Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

নেতৃত্ব দিশাহীন, চূড়ান্ত সঙ্কটে কংগ্রেস

কংগ্রেসের এখন বোধোদয়ের সময়। আত্মশুদ্ধির সময়। আত্মসমীক্ষার সময়। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালকংগ্রেসের এখন বোধোদয়ের সময়। আত্মশুদ্ধির সময়। আত্মসমীক্ষার সময়। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

এক প্রাচীন ফরাসি প্রবাদ হল, শত পরিবর্তনেও আসলে কোনও কিছুই পরিবর্তিত হয় না!

এ বারের লোকসভা নির্বাচনের পর কংগ্রেসের হাল-হকিকত দেখে সেই প্রবাদটাই মনে পড়ে গেল।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস অনেক ঝড়ঝাপটার সাক্ষী। কিন্তু বিজেপি নামক বিরোধী দল এ দেশের রাজনীতিতে যখন প্রথম বিপুল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখন কংগ্রেস শিবিরের চিত্রটি কী? এ কে অ্যান্টনির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন হয়। সেই কমিটিকে বলা হয়েছিল নির্বাচনী বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানের জন্য। নানা দিক থেকে অ্যান্টনি কমিটি নির্বাচনী বিপর্যয়ের বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট পেশ করে। কিন্তু মধুসূদন মিস্ত্রি, জয়রাম রমেশ থেকে শুরু করে রাহুল গাঁধীর ঘনিষ্ঠ আরও বহু নেতা সেই রিপোর্টকেই এখন চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন। দলের প্রবীণ নেতারা, যাঁদের মধ্যে জনার্দন দ্বিবেদী বা অহমেদ পটেলরাও আছেন, তাঁরা ‘টিম রাহুল’-কে মূলত নির্বাচনীয় বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করছেন। আবার রাহুল গাঁধীর ঘনিষ্ঠ নেতারা উল্টে দলের বৃদ্ধতন্ত্রকেই দোষী সাব্যস্ত করছেন। সব মিলিয়ে কংগ্রেসের গভীরতর অসুখ এখন।

(বাঁ দিক থেকে ঘড়ির কাঁটা অনুসারে) সুশীলকুমার শিন্দে, এ কে অ্যান্টনি, আহমেদ পটেল,

ইন্দিরা গাঁধী, সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী এবং জয়রাম রমেশ।

সংসদের সেন্ট্রাল হলে এক প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম, কংগ্রেস নেতৃত্ব এত দিশাহীন কেন? তা সেই মন্ত্রীটির তাৎক্ষণিক জবাব হল, আমাদের নেতা কে, সনিয়া গাঁধী না রাহুল গাঁধী? বিভিন্ন রাজ্যে নেতৃত্বের অবস্থা খুব শোচনীয়। বিভিন্ন রাজ্যে নেতৃত্বের চূড়ান্ত সঙ্কট চলছে। মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচন আসছে। তার আগে মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন খোদ রাহুল গাঁধীর টিমের নেতারা। সেই নিয়ে কয়েক দিন দিল্লিতে ধস্তাধস্তি চলল। প্রচার হয়ে গেল যে সুশীল শিন্দেকে মুখ্যমন্ত্রী করা হবে। পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ এসে সনিয়া গাঁধীর পায়ে পড়ে গেলেন। তার পর সনিয়া গাঁধী রাহুলকে ডেকে আপাতত মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বদলাতে মানা করেছেন।

মহারাষ্ট্রের নির্বাচন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। শরদ পওয়ারের এনসিপি-র সঙ্গে কংগ্রেসের গোলমাল আরও বাড়ছে। মহারাষ্ট্র সরকারের ক্ষমতাশালী মন্ত্রী নারায়ণ রাণে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছেন। মহারাষ্ট্রের কোনও কংগ্রেস নেতাই জানেন না তাঁদের রাজ্যের নির্বাচনী রণকৌশল। অসমে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের পর একই ভাবে তরুণ গগৈকে সরানোর দাবি ওঠে। তাঁকে সরিয়ে হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে মুখ্যমন্ত্রী করার কথা ঠিক হয়ে যায়। তার পর গগৈকে রেখে দেওয়া হয়। এখন অবস্থা এমন যে গগৈয়ের বিরুদ্ধে বিধায়কেরা বিদ্রোহ করে বসেছেন। একই রকম বিক্ষোভ হরিয়ানা থেকে কেরলে। এমনকী, ইউপিএ-র শরিকদের মধ্যে থেকেও ডিএমকে নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়েছে। যে ভাবে রামবিলাস পাসোয়ানও চলে গিয়েছেন। আর এখন কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স নভেম্বরে ভোটের মুখে কংগ্রেসকে পরিত্যাগ করল।

সঙ্কট কংগ্রেসের নতুন নয়। স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের আধিপত্য প্রথম খর্ব হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। তখন নেহরুর মৃত্যু হয়েছে। ১৯৬৯ সালে ন’টি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যায় এবং সেখানে অকংগ্রেসি সরকার গঠন হয়। কংগ্রেসে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুর্নীতি তীব্র হয়। অভিজাততন্ত্র ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসের সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর লড়াই শুরু হয়। সেই সঙ্কট থেকে কংগ্রেসকে বের করে ইন্দিরা গাঁধীই হয়ে ওঠেন আসল কংগ্রেস নেত্রী।

একাত্তর সালের বাংলাদেশ যুদ্ধ ইন্দিরা গাঁধীকে কার্যত মা দুর্গার আসনে বসিয়ে দেয়। কিন্তু কংগ্রেসের ভাঙন ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ’৭৭ সালে কংগ্রেস-বিরোধী ঝড় ওঠে। মোরারজি দেশাই সরকার স্থাপিত হয়। কিন্তু আবার ইন্দিরা গাঁধী বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ফিরে আসেন। ’৮৪ সালে ইন্দিরা গাঁধীর আকস্মিক মৃত্যুর পর রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু ১৯৮৯ সালে আবার কংগ্রেস বিরোধিতার ঝড় ওঠে। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ প্রধানমন্ত্রী হন।

এই কংগ্রেস বিরোধিতার ঝড় কংগ্রেস নেতৃত্ব বার বার সামলেছেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, ষাটের দশকে জন্ম নেওয়া জনসঙ্ঘ, আশির দশকে জন্ম নেওয়া বিজেপি-র ক্রমিক শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। মাঝখানে মনমোহন সিংহ জমানায় কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ও ভোট কমে গেলেও এ বার নির্বাচনে আবার বিজেপি সেই শূন্যস্থান অনেকটাই পূরণ করেছে। ফলে কংগ্রেস নেতৃত্বের ভাবার সময় এসেছে যে দলের এই অবক্ষয় অদূর ভবিষ্যতে তাঁরা কতটা রোধ করতে পারবেন এবং রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে সেটা কতখানি সম্ভব।

রাজনীতিতে পূর্ণচ্ছেদ নেই। সুতরাং আগামী দিনে কংগ্রেস আবার পুনরুজ্জীবিত হবে না, এমন কথা বলা অবৈজ্ঞানিক। নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে জনপ্রিয়তা নিয়ে এসেছে, সেই জনপ্রিয়তা চিরকাল অটুট থাকাটা প্রকৃতির নিয়ম নয়। কিন্তু কংগ্রেসের এখন বোধোদয়ের সময়। আত্মশুদ্ধির সময়। আত্মসমীক্ষার সময়। রাজ্যে রাজ্যে সংগঠনকে মজবুত করার সময়। সংসদে এবং সংসদের বাইরে দলকে সঠিক দিশা দেখানোর সময়। কিন্তু কংগ্রেস হাইকমান্ডের দিক থেকে তেমন কোনও উদ্যোগ টের পাওয়া যাচ্ছে না।

অনিবার্য কারণে এই সপ্তাহে শাহি সমাচার প্রকাশিত হল না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE