Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
National

মোদী সরকারের শিক্ষানীতিই ঘোষণা হল না

ধনী-দরিদ্র ক্রমবর্ধমান অসাম্য আর তারই মধ্যে শিক্ষানীতির স্বপ্ন। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালধনী-দরিদ্র ক্রমবর্ধমান অসাম্য আর তারই মধ্যে শিক্ষানীতির স্বপ্ন। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেক স্কুলে এ ভাবেই বসতে হয় পড়ুয়াদের।

গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেক স্কুলে এ ভাবেই বসতে হয় পড়ুয়াদের।

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০৪
Share: Save:

একটা দেশকে সত্য সত্যই শাহি দিল্লির ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত করে আধুনিক ভারতের নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, তবে বোধহয় সবচেয়ে জরুরি হল শিক্ষার প্রসার। শিক্ষা মানে শুধু অভিজাত কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সুযোগপ্রাপ্ত শ্রেণিভুক্ত জনসংখ্যার কিঞ্চিৎ সম্প্রসারণ নয়। শিক্ষার প্রসারের প্রকৃতি বাস্তবায়ন হতে পারে যদি তা শীর্ষ থেকে তলায় না গিয়ে নিচুতলা থেকে উপরের তলায় উঠে আসতে পারে। আমাদের দুর্ভাগ্য, নরেন্দ্র মোদী সরকারের চার বছর অতিবাহিত হতে চলেছে, কিন্তু আজও এই সরকার কোনও শিক্ষানীতিই ঘোষণা করতে পারল না।

মোদী যখন ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন, তখন কেউ কেউ প্রস্তাব দেন যে এক জন পৃথক মন্ত্রী হোক যিনি হবেন শিক্ষামন্ত্রী, যিনি শিক্ষানীতি রূপায়ণ করবেন। অন্য আর এক জন মন্ত্রী হবেন মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী যিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রশাসনের দিকটি দেখবেন। মোদী সে প্রস্তাবে সম্মত হননি।

মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী হন স্মৃতি ইরানি, বদলে এখন প্রকাশ জাভরেকর। কিন্তু, সরকার ঘোষণা করেও আজও কোনও শিক্ষানীতি ঘোষণা করতে পারেনি। কেন এখানে তাঁরা ব্যর্থ হলেন? এখানে জাভরেকর শিক্ষামন্ত্রী হয়ে বলেছিলেন, শুধু সঙ্ঘ পরিবার নয়, রোমিলা থাপারের মতো মার্কসবাদী ঐতিহাসিকের কাছ থেকেও তিনি শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য তথ্য মতামত নিতে প্রস্তুত। কিন্তু, শিক্ষানীতি নির্ধারণ নিয়ে খসড়া গঠিত হয়ে গিয়েছে সেই কবে, সে তো স্মৃতি ইরানির সময়েই কমিটি গঠিত হয়, কিন্তু তারপর সেই খসড়া নিয়ে দেশের বিদ্বৎ সমাজের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হল কই?

ব্রিটিশ শাসকদের নিজেদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ থাকলেও আজও আমাদের ম্যাকলের কাছেও ইতিহাসের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়। অবশ্য পরে, হিন্দুত্ববাদীরা এই পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতিবাদে আরও বেশি বেশি করে ভারতীয় সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। তার জন্য, সংস্কৃত ও প্রাচ্যশিক্ষা সে সময় গুরুত্ব পায়। লর্ড আমহার্স্টের কাছে রাজা রামমোহন রায় ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সমাজেই ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন ছিল খুবই সীমিত।

নেহরুর মৃত্যুর ৫০ দিন পর কোঠারি কমিশন গঠন হয়। ১৯৬৪-র ১৪ জুলাই। যদিও এই কমিশন গঠনের কাজ নেহরু অনেক দিন আগেই চালু করে দিয়েছিলেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৫— এই দীর্ঘ সময়কে বলা হয়, ‘কোঠারি সাগা’। দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষানীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলতেই থাকে।

শিক্ষাক্ষেত্রেও ধনী-দরিদ্র অসাম্যের ছবি। ফাইল চিত্র।

এর পর ’৮৪ সালে ইন্দিরা গাঁধীর আকস্মিক মৃত্যুর পর রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে এমএইচআরডি (মিনিস্ট্রি অব হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট) গঠন করেন। ’৮৬ সালে জাতীয় সাক্ষরতা মিশনও ঘোষণা করেন তিনি।

জাতীয় শিক্ষানীতিও ঘোষণা হয়। ’৯১ সালের জুলাই মাসে নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর রামমূর্তি কমিটি তাদের রিপোর্টে শিক্ষানীতির মূল্যায়ন করে তারও পুনর্মূল্যায়ন করেন। এক দিকে গ্রামাঞ্চলে সর্বোদয় বিদ্যালয় চালু করা, অন্য দিকে বিদেশ থেকে এবং দেশের ভিতর থেকে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া শিক্ষাক্ষেত্রেও চালু করা।

সেই সময় থেকে এর পর এল মুরলীমনোহর যোশীর সময়। শিক্ষায় গৈরিকীকরণের অভিযোগ। তার পর অর্জুন সিংহ শিক্ষামন্ত্রী হয়ে অযোধ্যায় ভেঙে যাওয়া বাবরি মসজিদে সরকারি প্রচারে সামিল করলেন বামপন্থীদের। সে আর এক চরম অভিমান। ২০১৪ সালে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারে বলা হয়েছিল শিক্ষার জন্য জাতীয় কমিশন গঠন হবে। তা আজও হল না। প্রধানমন্ত্রীর ‘মাই গভ’ অ্যাপের সাহায্যে গোটা দেশের সমস্ত নাগরিকের মতামত নাকি তাতে নেওয়া হচ্ছে। ’৬৮ সালে কোঠারি কমিশনের রিপোর্ট, ’৮৬ সালের রামমূর্তি কমিটি রিপোর্ট, ’৯২ সালের সংশোধন, তার পর ২০১৬ সালে প্রাক্তন ক্যাবিনেট সচিব টি এস আর সুব্রহ্মণ্যমের রিপোর্ট প্রদান। কেলেঙ্কারি হল, সুব্রহ্মণ্যম তাঁর রিপোর্টেই বলে বসলেন মন্ত্রকের দেওয়া তথ্যে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। কেলেঙ্কারির একশেষ।

সম্প্রতি ২০১৬-’১৭ সালের উচ্চশিক্ষায় সর্বভারতীয় সমীক্ষা রিপোর্ট এসেছে আমাদের কাছে। সেই রিপোর্টে আবার লেখা হয়েছে যে উচ্চশিক্ষার স্টিয়ারিং কমিটি এক নয়া শিক্ষানীতি প্রবর্তনের কাজ চালাচ্ছে।

হে ঈশ্বর! বেসরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাঙের ছাতার মতো বাড়ছে। অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার নামে ব্যবসা হচ্ছে, এ দিকে প্রাথমিক স্কুলগুলিতে শিক্ষকই নেই। শিক্ষায় গ্রামাঞ্চলে ড্রপ-আউটের শতকরা হার এখনও যথেষ্ট। এই অসম অগ্রাধিকার। ধনী-দরিদ্র ক্রমবর্ধমান অসাম্য আর তারই মধ্যে শিক্ষানীতির স্বপ্ন। কিন্তু কী সেই শিক্ষানীতি যা নেহরুর দর্শন থেকে আলাদা? সে কি সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্বের মতাদর্শের নব আগমন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE