Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
শাহি সমাচার

রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের প্রকোপ বাড়ছে বিশ্বজুড়েই

ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালএ বারে ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদের কাহিনি যখন গোটা দুনিয়া জুড়ে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে, ঠিক সেই সময় ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ লেখা এক নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন, গোটা পৃথিবী কি আবার এক শক্তিশালী কেন্দ্রের ভাবনার দিকে ধাবিত হচ্ছে?

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

এ বারে ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদের কাহিনি যখন গোটা দুনিয়া জুড়ে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে, ঠিক সেই সময় ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ লেখা এক নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন, গোটা পৃথিবী কি আবার এক শক্তিশালী কেন্দ্রের ভাবনার দিকে ধাবিত হচ্ছে? মনে হচ্ছে টনি ব্লেয়ারের তোলা আশঙ্কাটি নিয়ে আলোচনাকে আর একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক।

গোটা পৃথিবীতে যে পুঁজিবাদের একটি উদারনৈতিক মডেল বিশ্বায়নের পথে এই দুনিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই যাত্রাপথেই বোধহয় একটি বিঘ্ন সূচিত হয়েছে। ব্রিটেন শুধু ইউরোপ কেন, একদা গোটা পৃথিবীর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সংযোগ স্থাপন করেছিল, সেই ব্রিটেন আবার ফিরে আসছে এক শক্তিশালী রাষ্ট্র নির্মাণে। সেখানে ব্রিটেন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্র হিসেবে উদারবাদের পথ ছেড়ে রক্ষণশীলতার পথে হাঁটছে। অর্থনীতিতে একেই তো বলে প্রোটেকশনিজম। চিন সফরে গিয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এক বার সকলের সামনে বলেছিলেন, ভারত তথা দেশের বাইরে চিন বিনিয়োগে আগ্রহী। কিন্তু নিজের দেশের ভিতর অন্য দেশের লগ্নি আনতে আগ্রহী নয়। এর ফলে ভারত-চিনের বাণিজ্যিক ঘাটতির সমাধান হয় না। চিনকে এই প্রোটেকশনিজম থেকে বেরনোর অনুরোধ করেছিলেন মনমোহন সিংহ। আজ চিন কেন, গোটা পৃথিবী এই রক্ষণশীলতার পথে হাঁটছে। এই উল্টোরথের প্রক্রিয়াকেই টনি ব্লেয়ার বলছেন, শক্তিশালী কেন্দ্রবাদ।

অ্যাডাম স্মিথ যে অবাধ বাণিজ্য নীতির কথা বলেছিলেন, সেই অর্থনীতির মডেল আমদানি-রফতানি নীতিকে শিথিল করে বিশ্বকে একটি গ্রামে পরিণত করল নব্বইয়ের দশকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও আমাদের দেশেও সেই পথ অনুসরণ করে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের মাধ্যমে নিয়ে এলেন আর্থিক উদারবাদ। ইউরোপের সঙ্গে ব্রিটেনের সংযুক্তিকরণের সময় টনি ব্লেয়ার ছিলেন অন্যতম স্থপতি। ইউরো জোন আর অভিন্ন ইউরো মুদ্রা তৈরির সময় ঘটনাচক্রে তিনিই ছিলেন সে দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী।

লন্ডনের ঘটনা আকস্মিক নয়। এই আরম্ভের আগেও আরম্ভ আছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী গণভোটের ভিত্তিতে ইস্তফা দিলেন এক সঙ্কটবিন্দুতে। কিন্তু ডেভিড ক্যামেরনের বিরুদ্ধে লন্ডনের প্রাক্তন মেয়র বরিস জনসন অনেক বেশি জঙ্গি রক্ষণশীল অবস্থান নিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক ছাত্রদের সেখানে লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে ব্রিটেনের সরকার অনেক রক্ষণশীল মনোভাব নিতে শুরু করেছিল। পূর্ব ইউরোপ শুধু নয়, ভারত-চিন-পাকিস্তান সমেত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশের মানুষকে ব্রিটেনে বসবাস করার ব্যাপারে কঠোরতর মনোভাব নেওয়া শুরু হয়েছিল। যেমন বাল ঠাকরে মহারাষ্ট্রে মরাঠিদের জন্য স্লোগান তোলেন, ঠিক সে ভাবে ব্রিটেনে ব্রিটিশদের জন্য এই স্লোগান উঠেছিল। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল যে ব্রিটেনেও রাজনৈতিক দলগুলি স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের মতো কট্টর স্বদেশি লাইন নিতে চাইছে।

আমার এক মাস্টারমশাই এক বার ক্লাসরুমে বলেছিলেন, গোটা পৃথিবীতে দু’টি শক্তি পেন্ডুলামের মতো এক বার এ দিক আর এক বার ও দিক করেছে। একটি শক্তি হল একত্রীকরণের শক্তি। যেমনটি হয়েছিল হিটলারের জার্মানিতে, বিসমার্কের ইতালিতে কিংবা স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে। ভারতের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, যেমন হয়েছিল সম্রাট অশোক বা আকবরের সময়। আর একটি শক্তি হল, বিচ্ছিন্নতা শক্তি। সেই শক্তিতে শক্তিশালী সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে জাতি রাষ্ট্র গঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে যাকে বলা হয়েছে বলকানাইজেশন। সেই বলকানাইজেশনের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত বোধহয় স্কটল্যান্ড।

দিল্লির মসনদে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসার আগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অধ্যাপক ভারতের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেই বইটিতে অধ্যাপকেরা বলেছিলেন, ভারতেও আবার এক শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা বাড়ছে। মুখে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের কথা বললেও আসলে হিন্দুত্বকে মূলধন করে এক শক্তিশালী ভারত গঠনই হল মোদিত্ব। আর্থিক মন্দা বিশ্বজুড়ে। দারিদ্র ও বেকারি বাড়ছে পৃথিবীর বহু উন্নত দেশেও। এই পরিস্থিতিতে এক দিকে কুসংস্কার বাড়ছে, ধর্ম এবং ঈশ্বরকেন্দ্রিক মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আর সেই পরিস্থিতিতে বাড়ছে রাষ্ট্রের উগ্র জাতীয়তাবাদ। ইউরোপের সঙ্গে ব্রিটেনের বিচ্ছেদের অর্থনৈতিক ফলাফল কী হবে, সেটি ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর এক রাজনৈতিক ট্রেন্ড উপলব্ধি করা যায়, যে প্রবণতা থেকে ভারতও বিচ্ছিন্ন নয়।

অতীতে ভারতের রাজনীতিতে ছিল এক দলের আধিপত্যযুক্ত একটি বহুদলীয় ব্যবস্থা। রজনী কোঠারি এই বৈশিষ্ট্যের নাম দিয়েছিলেন কংগ্রেস সিস্টেম। ভারত যুক্তরাষ্ট্র হলেও সে দিনের কংগ্রেসও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই রাষ্ট্রের মূল মন্ত্র ছিল, বহুত্ববাদ। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য শুধু দেশের ভিতরে নয়, এসো আর্য, এসো অনার্য মানসিকতা ছিল। ছিল না জেনোফোবিয়া। কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃত্বের অভিজাততন্ত্র থেকে আমজনতা যত বিচ্ছিন্ন হতে লাগল, তত গড়ে উঠল জাতপাত ধর্মের ভিত্তিতে নানা আঞ্চলিক দল। কাশ্মীর থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চল, তামিলনাড়ু থেকে গোর্খাল্যান্ড— বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রকোপ বিভিন্ন সময়ে ভয়াবহ চেহারা নেয়। কাজেই ভারতেও অশোক থেকে আকবর, সকলকে নিয়ে চলার দীন-ই-ইলাহি মন্ত্র যেমন দেখেছি, তেমন দেখেছি বিচ্ছিন্নতার বিদ্রোহ। পেন্ডুলামটি আজও এক বার এ দিক, এক বার ও দিক করে যাচ্ছে। গোটা পৃথিবী জুড়ে এই যে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের প্রকোপ বাড়তে দেখা যাচ্ছে, সেটাও কি ভারতের বহুত্ববাদকে এসে আবার আঘাত করবে না! আসলে রাজনীতিতেও বোধহয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা দেখা গিয়েছে। কেন্দ্রাতীত ও কেন্দ্রানুগ শক্তির ভারসাম্য প্রকৃতির স্থিতাবস্থা বজায় রাখে। গোটা পৃথিবীর রাজনীতিতে এই জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকেও একটা সিন্থেসিসের রাস্তা বের করার সময় এসেছে। বৌদ্ধধর্মে যা মজ্ঝিম পথ বা মধ্যপন্থা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

David Cameron Jayanta Ghoshal Brexit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE