Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ব্রিটেনের বিচ্ছেদে বিশ্বের রাজনৈতিক অভিমুখ স্পষ্ট হচ্ছে

ধর্ম এবং ঈশ্বরকেন্দ্রিক মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরশীলতার সঙ্গেই বাড়ছে রাষ্ট্রের উগ্র জাতীয়তাবাদ। ভারতও কি ব্যতিক্রম? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালএ বারে ইওরোপ থেকে ব্রিটেনের কাহিনি যখন গোটা দুনিয়া জুড়ে তোলপাড় শুরু করে দিল, ঠিক সেই সময় ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ এক প্রবন্ধে একটি প্রশ্ন তুলেছেন।

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

এ বারে ইওরোপ থেকে ব্রিটেনের কাহিনি যখন গোটা দুনিয়া জুড়ে তোলপাড় শুরু করে দিল, ঠিক সেই সময় ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ এক প্রবন্ধে একটি প্রশ্ন তুলেছেন।

টনি ব্লেয়ারের ধারণা, গোটা পৃথিবীতে যে একটি পুঁজিবাদের উদারনৈতিক মডেল বিশ্বায়নের পথে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই যাত্রাপথেই বোধহয় একটি বিঘ্ন সূচিত হয়েছে। আর সেই কারণে যে-ব্রিটেন শুধু ইউরোপ কেন, গোটা পৃথিবীর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সংযোগ স্থাপন করেছিল, সেই ব্রিটেন আবার ফিরে আসছে এক শক্তিশালী রাষ্ট্র নির্মাণে। সেখানে ব্রিটেন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্র হিসেবে উদারবাদের পথ ছেড়ে রক্ষণশীলতার পথে হাঁটছে। অর্থনীতিতে যাকে বলে প্রোটেকশনিজম। সেই তত্ত্ব আবার ভয়াবহ ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। টনি ব্লেয়ার এই উল্টোরথের প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছেন ‘বিশ্বজনীন কেন্দ্র-বাদ’। অর্থাৎ Strong centrism।

অ্যাডাম স্মিথ যে অবাধ বাণিজ্য নীতির কথা বলেছিলেন, সেই অর্থনীতির মডেল আমদানি-রফতানি নীতিকে শিথিল করে বিশ্বকে একটি গ্রামে পরিণত করল নব্বইয়ের দশকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও আমাদের দেশেও সেই পথ অনুসরণ করে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের মাধ্যমে নিয়ে এলেন আর্থিক উদারবাদ। টনি ব্লেয়ার বলেছেন, ইউরোপের সঙ্গে ব্রিটেনের সংযুক্তিকরণের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অন্যতম স্থপতি। কারণ, ইউরো জোন আর ইউরো মুদ্রা তৈরির সময় ঘটনাচক্রে তিনিই ছিলেন সে দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী।

লন্ডনের ঘটনা আকস্মিক নয়। এই আরম্ভের আগেরও আরম্ভ আছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী গণভোটের ভিত্তিতে ইস্তফা দিলেন এক সঙ্কটবিন্দুতে। কিন্তু ডেভিড ক্যামেরনের বিরুদ্ধে লন্ডনের প্রাক্তন মেয়র বরিস জনসন অনেক বেশি জঙ্গি রক্ষণশীল অবস্থান নিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক ছাত্রদের সেখানে লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে ব্রিটেনের সরকার অনেক রক্ষণশীল মনোভাব নিতে শুরু করেছিল। পূর্ব ইউরোপ শুধু নয়, ভারত-চিন-পাকিস্তান সমেত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশের মানুষকে ব্রিটেনে বসবাস করার ব্যাপারে অনেক বেশি কঠোর মনোভাব নেওয়া শুরু হয়েছিল। যেমন বাল ঠাকরে মহারাষ্ট্রে মরাঠিদের জন্য স্লোগান তোলেন, ঠিক সে ভাবে ব্রিটেনে ব্রিটিশদের জন্য এই স্লোগান উঠেছিল। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল যে ব্রিটেনেও রাজনৈতিক দলগুলি স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের মতো কট্টর স্বদেশি লাইন নিতে চাইছে।

আমার এক মাস্টারমশাই একবার ক্লাসরুমে বলেছিলেন, গোটা পৃথিবী দু’টি শক্তি পেন্ডুলামের মতো এক বার এ দিক আর এক বার ও দিক করেছে। একটি শক্তি হল একত্রীকরণের শক্তি। যেমনটি হয়েছিল হিটলারের জার্মানিতে, বিসমার্কের ইতালিতে কিংবা স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে। ভারতের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, যেমন হয়েছিল সম্রাট অশোক বা আকবরের সময়। আর একটি শক্তি হল, বিচ্ছিন্নতা শক্তি। সেই শক্তিতে শক্তিশালী সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে জাতি রাষ্ট্র গঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে যাকে বলা হয়েছে বলকানাইজেশন। সেই বলকানাইজেশনের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত বোধহয় স্কটল্যান্ড।

নরেন্দ্র মোদী এ বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অধ্যাপক ভারতের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ বলে একটি গ্রন্থ প্রকাশনা করেন। সেই বইটিতে সেই অধ্যাপকেরা বলেছিলেন, ভারতেও আবার এক শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা বাড়ছে। মুখে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের কথা বললেও আসলে হিন্দুত্বকে মূলধন করে এক শক্তিশালী ভারত গঠনই হল মোদীত্ব। আর্থিক মন্দা বিশ্বজুড়ে। দারিদ্র ও বেকারি বাড়ছে পৃথিবীর বহু উন্নত দেশেও। এই পরিস্থিতিতে এক দিকে কুসংস্কার বাড়ছে, ধর্ম এবং ঈশ্বরকেন্দ্রিক মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আর সেই পরিস্থিতিতে বাড়ছে রাষ্ট্রের উগ্র জাতীয়তাবাদ। ইউরোপের সঙ্গে ব্রিটেনের বিচ্ছেদের অর্থনৈতিক ফলাফল কী হবে, সেটি ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর এক রাজনৈতিক অভিমুখ উপলব্ধি করা যায়, যে প্রবণতা থেকে ভারতও বিচ্ছিন্ন নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Brexit world political
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE