জনসভায় নরেন্দ্র মোদী।— ফাইল চিত্র
ভারতীয় বিজ্ঞান সংবাদ সংস্থা ১৯৩৮ সালের ২১ অগস্ট সংগঠনের তৃতীয় সাধারণ সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য সুভাষচন্দ্র বসুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অধ্যাপক মেঘনাদ সাহাও ওই সভায় হাজির ছিলেন। অধ্যাপক সাহা সে দিন সুভাষবাবুকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। ভারতবর্ষে ১৯৩৮ সালের ২১ অগস্ট সেই প্রশ্নোত্তরের কিছু অংশ প্রকাশিত হয়।
মেঘনাদ সাহার প্রশ্ন, আমি কি আপনার কাছে বিনীত ভাবে এই প্রশ্ন করতে পারি যে ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ গরুর গাড়ির মাধ্যমে গ্রামজীবনের দর্শনেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে না কি আনুষ্ঠানিক শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে? জবাব দেন সুভাষবাবু। তিনি বলেন, ভারতের মুক্তি আন্দোলন এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে যে স্বরাজ আর স্বপ্নাতীত নয়। অদূর ভবিষ্যতে এক আদর্শে পৌঁছনোও দূর অস্ত নয়। বিপরীতে, আমরা ক্ষমতার গন্ধও পেতে শুরু করেছি। কেননা ব্রিটিশ ভারতে ১১টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৭টিতে কংগ্রেস এখন মন্ত্রিত্বে আছে। ওই সব সরকারের ক্ষমতা সীমিত বলে তাদের চৌহদ্দির অভ্যম্তরে পুনর্গঠনের সমস্যা এখনও থেকে যাচ্ছে। আমরা কী ভাবে এই সমস্যার সমাধান করব? প্রথম ও সর্বাগ্রে আমরা তাই চাই এই কাজে বিজ্ঞানের সাহায্য।
সে দিন এই দুই বিশিষ্ট বাঙালি ব্যক্তিত্বের কথোপকথন থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, দু’জনেই সবরকম পশ্চাদমুখীনতা পরিত্যাগ করে অর্থনীতিকে সংস্কারের পথে, শিল্পায়নের পথেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সুভাষবাবু বলেন, বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য এ দেশে শিল্পায়ন প্রয়োজন। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষাবাদের দ্বারা জমির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলে প্রতিটি নারী-পুরুষকে খাবার দেওয়া সম্ভব হলেও এক সংখ্যক মানুষকে জমি থেকে শিল্পে স্থানান্তরিত করতেই হবে।
আচ্ছা ভাবুন, সুভাষবাবু ১৯৩৮ সালে মেঘনাদ সাহাকে যা বলেছেন, ২০১৭ সালে আমরা তা-ই আলোচনা করছি। যে কোনও দেশের অর্থনীতির শুরু এবং শেষ কর্মসংস্থান দিয়ে। কিন্তু ভারতে চাকরিবাকরি কোথায়? একটি ইংরেজি সাপ্তাহিকের প্রচ্ছদ নিবন্ধে ছবি ছাপা হয়েছে যে, ভারতে কর্মসংস্থান এখন কবরখানায়। অর্থাৎ, এ দেশে চাকরি হল এক মৃত বিষয়। তার মধ্যে আরও বেদনাদায়ক ঘটনা হল অটোমেশনের জন্য কর্মহীন চাকরিহীন আর্থিক বৃদ্ধি। এই বেকারি সামাজিক নিরাপত্তার আবহকেও নষ্ট করে। মধ্যযুগেও ঠগ-ডাকাতদের বাহিনীর জন্ম হয়েছিল সাধারণ মানুষের রোজগারহীনতা থেকে। সে কপালকুণ্ডলাই হোক আর দক্ষিণে চোল সাম্রাজ্যে বন্দর এলাকার ডাকাত দৌরাত্ম্য— সর্বত্র কারণ একই। কৃষকদের আত্মহত্যা হোক, পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেটই হোক আর শ্রীনগরে জঙ্গি কার্যকলাপ, সবের পিছনে আছে আর্থিক সঙ্কট, চাকরিহীনতা। কর্মসংস্থান হলে সমাজে আয় বৃদ্ধি হয়। আয় বৃদ্ধি হলে বাজার তেজি হয়। বাজার তেজি হলে বিনিয়োগ বাড়ে।
২০১৩ সালে নির্বাচনী প্রচারে মোদী বলেছিলেন, এক বছরে তিনি ১ কোটি (১০ মিলিয়ন) চাকরির ব্যবস্থা করবেন। ২০১৪-র মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর ৮ লক্ষ ২৩ হাজার চাকরি হয়েছে। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন প্রয়োজন বছরে কমপক্ষে ১ কোটি ৬০ লক্ষ (১৬ মিলিয়ন) চাকরি। মেক ইন ইন্ডিয়া, স্কিল ইন্ডিয়া, স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া, মুদ্রা ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা, এ সব মোদী করেছেন। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।
মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁরও অনেক সভাকবি হয়েছে। বলা যায়, রাজপাদোপজীবী অথবা আরও নিচুস্তরের রাজসেবক শ্রেণি। এঁরা চিৎকার করে বলছেন, মোদীর জনপ্রিয়তা অটুট। কিছু বামপন্থী উদারবাদী এটা ভেবে আনন্দ পাচ্ছেন, মোদীর জনপ্রিয়তা কমছে। মানুষ প্রশ্ন তুলছে। অনাস্থা ও অসন্তোষ বাড়ছে। বিশেষত আর্থিক ক্ষেত্রে পটভূমি বেশ প্রতিকূল।
দেখুন, আর্থিক সংস্কার দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু কোনও জমানাতেই আর্থিক সংস্কারের দাওয়াই যন্ত্রণাবিহীন হতেই পারে না। কিন্তু, মোদী সরকার তিন বছর পর একদিকে যেমন কর্মসংস্থানও তৈরি করতে পারছে না, অন্য দিকে আর্থিক সংস্কারে কড়া দাওয়াইও নিতে পারছে না। পেট্রোল ও ডিজেলের উপর শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত অর্থমন্ত্রক মনেপ্রাণে না চাইলেও অমিত শাহ এবং মোহন ভাগবত চেয়েছেন ভোটের স্বার্থে।
অমর্ত্য সেনের মতো মানুষ বলতে শুরু করেছেন, এ দেশে এমন একটি রাজনৈতিক দল চাই যা খোলা বাজারের অর্থনীতির বাধ্যবাধকতাকে অন্তর থেকে স্বীকার করবে। বামপন্থীদের প্রাসঙ্গিকতাও আছে, কিন্তু তাদেরও পশ্চাদমুখীনতা পরিত্যাগ করে এগোতে হবে সামনের দিকে।
কোথায় আমরা তা করতে পারছি? মোদী সরকারও এখন ভোটে জেতার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এই রাজনীতিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে না। সুভাষ বসু যে শিল্পায়নের কথা ভেবেছিলেন তা-ও হবে না।
গভীর এক অসুখের শিকার আজ আমরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy