Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

সাফল্যের কৃতিত্ব নিলে সমালোচনাও সইতে হবে মোদীকে

ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য আমার রাজনৈতিক মূল্যায়নকে বন্ধক রাখি কী করে! উপলব্ধি জয়ন্ত ঘোষালেরব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য আমার রাজনৈতিক মূল্যায়নকে বন্ধক রাখি কী করে! উপলব্ধি জয়ন্ত ঘোষালের

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

সে দিন বিজেপির এক শীর্ষনেতা আমাকে বলেছিলেন, আপনি আপনার লেখায় এত বেশি মোদী-বিরোধিতা করছেন কেন? বিজেপি নেতাদের অনেকের মনে হচ্ছে, আমার লেখায় যুক্তির চেয়ে অন্ধ বিরোধিতার আবেগ কাজ করছে। আজকাল বিজেপির সংবাদমাধ্যম ম্যানেজমেন্ট খুবই কুশলী। সকাল ১১টায় এক দিন শীর্ষ বিজেপি নেতার সঙ্গে দেখা করতে গেছি, তখনও বসিনি, তার আগেই তিনি বললেন, আজ, বুধবারের কলমে আপনার লেখাটি পড়ে বেশ আনন্দ পেলাম। আপনি আমাদের বিরোধিতা করেছেন বটে, কিন্তু আমরা রচনাটি উপভোগ করেছি। এটা বিজেপির ক্ষিপ্র প্রোঅ্যাকটিভ প্রশংসনীয় কর্মপদ্ধতি। কলকাতার সংবাদপত্রগুলিতে কী ছাপা হচ্ছে তার অনুবাদ প্রতি দিন নিয়ম করে দিল্লির পার্টি হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুধু কলকাতাই নয়, দেশের বিভিন্ন শহর থেকে বিভিন্ন ভাষার সংবাদমাধ্যমে কী ছাপা হচ্ছে, কী দেখানো হচ্ছে, আঞ্চলিক চ্যানেলে তা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে মোদী-অমিত শাহ্‌কে। আরএসএসের এক নেতাও সে দিন বললেন, আপনার প্রবন্ধগুলি পড়ছি। আপনার মতামতে বেশ নতুনত্ব আছে উপভোগ করছি। কিন্তু বাজপেয়ী-আডবাণীর সময় আপনি বিজেপি সম্পর্কে এত সমালোচনামূলক ছিলেন না, আজ এত মোদী-বিরোধী হয়ে উঠেছেন কেন?

জবাবে ওই বিজেপি নেতাকে বললাম, আপনাদের সমস্যা হচ্ছে সরকারের কোনও নীতি বা বিজেপির কোনও কাজের সমালোচনা করলেই আপনারা ভাবছেন ব্যক্তিগত ভাবে আমি মোদী-বিরোধী হয়ে উঠেছি। আপনারাই বিদেশনীতিকে বলছেন মোদী-ডকট্রিন, আপনারাই সমস্ত প্রচার, সমস্ত স্লোগান, সমস্ত সাফল্যকে মোদী নামক এক ব্যক্তিতে কেন্দ্রীভূত করেছেন তা হলে সেই বিদেশনীতি বা সেই রাজনীতির সমালোচনা করতে গেলেও জবাবদিহি তো মোদীকেই করতে হবে। সাফল্যের কৃতিত্ব যদি তাঁর হয় তবে ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনায় তাঁর দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলার অধিকার সাংবাদিকের থাকা উচিত।

দেখুন, ব্যক্তিগত ভাবে মোদী এবং অমিত শাহ্‌, দু’জনকেই আমি শ্রদ্ধা করি এ জন্য যে তাঁরা ভারতের মতো এমন এক বিশাল দেশের বিপুল জনসংখ্যার মানুষের কাছে এক আধুনিক অবতারে পরিণত হয়েছেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কী ভাবে দশ বছরের মনমোহন সিং সরকারের নীতিপঙ্গুতা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে মোদী লড়াই করেছেন, ধাপে ধাপে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে প্রধানমন্ত্রিত্বে উন্নীত করেছেন নিজেকে— এ সবই খুব কাছ থেকে সাংবাদিক হিসাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগের কথা ছেড়েই দিলাম, হওয়ার পরেও তিনি যে ভাবে আমাকে স্নেহ করেছেন, সময় দিয়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এক বার বলেছিলেন, আজকাল কম আসছো কেন? ফোন কর না কেন? আমি বলেছিলাম, ‘‘আপনি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। কত ব্যস্ত মানুষ। কত কাজ। তাই ফোন করতেও দ্বিধা হয়।’’ জবাবে মোদীজি বলেছিলেন, ‘‘হামসে বাত করনা ইয়ে তুমহারা অধিকার হ্যায়।’’ সাংবাদিকের অর্জিত অধিকার। ব্যক্তিগত সম্পর্কের অধিকার। যখন গোধরা নিয়ে সবার কাছে মোদী অচ্ছুৎ ছিলেন, সে দিনও আমি অন্য বহু সাংবাদিকের মতো ওঁর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করিনি কখনও। ব্যক্তিগত সম্পর্ককে তো অটুট রেখেছি! যখনই দেখা করতে চেয়েছি অমিত শাহ্‌ও দেখা করেছেন। এখনও করেন।

কিন্তু আমার কর্মজীবনের অপরাহ্নে এসে যখন নিজের অভিমত প্রকাশের মঞ্চ পেয়েছি আনন্দবাজারে, তখন আজ এই ২০১৭ সালে আমি কী ভাবছি, সেই ভাবনাকে সৎ ভাবে, নির্ভীক ভাবে পাঠকের কাছে প্রকাশ করাই আমার কর্তব্য বলে মনে করছি। ব্যক্তিগত মধুর সম্পর্কের জন্য আমার রাজনৈতিক মূল্যায়নকে বন্ধক রাখি কী করে বলুন তো!

বাজপেয়ী-আডবাণীর সময় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে রাজনৈতিক শাসককুলের যে সম্পর্ক আর আজ মোদী-যুগে যে সম্পর্ক, সাধারণ ভাবে তা কি এক? আবার সে দিন আমার যে রাজনৈতিক চিন্তা ছিল, তার যদি রূপান্তর হয় তবে তা-ও কি অস্বাভাবিক ঘটনা? পৃথিবীর নানাস্তরে বিখ্যাত চিন্তাবিদদের ভাবনার রূপান্তর তো আজ ছাত্রদের গবেষণার বিষয়, হ্যারল্ড ল্যাস্কি থেকে বার্ট্রান্ড রাসেল— সময়ের হাত ধরে তাঁদের মতামত বদলেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন থেকে দেং জিয়াও পিং থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আমরা তো সাধারণ সংবাদ-কর্মী, হরিদাস পাল, কিন্তু আমাদের ভাবনাচিন্তাতেও রূপান্তর আসে। বাজপেয়ী-আডবাণীর যুগে মনে হয়েছিল হয়তো সামরিক দাওয়াই দিয়ে কাশ্মীর সমস্যার আশু সমাধান সম্ভব, আজ মনে হয় আলোচনার প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে কোনও ভাবেই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে না। এটা আবেগতাড়িত নয়, যুক্তিনির্ভর বিতর্কে অংশ নিতেও আমি প্রস্তুত। মুচিরাম গুড় নামক এক চরিত্র নির্মাণ করে গেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। অসাধারণ চরিত্র। আর কাঁঠালের রস নেওয়ার প্রতিযোগিতার কথাও পড়েছি বঙ্কিমের লেখনীতে।

রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আবেদনকারী-উমেদারদের সংখ্যা সবসময়েই অনেক। এ দৃশ্য জ্যোতি বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানাতেও দেখছি। আবার রাজীব গাঁধী থেকে মোদী জমানাতেও দেখছি। কেউ রাজ্যসভার সদস্য হতে চান, কেউ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, কেউ ব্যবসায় শ্রীবৃদ্ধির জন্য হিন্দু-জাতীয়তাবাদের জয়গানে মুখর, কেউ বিজ্ঞাপন চান, তো কেউ চান নাম উপাধি।

‘প্রকসিমিটি গিভস ইউ অ্যাকসেস অ্যান্ড ইনফর্মেশন’— এ তো সাংবাদিকতার সাবেক উপদেশ, কিন্তু আজ এত বছর পর এক প্রবীণ মার্কিন সাংবাদিকের ভাষা ধার করে বলতে পারি, ‘ক্রনি জার্নালিজম ইস আ কার্স।’ সাংবাদিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতার সম্পর্ক যেন খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক। এখানে আসলে কোনও আত্মীয়সভা গঠন করা যায় না। এক জন নবীন সাংবাদিকের তবু ঘনিষ্ঠতার প্রয়োজন থাকে, কিন্তু একটা বয়সের পর পাঠক যখন আপনার অভিমত প্রত্যাশা করে, অন্যদের মতামত কাট অ্যান্ড পেস্ট করে জানানো নয়, তখন আপনি রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা নিয়ে করবেন কী? ট্রাম্প জমানায় মার্কিন সাংবাদিকরাও এ সমস্যার শিকার, ভারতের সাংবাদিকরাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi PM India BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE