সাধু সাবধান!
বিমান অবতরণের সময় ক্যাপ্টেন ঘোষণা করেন, এ বার বিমান অবতরণ করতে শুরু করেছে। আর আধ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের বিমান মাটি স্পর্শ করবে। রাজনীতিতে কিন্তু এমন হয় না। রাজনীতিতে যেমন কোনও ব্যক্তি বা দলের উত্থান হয়, আবার পতনও তেমনই অবশ্যম্ভাবী হয়। একে বলা হয় প্রকৃতির সূত্র। সমস্যা হচ্ছে রাজনীতিতে যখন উত্থান হয়, তখন যে কোনও রাজনীতিক খুশি হন। তিনি বা তাঁরা উত্থানের আনন্দ নেন। আমোদ পান উত্থানের।
করতালি। করতালি। করতালি। মুখরিত হয় প্রেক্ষাগৃহ!
কিন্তু পতনের সময় সে কথা কেউ যদি বলেন তবে রাজনৈতিক নেতা তা মেনে নিতে পারেন না। জুলিয়ার সিজারের মতো নেতা মেনে নিতে পারেননি। হিটলারের মতো ব্যক্তিত্ব পরাজয় মেনে নিতে পারেননি বলেই শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথে গিয়েছিলেন। রাজা সর্বদাই পছন্দ করেন খোশামোদ। রাজা ক্যানিউটের ভক্তবৃন্দর মতো বলতে হয়, রাজা যখন বলছেন তখন সমুদ্রের ঢেউও নিশ্চয়ই উল্টো দিকে যেতে থাকবে। রাজার নির্দেশ যে কেউ অমান্য করবে সে কথা না বলাই শ্রেয়।
নরেন্দ্র মোদীর সরকারের এক বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। বর্ষপূর্তিতে মোদী বিজ্ঞান ভবনে কোনও সাংবাদিক বৈঠক করবেন এমনটা মনে হচ্ছে না। বরং মোদী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন, বর্ষপূর্তিতে দিল্লিতে ঢক্কানিনাদ না করে রাজ্যে রাজ্যে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি রূপায়ণের সাফল্য নিয়ে কাঁসরঘণ্টা সহযোগে বাদ্য হোক।
একটা ধারণা প্রতীয়মান, সেটি হল এক বছরের মধ্যেই রাজ্যে রাজ্যে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি হতে শুরু করেছে। এই অসন্তোষ শহুরে অভিজাততন্ত্র শিল্পোদ্যোগী সমাজের মধ্যে এবং তার পর এই অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায় আমজনতার মধ্যে। মোদী সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বললেন, আসলে এটা হল ‘পলিটিকস অফ পারসেপশন’। আর এই রাজনীতিতে বিরোধীদের উস্কে দিচ্ছে সংবাদমাধ্যম।
প্রত্যাশা পূরণ হল কী? —ফাইল চিত্র।
ধারণা তৈরি হয়েছে, নরেন্দ্র মোদী সংবাদ মাধ্যমকে পাত্তা দেন না, তাদের যথেষ্ট খাতির করেন না। আর সেই কারণে মোদীর এই মনোভাবকে সংবাদ মাধ্যম মেনে নিতে পারছে না। একে ক্ষমতার দম্ভ বলে মনে করছে। আর তাই সংবাদ মাধ্যমও মোদী বিরোধী পাল্টা প্রচার চালাচ্ছে। অতএব, বাস্তবে অনেক ভাল কাজ হলেও অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমই তা তুলে না ধরে নেতিবাচক রিপোর্টিং করছে।
এই ‘কেষ্টা বেটাই চোর’ মনোভাবকে আমি মানতে রাজি নই। আমার মনে হয়, সাধারণ ভাবে সংবাদ মাধ্যম আয়নার মতো। তাতে রাজনৈতিক দল বা নেতার উত্থানও যেমন প্রতিবিম্বিত হয়, ঠিক সে ভাবে পতনও প্রতিবিম্বিত হয়।
বৃহৎ প্রেক্ষাপটে বিষয়টি দেখা প্রয়োজন। সংবাদ মাধ্যম আমজনতার ধারণাকে নির্মাণ করে না। সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা বরং অনেক ক্ষেত্রে অনুঘটকের মতো হতে পারে। কোনও নেতা বা দলের উত্থানের সময় সংবাদ মাধ্যম তাকে ধাক্কা দিয়ে তার ঊর্ধ্বগতিকে কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত করতে পারে, আবার যে ডুবছে তাকে ধাক্কা মেরে আরও দ্রুত পতনের পথে ঠেলে দিতে পারে। কিন্তু যে প্রকৃতির নিয়মে উঠছে তাকে নামাতে পারে না আর যে নামছে, তাকেও জোর করে উপরে তুলতে পারে না। রাজনৈতিক মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে যাওয়া কি অত সহজ?
এ বার লোকসভা নির্বাচনের আগে মনমোহন সিংহ সরকারের ১০ বছরের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ এক ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছে যায়। নীতিপঙ্গুতার বিরুদ্ধে গোটা দেশের মানুষ কার্যত বিদ্রোহ করল। ইউপিএ-র দু’টি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সমবেত ভারতবাসী মনে করল যে নরেন্দ্র মোদীই সম্ভবত ভারতের সমস্ত ব্যধির জন্য সর্বরোগহরা বটিকা। নরেন্দ্র মোদীকে ঘিরে মানুষের যে প্রত্যাশা তা ছিল গগনচুম্বী। যেন মোদী এক সুপার ম্যান। তিনি যেন অরণ্যদেব বা ব্যাটম্যান। তিনি হাতে একটা ঝাড়ু নিয়ে সব ঝেটিয়ে সাফ করে দেবেন।
ভারতের বাস্তব পরিস্থিতিটা সত্যিই কি তাই? এই পচে যাওয়া গলে যাওয়া ব্যবস্থাকে কোনও ব্যক্তির পক্ষে এক বছরের মধ্যে বদলে দেওয়া সম্ভব?
ভোটের আগে প্রত্যাশা সব দল, সব নেতারই ভাল লাগে। কিন্তু পরে সে প্রত্যাশা পূরণ করাটাই হয়ে ওঠে মস্ত বড় সমস্যা। ত্রিপুরার নৃপেন চক্রবর্তীর সিপিএম সরকার বেশ কয়েক বছর ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু শাসনকালে আইনশৃঙ্খলার এতটাই অবনতি হয় যে মানুষ তাদের সরিয়ে সুধীর মজুমদারের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু তার পর ত্রিপুরা রাজ্যে কংগ্রেস রাজত্বের পরিণতি কী হয়েছিল তা-ও আমাদের সকলের জানা। সে দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গে একটানা তিন দশকেরও বেশি সময় নিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে টিকে থাকাটাই এক ধরনের রাজনৈতিক অনক্রম্যতা।
সম্রাট অশোক তাঁর স্তম্ভানুশাসনের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলেছিলেন, কোনও ব্যক্তি কেবল তার ভাল কাজগুলো দেখে আর ভাবে আমি ভাল কাজ করেছি। কিন্তু অপর পক্ষে কোনও ব্যক্তি তার খারাপ কাজগুলো দেখে না। ভাবে না। ‘আমি খারাপ কাজ করেছি’ অথবা এটা প্রকৃতপক্ষে খারাপ কাজ। কিন্তু এ সত্ত্বেও কোনও ব্যক্তির এটা নজর করা উচিত এবং ভাবা উচিত নিষ্ঠুরতা, কঠোরতা, ক্রোধ, গর্ব, ঈর্ষা— এগুলো প্রকৃতই পাপের জন্ম দেয়। এগুলো যেন আমার পতনের কারণ না হয়। কত শত শত বছর আগে দেবগণের প্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা ক্ষমতায় থাকার জন্য যে পরামর্শ দেন তা আজও প্রাসঙ্গিক।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে নরেন্দ্র মোদী, অখিলেশ যাদব থেকে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া— কেউ এই নিয়মের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারেন না। সম্প্রতি থমাস ফ্রিডম্যান এক রচনায় লন্ডন ভোটের পর্যালোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন যে পাঁচ বছরের শাসনকালে শেষ দুটো বছরই হল সবচেয়ে গুরুত্বপর্ণ। শেষ দুটো বছরের কৃতকর্ম ভোটারদের উপর প্রভাব ফেলে সব চেয়ে বেশি। তার ভিত্তিতেই ভোটে জেতা বা হারা অনেকটাই নির্ভর করে। লন্ডনে সরকার দীর্ঘ পাঁচ বছরে অনেক রকমের ব্যর্থতার দায়ে ন্যুব্জ। কিন্তু এখন শেষ পর্বে জেতার পরিচালনা নিয়ে ক্যামেরুন সক্রিয়।
সাম্প্রতিকতম ইকনমিস্ট (২ মে সংখ্যা) বলছে ‘ডেসপাইট দ্য রিস্ক অন ইউরোপ দ্য কোয়ালিশন লেড বাই ডেভিড ক্যামেরন শুড হ্যাভ আ সেকন্ড টার্ম’। ক’দিন আগে লখনউ গিয়েছিলাম। বিগত চার বছরে অখিলেশ পরাস্ত হয়েছেন নানা ভাবে। কিন্তু এখন শেষ লগ্নে অখিলেশও কিন্তু ভোটের কৌশল রচনা করে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। ভোটারদের মন জয় করতে তিনি সক্রিয়।
সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসই এ রকম। হাইমার প্রজাতন্ত্রের আয়ু যখন ফুরিয়ে আসছিল, তখনও পতনের সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠছিল। সংসদকে উপেক্ষা করে প্রশাসনিক ডিক্রি জারি করেই প্রশাসন চলছিল। সেই সময় জার্মানির সর্ববৃহৎ ও শক্তিশালী ন্যাশনাল সোসালিস্ট পার্টি অর্থাৎ নাৎসি দলের নেতা অ্যাডলফ হিটলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের চ্যান্সেলর হতে চাইছিলেন। তার পর ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি এই গঠনতন্ত্রকেই ধ্বংস করলেন।
আজ নরেন্দ্র মোদীর সরকারকেও এখনই সতর্ক হতে হবে। শুধু পারসেপশনের জন্য সংবাদ মাধ্যমকে দায়ী না করে প্রকৃত কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে বার করতে হবে। রোগের কারণ ঠিকমতো জানতে পারলে তবেই রোগীর সুষ্ঠু চিকিৎসা সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy