঞতাই তাঁর ছিল না। আর এখন সেই মমতাই পাঁচ বছর ধরে প্রশাসনের ভিতরে থেকে রাজ্য পরিচালনার হাল হকিকতটা সচক্ষে দেখেছেন। যে মমতা রাজভবন থেকে হেঁটে হেঁটে রাইটার্সে এসেছিলেন, আজ যে মমতা নবান্নে বসে রাজ্য চালাচ্ছেন, তাঁরা দু’জন কিন্তু এক ব্যক্তি নন। লক্ষ্য করছি, মমতা কথা কম বলছেন। টেলিভিশনে বাইট খুবই কম। অভ্যন্তরীণ নির্দেশ অনেক বেশি। অমিত মিত্র সাংবাদিক বৈঠক করে শিল্প ক্ষেত্রে নতুন ঘোষণা করছেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকছেন পিছনে। তৃণমূল কংগ্রেসের দলীয় সম্মেলনে যে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা তিনি করেছেন, সেটিও কিন্তু ইতিবাচক। নারদ কেলেঙ্কারির তদন্ত নিয়ে সমালোচনা হলেও সেটি নির্বাচনী ইতিহাসের একটি বোঝা। কিন্তু সব ভুলে এখন যদি মমতা দলের ভিতরে ঢুকে পড়া বেনোজল আটকে সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পশ্চিমবঙ্গকে একটি ইতিবাচক অভিমুখে নিয়ে যেতে অগ্রণী হন, তবে তাতেই বাংলার মঙ্গল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE