Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
শাহি সমাচার

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আর তিন তালাক বিতর্ক, পা ফেলা হোক সাবধানে

সাম্প্রতিক এই বিতর্ক নিয়ে সুচিন্তিত আলোচনায় প্লেটো এবং কৌটিল্য! শুনলেন জয়ন্ত ঘোষালসাম্প্রতিক এই বিতর্ক নিয়ে সুচিন্তিত আলোচনায় প্লেটো এবং কৌটিল্য! শুনলেন জয়ন্ত ঘোষাল

প্রচারে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

প্রচারে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

প্লেটো মশাই, আপনি যে আমার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সত্যি সত্যি আজ ‘শাহি সমাচার’-এর মঞ্চে হাজির হবেন, সত্যি বলছি এটা আমি ভাবতেই পারিনি! টাইম মেশিনে চেপে ২০১৬-র অক্টোবর মাসে দিল্লি চলে আসাটা খুব সহজ ব্যাপার নয়।

কিছু মনে করবেন না, আমরা আসলে শাহি সমাচারে তিন তালাক বিতর্ক নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমার এক ফেসবুক-বন্ধু লেখাটি পড়ে বলেছেন, বিজেপির এতে লাভ যদি হয় তো হোক, তা বলে মুসলিম নারীদের লিঙ্গ ইস্যুতে তাঁর স্বাধিকার দাবি করব না?

প্লেটোবাবু: আমি সব জানি। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আর তিন তালাক নিয়ে এখন কী হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র যা করছে তা কেন করছে, তা কি জনকল্যাণে? সবচেয়ে প্রথম সেটা বুঝতে হবে।

স্যার, আরও একটু বোঝান। খবর এসেছে কৌটিল্যও আসছেন খুব শীঘ্র। কিন্তু আপনি বলুন।

প্লেটোবাবু: রাষ্ট্রের ধর্মের দু’টি দিকের কথা অন্ধ সক্রেটিস আমাকে বলেছিলেন। প্রথমত, মিতাচার। দ্বিতীয়ত, ন্যায়। আমি সক্রেটিসকে বলেছিলাম, মিতাচারকে পাশে সরিয়ে রেখে আমরা ন্যায়ের পথে যাব? তা উনি বললেন, সেটা কী করে সম্ভব? মিতাচার হচ্ছে আনন্দ-আকাঙ্খাকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসা, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটাকেই বলে নিজের কর্তা নিজে হওয়া। মানে তুমি রাষ্ট্রের চাকর আবার রাষ্ট্র নামক চাকরের কর্তা। হা...হা...হা (অট্টহাস্য)।

মিতাচার আর আত্মকর্তৃত্ব। তোমাদের প্রজারাই তো রাজাকে মনোনীত, নির্বাচিত করেছে। সেই রাষ্ট্র বলছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সব নাগরিকের মধ্যে সাম্য। তবে সেটাই তো কাঙ্খিত। সমস্যাটা কোথায়? আর রাষ্ট্র এ কথাও বলছে, নরেন্দ্র মোদী তাড়াহুড়ো করছেন না। মেনে নাও, তিন তালাকের প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। প্রবলেমটা কোথায়? আসলে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড বলছে ব্যক্তিগত ধর্মীয় আইনগুলিও মানতে হবে। সেটি সাংবিধানিক আইন হোক ছাই না হোক।

ঠিক এই সময়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলেন সেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, সেই অর্থশাস্ত্রের, সেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৌটিল্য। তিনিও এসেছেন হোমওয়ার্ক করে।

স্যার, আপনার সঙ্গে প্লেটোর আলাপ করিয়ে দিই। উনিই সেই গ্রিক দার্শনিক। আমরা আলোচনা করছি তিন তালাকের কিসসা নিয়ে...

কৌটিল্য: সমসাময়িক ইতিহাসটুকু তো পড়, না-ই বা পড়লে আমার সময়কার ইতিহাস! দেখ, ’৪৭ সালের স্বাধীনতার পর গণপরিষদেও এই নিয়ে বিতর্ক হয়। তখন ভারতীয় সংবিধানের ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে মুসলিম নেতারা শঙ্কিত হন। ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদে কার্যত অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে ব্যখ্যা করে বলা হয়, এই আইনের কথা বলা হলেও শরিয়ত বা ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইনের পরিসর আপাতত থাকবে মুসলিম সমাজের জন্য। অম্বেডকর নিজেই আশ্বাস দেন, it was adopted in the shariat act of 1937 when it was applied to femintores other than the north west frontier province.

মুসলমানদের জন্য শরিয়ত আইনকে জীবিত রাখার আশ্বাস দিয়েছিলেন খোদ অম্বেডকর। অতএব আজও সেই বিতর্কই চলছে।

আসলে সমস্যাটা হচ্ছে অন্যত্র। ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম আমি। উত্তরপ্রদেশে ভোট আসছে। ঠিক তার আগে বিজেপি এই ইস্যুকে শাহবানু মামলার দ্বিতীয় অধ্যায় বানাতে চাইছে। সেটাই সমস্যা।

কৌটিল্যবাবু: তোমাদের সমস্যা হচ্ছে, তোমরা বুঝতেই পারো না বিপদটা আসছে কোথা থেকে! মেরুকরণের রাজনীতি ভোটের জন্য লাভজনক হলেও আসলে ভারতীয় সামজের গণতান্ত্রিক কাঠামোর শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তো অনেক সময় বুঝতে চায়নি। তোমাদের ডি এল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত নাটকের কথা ভুলে গেলে নাকি? চন্দ্রগুপ্ত তো কৌটিল্য, মানে চাণক্যকেও ভুল বুঝেছিল। বলেছিল, এই লোকটার কথা শুনে আমরা চলবে কেন? দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যকে বলেছিল, দেখছি যে নিজের সাম্রাজ্যে আমি বন্দি! নিজের গৃহে আমি ভৃত্য!

কৌটিল্য: আসলে, চন্দ্রগুপ্তকে পরাস্ত করতে বিজয়ী সেলুকাসের গোপন ষড়যন্ত্র যে আমি বুঝতে পেরেছিলাম এবং চন্দ্রগুপ্তকে বাঁচাতে সেই কৌশলই গোপনে ঠেকাতে ব্যস্ত ছিলাম, সে কথা, এমনকী, চন্দ্রগুপ্তও জানতেন না। বাস্তব কৌশলও জরুরি।

কৌটিল্যবাবু প্লেটোবাবুকে এটাই বোঝাতে চাইছেন, শুধু দর্শন নয় চাই বাস্তব কৌশল। সব সময়েই তো যুদ্ধ চলছে। তাই কৌশলও মানতে হবে। প্লেটোবাবু বলছেন, ভোটের রাজনীতি সব গুলিয়ে দিচ্ছে। মহম্মদের বিয়ের মধ্যেও তো বাস্তববোধ ছিল। মহম্মদের কাকা এসে তাঁকে বলেন, এই মেয়েটিকে বিবাহ করাই উচিত। কারণ? তখন মহম্মদের বয়স ২৫। তাঁর কাকা আবু তালিব এসে বলেন, আমার কাছে টাকা নেই। Now there is a caravan of your own tribe about to start for Syria and khadijah as daughter of khuwayud is in need of the services of men of our tribe to take care of her merchandise. Be it as your say, মহম্মদের বিবাহের এই কাহিনিটি পাওয়া যায় অমুক চন্দ্র অমুকের গ্রন্থে। (পরে বলছি)। কিন্তু বিবাহ যে জীবনের কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সেটা ইসলামের ছত্রে ছত্রে। বিবাহের নৈতিকতার গুরুত্ব বার্ট্রান্ড রাসেল-ও তাঁর marriage and its morals গ্রন্থে বলেছেন। কিন্তু বিবাহ যেমন হিন্দুধর্মে কুলীন ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত ঘটনা ছিল ঠিক তেমনই রণব্যস্ত আরবেও এই প্রথার ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা ছিল। আজ এত বছর পরে বহুবিবাহের বৈধতা যখন মুসলিম রাষ্ট্রগুলি থেকে উঠে যাচ্ছে তখন ভারতে gender issue-র জন্য মুসলিম ল বোর্ড সেটি মেনে নেবে না?

কৌটিল্য: আমিই চাণক্য। আমিই কৌটিল্য। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের কথা বলে আর চাণক্য নীতিবিদ্যা। বিজেপি যা করছে তা হল কৌশলের রাজনীতি। সেটা কে করে না বলুন? ম্যাকিয়াভেলিও সে কথাই বলেছিলেন। অয্যোধ্যা, ৩৭০ ধারার মতো ইস্যু যদি এখন সে ভাবে ব্যবহার করা না যায় তবে বিজেপির পক্ষে তালাক এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কর্মসূচিকে গুরুত্ব দেওয়া তো সুষ্ঠু রণকৌশল। তবে হবস যেমন ম্যাকিয়াভেলির কৌশলের ভিত্তিকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে মানুষ সম্পর্কে এক তীব্র নেতিবাচক সিনিক মন্তব্য করেছিলেন, মানুষ, poor, brutish, nasty and small. চাণক্য কিন্তু তার নীতিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে ভারতীয় মানবতার উদারতাকেও তুলে ধরেছেন বার বার।

প্লেটোবাবু: দেখুন কৌটিল্যবাবু, আপনি রিপাবলিক পড়ুন দেখবেন গ্রিক দর্শনেও রাজধর্ম আছে। দার্শনিক রাজার কথা তো আমিই বলেছিলাম। রাষ্ট্র আর ধর্মকে আলাদা করে মধ্যযুগেই তো ভেদজ্ঞান আনা হল।

কৌটিল্য: রাজধর্ম তো আমিও বলেছি। আজ তাই তালাক নিয়ে সাবধানে পা ফেলুন। যুক্তি দিয়ে কথা বলছেন বটে কিন্তু আসলে উদ্দেশ্যটা মহৎ নয়। সেটা বাঞ্ছনীয় নয়।

আজ সময় শেষ। প্লেটোবাবু আর কৌটিল্য স্যার, দু’জনকেই বিদায় জানাতে হচ্ছে। ওঁরা যদি সময় করতে পারেন তবে সামনের বুধবার আবার আসবেন আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে এই শাহি সমাচারের মঞ্চে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE