Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

পাহাড়ে সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে আলোচনায় আসতে হবে গুরুঙ্গকে

দারিদ্র আর অত্যাচারের ফাঁকেই মাথাচাড়া দিচ্ছে দার্জিলিং পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবোধ। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালদারিদ্র আর অত্যাচারের ফাঁকেই মাথাচাড়া দিচ্ছে দার্জিলিং পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবোধ। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল পাহাড়। ফাইল চিত্র।

অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল পাহাড়। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৭ ০০:৫৭
Share: Save:

বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আমাদের গণতন্ত্রের দুর্বলতা। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, ‘অ্যালিয়েনেশন’ আর ‘সিসেশন’ এক জিনিস নয়। বিচ্ছিন্ন আর আলাদা হওয়ার দাবি এক নয়। বিচ্ছিন্নতা একটা বোধ। দু’টি ভিন্ন ভাষা সম্প্রদায়, দু’টি সংস্কৃতি যদি পাশাপাশি থাকে তবে সেই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মাঝে মাঝে একটু খটাখটি হওয়া ঐতিহাসিক কারণেই আমাদের দেশে অসম্ভব নয়। সব সম্প্রদায়েই কিছু লোক থাকেন যাঁরা নিজেদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। মাঝে মাঝে অন্যের দরজা ভেঙে দিয়ে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে ওঠেন। ধরুন না, কলকাতাতেও যারা একদা ‘আমরা বাঙালি’ করার চেষ্টা করেন, আলকাতরা দিয়ে ইংরেজি মোছার চেষ্টা করেন তাঁরা কিন্তু অসফল হন।

দার্জিলিঙে বাঙালি-নেপালি খটাখটি চললেও দীর্ঘ দিন সে এলাকায় পারস্পরিক প্রীতির একটা সম্পর্ক ছিল। নেপালি-বাঙালি এক যৌথ নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু নানা কারণে এই সম্পর্কের অবনতি হয়। আশির দশকে সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন জঙ্গি হয়ে ওঠে। দেখুন, দার্জিলিং এলাকাটি তো একদা কোনও জনগোষ্ঠীরই ছিল না। এটি সিকিমের রাজার অধীনে ছিল। ১৭০৬ সালে সিকিমের রাজার সঙ্গে ভুটানের রাজার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ভুটানের রাজা সিকিমের একটা অংশ দখল করেন। ১৮১৪ সালে নেপাল-ব্রিটিশ যুদ্ধে এই ভূখণ্ডটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৮১৫ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে গোর্খা নিয়োগ শুরু হয়। ১৮১৬ সালে সিকিমের দখলীকৃত অঞ্চল পুনরায় ভুটানরাজ ফেরত দেন। ১৮৩৫ সালে সিকিমের রাজা ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে দার্জিলিং উপঢৌকন হিসেবে দেন।

ভারত-নেপাল চুক্তির পর অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি গোর্খাদের জন্য আলাদা ‘স্থান’-এর দাবিতে যে সোচ্চার ছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৫৩ সালের ৪ মে ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে কমিউনিস্টরা গোর্খা লিগের সঙ্গে আলাদা গোর্খাস্থানের দাবি করেছে। পরে অবশ্য গোর্খা লিগের তৎকালীন সম্পাদক দেবপ্রকাশ রাই ওই খবরের প্রতিবাদে ‘চিঠিপত্র’ কলমে চিঠি লিখে জানান যে, গোর্খাস্থানের দাবির ব্যাপারে তাঁরা কমিউনিস্টদের সঙ্গে নেই। অর্থাৎ, দাবিটা ছিল শুধু কমিউনিস্ট পার্টিরই।

ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হওয়ার পর সিপিএমের প্রভাব পড়ে বেশি পাহাড়ে। চা বাগানগুলিতে গোর্খা শ্রমিকদের উপর সিপিএমের প্রভাব ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে রতনলাল ব্রাহ্মণ ও আনন্দ পাঠকের নেতৃত্বে সিপিএম পৃথক রাজ্যের বদলে স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলনের কথা বলতে থাকেন। আর ক্ষমতা হল শাসকেরও সবচেয়ে বড় শত্রু। ক্ষমতা মানেই তো এক নৈর্ব্যক্তিক ‘হেজেমনি’। দলীয় তফাৎ তখন ফিকে হয়ে যায়। সিপিএমের দীর্ঘ শাসনে পাহাড়ের প্রতি বঞ্চনা, চা-শ্রমিকদের হাল— এ সবে যদি একটা মৌলিক পরিবর্তন হত তবে হয়তো এই বিচ্ছিন্নতাটাও এ ভাবে প্রকট হত না। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নেপালি টুপি আর পোশাক পরে বার বার পাহাড়ে এসেছেন, কিন্তু তাতে সমস্যার কোনও মৌলিক সমাধান হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে বাঙালি-নেপালি বিবাদ বেড়েছে। দার্জিলিংকে সিদ্ধার্থবাবু নিজের জন্য একটা নিরাপদ সিট হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে পরিস্থিতি আরও জটিল করে দেন।

আসলে গলদ বিসমিল্লাতেই। পাহাড়ে গরিব, অত্যাচারিত মানুষ গোর্খা জনগোষ্ঠীর দারিদ্র, বিচ্ছিন্নতাবোধ বাড়াচ্ছে। দার্জিলিঙে গিয়ে দেখেছি, সেখানেও কিছু লোকের হাতে প্রচুর অর্থ। কিছু ধনী ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ঠিকাদাররা বিদেশে পড়াশোনা করা অভিজাত শ্রেণি। আর অন্য দিকে চা-বাগানে আজও কাজ করে চলেছে ‘কুলি গোর্খা’ সামান্য মজুরি নিয়ে। এই অসাম্য বাড়ছে। অসাম্যের মধ্যে জন্ম নেয় এক জন ডাকাবুকো নেতা। সিকিমেও প্রচুর নেপালি আছে। তারাও অনেকে দার্জিলিঙে চলে এসেছে পেশাগত কারণে। লেপচা বা ভুটিয়ার চেয়ে গোর্খারা জনসংখ্যাতেও বেশি। রাজনৈতিক আধিপত্যতেও এগিয়ে।

জ্যোতি বসু আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিতে তফাৎ একটাই। জ্যোতিবাবু ঘিসিংকে ইজারা দিয়ে দেন এবং সখ্য গড়ে তুলে রাজনীতি করেন। ঘিসিং কেন্দ্র-রাজ্য দু’পক্ষের কাছ থেকেই টাকা পেয়েছেন, দার্জিলিঙের উন্নয়ন কী হয়েছে জ্যোতিবাবু কোনও দিনই তা জানতে চাননি। উল্টে দার্জিলিঙের প্রবীণ সিপিএম নেতারা রাজ্য নেতৃত্বের এ হেন আত্মসমর্পণের নীতি তখন পছন্দও করতেন না।

কিন্তু মমতার রাজনীতি ভিন্ন। তিনি পাহাড়েও তৃণমূলের সম্প্রসারণে অতি সক্রিয়। তিনি যে ভাবে যত বার পাহাড়ে গিয়েছেন, জনসংযোগের চেষ্টায় যে ভাবে ব্রতী হয়েছেন তা অভূতপূর্ব। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ও এ ভাবে এত গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করেননি। লেপচা, ভুটানি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য তিনি আলাদা আলাদা বোর্ড গঠন করলেন, যে কবি ভানুভক্তের জাতীয় মর্যাদা ঘিসিং খারিজ করে দেন, সেই ভানুভক্তকে মমতা আবার পাহাড়ের মানুষের মধ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন, তাঁর জন্মজয়ন্তী পালনের মাধ্যমে। এর পর পুরনির্বাচনে মিরিক বোর্ড দখল, দার্জিলিঙে জেলা বিভাজন, সর্বত্র তৃণমূলের প্রার্থী দেওয়া— এ সব ঘটনায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল বিমল গুরুঙ্গের। নিরাপত্তার অভাব বোধ থেকেও অনেক সময় বিচ্ছিন্নতা বাড়ে। আর সর্বশেষ আঘাত মমতা হানলেন জিটিএ-র টাকা খরচের অডিট করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। আর এই সময়েই গুরুঙ্গ দ্বারস্থ হলেন কেন্দ্রের। বিজেপির প্রচার অভিযান শুরু হল মমতার বিরুদ্ধে।

গোর্খাল্যান্ড নামক পৃথক রাজ্য কিন্তু চাইলেও হবে না। এ ব্যাপারে বিধানসভা তথা রাজ্য সরকারের অনুমতি নিতে হবে। তাই পৃথক রাজ্যের দাবিতে গুরুঙ্গের আন্দোলনকে উস্কে দেওয়া, তা প্রকাশ্যেই হোক আর তলে তলে, সেটা হবে আগুন নিয়ে খেলা। তার চেয়ে সন্ত্রাসের পথ পরিত্যাগ করে গুরুঙ্গ যদি আলাপ-আলোচনার পথে আসেন তবে তাতে বরং উন্নয়নের মাধ্যমে গোর্খা বিচ্ছিন্নতার সমস্যা মেটানো যেতে পারে। দার্জিলিং চা-বাগানেই শুধু ৪০০ কোটি টাকা লোকসান হবে এ আন্দোলনে। কারণ ঠিক এখনই ফার্স্ট ও সেকেন্ড ফ্লাশ দার্জিলিং চা হওয়ার সময়। এ ছাড়া পর্যটন শিল্প, পরিবহণ ব্যবসা, সার্বিক দোকান-বাজার সব আন্দোলনের ফলে মার খাচ্ছে। অসুবিধায় পড়েছে ছাত্রছাত্রীরা। তাই সময় এসেছে। আমরা সবাই ক্ষুদ্র নির্বাচনী এবং রাজনৈতিক স্বার্থ ভুলে বরং দার্জিলিঙের গোর্খা মানুষের স্বতন্ত্রের পরিসরটুকু তাঁদের দেওয়ার চেষ্টা করি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE