Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সমস্যা সমাধানের স্থায়ী পথ যুদ্ধ হতে পারে না

দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করাই উচিত কাজ। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করাই উচিত কাজ। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

‘আর্ট অব ওয়ার’-এ সুন জু (Sun Tzu) বলেছিলেন, যুদ্ধ হল রাষ্ট্রনীতি রূপায়ণের এক ভিন্ন পথ। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রেও এ কথাই বলেছিলেন। তবে তিনি রাজাকে পরামর্শ দেন, যুদ্ধ তখনই করবে যখন তুমি নিশ্চিত, তোমার প্রতিপক্ষ তোমার চেয়ে দুর্বল।

সেনাবাহিনীর কাজ যুদ্ধ করা। কিন্তু যুদ্ধর মাধ্যমে কি শত্রুতার চিরস্থায়ী বিনাশ হয়? তা হলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় কেন? কার্গিল যুদ্ধের পর সেনাবাহিনী সন্তোষ প্রকাশ করল বটে, কিন্তু তাতে কি পাক আগ্রাসন থামল? কাশ্মীর নিয়ে মনমোহন সিংহের জমানাতেও পাকিস্তানের আগ্রাসন বন্ধ হয়নি। তখনও মননোহন পাকিস্তানে গিয়ে আবার আলোচনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কংগ্রেস নির্বাচনের আগে মনমোহনকে পাকিস্তানে যাওয়ার ছাড়পত্র দিতে রাজি হয়নি। কারণ? তখন বিজেপি পাকিস্তান বিরোধী প্রচারে সোচ্চার।

কার্গিল এলাকায় ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে পাক সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণরেখার ও পারে বিতাড়ন করার পর ‘অপারেশন বিজয়’-এর প্রাথমিক লক্ষ্যপূরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সংঘর্ষ তার পরেও বন্ধ হয়নি। পাকিস্তানের কাশ্মীর দখলের যুদ্ধ অব্যাহত আছে। কার্গিল যুদ্ধ চলার সময় বার বার নিরাপত্তা বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির বৈঠক হত। তখনও মন্ত্রিসভায় এই বিতর্ক চলছিল যে কার্গিলে ভারতীয় সেনাবাহিনী যে ভাবে একের পর এক নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি পাহাড়চূড়াগুলো দখল করে নিচ্ছে ঠিক সে ভাবেই তা চালিয়ে যাবে না কি এ বার কূটনীতির দৌত্য শুরু করা উচিত? কার্গিল প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমী দেশগুলির সমর্থন লাভ করে ভারত সরকার তখন কিছুটা উল্লাস বোধ করেছিল। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী তাঁর কার্গিল ’৯৯ গ্রন্থে লিখেছেন, আমাদের বোঝা উচিত ছিল যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কোনও কিছুই ‘মাগনা’ পাওয়া যায় না। এখন সমর্থনের বিনিময়ে ওই দেশগুলি দাবি করল যে কাশ্মীর ইস্যু-সহ অন্যান্য বিষয়ে ভারত দ্রুত পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করুক। এ ছাড়া সিটিবিটি-তে কোনও সংশোধন ছাড়াই ভারত স্বাক্ষর করুক।

কার্গিল অপারেশনের কয়েক সপ্তাহ পরেই সিঙ্গাপুরে আসিয়ান দেশগুলির নিরাপত্তা বৈঠকের সময় মার্কিন বিদেশসচিব ম্যাডলিন অলব্রাইট আমাদের বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহের কাছেও এই আর্জি জানান।

পাকিস্তানের এই সন্ত্রাস মোকাবিলায় কার্গিল যুদ্ধের পর আমরা কী শিক্ষা নিয়েছি? ছবি: ইউটিউবের সৌজন্যে।

১৯৯৯ থেকে ২০১৭। কাশ্মীর সীমান্তে পাক অনুপ্রবেশ, আগ্রাসন, গোলাবর্ষণ থামেনি। পাশাপাশি, উপত্যকাতেও আবার জঙ্গি কার্যকলাপ অনেক বেড়েছে। তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে তিন তিনটি যুদ্ধে সাফল্য না পেয়ে জিয়া উল হক এ দেশের জমিতে নানা রাজ্যে ছায়াযুদ্ধ বা প্রক্সি ওয়ারের সিদ্ধান্ত নেন। এই ছায়াযুদ্ধের লক্ষ্য হল ভারতের স্থিরতাকে নষ্ট করা। ভারতকে হাজারটা টুকরোয় ভেঙে দেওয়া। একে বলা হয়, ‘থিওরি অব থাউজেন্ড কাটস্’। ‘অপারেশন টোপাক’-কে জিয়া খুবই জনপ্রিয় করে তোলেন। অপারেশন টোপাক-এর প্রথম ভাগে লক্ষ্য ছিল কাশ্মীর, দ্বিতীয় ভাগে যোগ হল উত্তর-পূর্বাঞ্চল। পাকিস্তানের এই সন্ত্রাস মোকাবিলায় কার্গিল যুদ্ধের পর আমরা কী শিক্ষা নিয়েছি? পঠানকোট কাণ্ডের পর কী শিক্ষা নিয়েছি? অমৃতসরে বিমান-ছিনতাই পণবন্দিদের নিয়ে কন্দহর চলে যাওয়া— তা থেকে আমরা কী কী শিক্ষা নিয়েছি?

একটা বয়স ছিল তখন লালকৃষ্ণ আডবাণী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আমারও মনে হত, পাকিস্তানের সন্ত্রাসের মোকাবিলা কঠোর দমননীতির মাধ্যমেই করতে হবে। কিন্তু এখন মনে হয় ‘Theory of face’-ই সন্ত্রাস দমনের প্রকৃত পথ নয়। প্রথমত, শুধু সীমান্ত তো নয়, গোটা দেশের ভারতীয় সার্বভৌম ভূখণ্ডে যে ভাবে এজেন্ট প্রোভোকেটর ব্যবহার করে এ দেশে সন্ত্রাস চালান হচ্ছে সেটাও খুবই আধুনিক ধারণা। কার্গিল যুদ্ধের পর সুব্রহ্মণ্যম কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির অধীনে চারটি টাস্কফোর্স গঠন হয়। সেই চারটি টাস্কফোর্স গোয়েন্দা ব্যর্থতা থেকে সীমান্ত পরিচালন ব্যবস্থা— প্রতিটি বিষয় নিয়েই সবিস্তার অনুসন্ধান করে এক রিপোর্ট দেয়। আমার সরকার বাহাদুরের কাছে বিনীত প্রশ্ন হল, যে যে সুপারিশ ওই তদন্ত কমিটি করেছিল সেগুলির কত শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে? আমরা আমাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য কতখানি সুদৃঢ় নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি?

সবচেয়ে বড় কথা হল, সন্ত্রাস তো বন্দুক দিয়ে দমন করা যায় না। এ তো রক্তবীজের জন্মের মতো। যুদ্ধ ও শান্তির মধ্যে সমস্যা সমাধানের স্থায়ী পথ যুদ্ধ হতে পারে না। যুদ্ধ কেন হয়? যুদ্ধ এ জন্য করা হয় যাতে আর যুদ্ধ করতে না হয়। যাতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু বাস্তব হল, সমস্যা সমাধানের পথ একটাই, সেটা আলাপ-আলোচনা ‘ডায়ালগ’-এর সক্রেটিসের পদ্ধতি। পাকিস্তানের পরিস্থিতিও বুঝতে হবে আমাদের। পাকিস্তান নওয়াজ শরিফের রাজনৈতিক অবস্থা ভাল নয়। পানামা কেলেঙ্কারির জন্য আগামী নির্বাচনের আগে নওয়াজ চাপের মুখে। তাই সেনাবাহিনী-আইএসআই ও মোল্লাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণও শরিফের উপর এখন আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করাই উচিত কাজ। বিশেষত, এখন চিনের সঙ্গেও ভারতের যে ভাবে সঙ্ঘাত বেড়েছে তাতে চিন-পাক অক্ষ নিয়ে ভারতের উদ্বেগ আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসা, আবার সেনা ও আধা সামরিক বাহিনীকে সন্ত্রাস মোকাবিলার জন্য তৈরি রাখা, এটাই তো রাজধর্ম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE