বাবুল সুপ্রিয়
বাবুল সুপ্রিয় টুইট করে আমার একটি প্রবন্ধ সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত গত বুধবার ‘রাজধানী রাজনীতি’ কলমে লিখেছিলাম, যে ভাবে সিবিআই-কে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা সমর্থনযোগ্য নয়। দুর্নীতির স্বপক্ষে কেউ বলছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সাংসদ-বিধায়ক-আত্মীয়স্বজন-বন্ধু-পরিজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেলে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে তার ‘টাইমিং’ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে এটা তদন্ত নয়, এটা হল রাজনীতি। অতীতে কংগ্রেস জমানায় সিবিআইকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আজ নরেন্দ্র মোদীর জমানায় সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি দুর্ভাগ্যজনক।
বাবুল এই প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে দু’টি কথা বলেছেন। প্রথমত, এর পর নাকি আমার দিদির দলের পক্ষ থেকে রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হওয়া পাক্কা। দ্বিতীয়ত, বিজেপি নেতাদের দেখেছি তোমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করে। তুমি এ রকম লেখা লিখলে! এটা খুবই দুঃখের।
এই মন্তব্য পড়ে মনে হল, বিষয়টি ব্যক্তিগত নয়। সংবাদ মাধ্যম, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু সঙ্গত প্রশ্ন এই সময়ে আলোচনা করা যায়। প্রথমত, সাংবাদিকেরা যাঁরা রাজনীতি কভার করেন তাঁরা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মিশবেন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠাও স্বাভাবিক। এর সঙ্গে ক্ষমতায় থাকা বা না-থাকার কোনও সম্পর্ক নেই।
বরুণ সেনগুপ্ত আনন্দবাজার পত্রিকা-য় একদা সিপিএম সম্পর্কে সমালোচনামূলক লেখা লিখতেন। কিন্তু প্রমোদ দাশগুপ্ত তাঁকে স্নেহ করতেন। বিমান বসু থেকে বুদ্ধবাবু, প্রয়াত অনিল বিশ্বাস, সুভাষ চক্রবর্তী সকলেই ওঁর ব্যাপারে প্রশংসাই করতেন। আজ নরেন্দ্র মোদী, অরুণ জেটলি বা অমিত শাহ কেন, আমার সঙ্গে বাবুল সুপ্রিয়রও তো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আমার তো মনে হয় ওঁর ব্যক্তিত্ব বা চরিত্রের মধ্যে একটা মজা আছে। ওঁর বিয়ের দিন খুব মজা করেছিলাম দিল্লিতে। আবার রজত শর্মার ‘আপ কি আদালত’ অনুষ্ঠানে বাবুলকে যে দিন ডাকা হয় সে দিন আমি বিচারক ছিলাম। সে দিন রায় দিতে গিয়ে বলেছিলাম, বাবুলের যতটা গায়ক সত্তা এখনও রাজনৈতিক সত্তা ঠিক ততটা মুখ্য হয়ে ওঠেনি ওঁর জীবনে। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গায়ক বাবুল ক্রমশ রাজনৈতিক বাবুলও হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। ওঁর সাফল্য কামনা করি। ওটা একটা মজার অনুষ্ঠান। ওই বিচার ও বিচারক তো সত্যি সত্যিই কোনও আদালতের বিচার নয়। সে দিন মধুরেন সমাপয়েত হলেও এটা বুঝতে পারছি, মোদী বা বিজেপি সম্পর্কে সমালোচনা করায় বাবুল সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুব্ধ।
এখানেই কিন্তু সমস্যা। গণতন্ত্রে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সমালোচনা আসলে গণতন্ত্রকেই শক্তিশালী করে। পরমত সহিষ্ণুতা তাই বিশেষ জরুরি। লেট আস এগ্রি টু ডিসএগ্রি। সম্রাট আকবর যদিও কুরান আর উপনিষদ দু’টি বিষয়কেই সমান ভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ভেদভাব নয়, নানা মতের সমন্বয়ের ভাবনা থেকেই তৈরি হয়েছিল দীন ইলাহি-র মন্ত্র।
আজকের এই রাজনীতির অসহিষ্ণুতা দেখে তাই আমি দুঃখিত হই। সাংবাদিকের রচনা কোনটি কোনও রাজনীতিকের পক্ষে যাবে, কোনটি তার বিরুদ্ধে যাবে, আমি লেখার সময় কার পক্ষে যাবে আর কার বিপক্ষে যাবে সে কথা ভেবে লিখব কেন? কোনও রচনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে, অতএব আমি মমতার আনুকূল্য চাইছি? রাজ্যসভার সদস্যপদ? রাজ্যসভার সদস্যপদের মর্যাদা কি সাংবাদিকের মর্যাদার চেয়ে বেশি? আসলে রাজনৈতিক নেতাদের দোষ দেব না। সাংবাদিকেরা নিজেরাও এ ধারণা তৈরি করতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছেন। সম্প্রতি বিজেপির এক শীর্ষ নেতার সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আমার কথা হচ্ছিল। তাঁকেও বলেছি, আমরা সাংবাদিকেরা সবাই কিন্তু বিজেপি কেন, কোনও দলেরই কাছে আবেদনপ্রার্থী নয়। ‘অ্যাসপিরান্ট’ ও ‘অ্যাপ্লিক্যান্ট’ অনেকে আছে এ কথা ঠিক। কিন্তু আমার মনে হয়, দলের নেতাদের কৃপাপ্রার্থী না হলে বরং পারস্পরিক সম্পর্কের গরিমা আরও বেশি থাকে। আমি রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত স্তরে জ্ঞান দিয়ে উপদেষ্টা হওয়ার চেষ্টা করছি না। আবার আমার রচনার স্বাধীনতা খর্ব করতেও রাজনৈতিক নেতারা কখনওই সক্রিয় হবেন না।
অতীতেও রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের মধ্যে এই সম্পর্কের মাধুর্য ছিল। মনে আছে, লালকৃষ্ণ আডবাণী তখন উপপ্রধানমন্ত্রী। ওঁর সম্পর্কে লিখেছিলাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে আমূলের ক্যুরিয়ান যদি অবসরগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তবে আডবাণী কেন পারেন না?
এই রচনা আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলায় প্রকাশিত হল। বেশ কয়েক দিন কেটে গেছে। এর পর এক দিন গেছি আডবাণীর বাড়িতে। আডবাণী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি আমার বিরুদ্ধে কিছু লিখেছ? জবাবে আডবাণীকে বললাম, বিরুদ্ধে তো লিখিনি। ওটা আমার বিশ্লেষণ। বলেছি, থামতে জানতে হয় বর্ষীয়ান নেতাদের। রচনায় ব্যক্তিগত আক্রমণ নেই। তথ্যবিকৃতি নেই। আমার নিজস্ব অভিমত আছে।
আডবানী বললেন তথাগত (তৎকালীন রাজ্য বিজেপি সভাপতি তথাগত রায়) আমাকে অনুবাদ করে পাঠিয়েছে। ওর সঙ্গে পারলে একবার কথা বলে নিও। ও কেন তোমার সম্পর্কে কমপ্লেন করছে? কথা বলতে বলতে আডবাণীর স্ত্রী কমলা দেবী ঢুকলেন। আডবাণী বললেন, জান তো কমলা, জয়ন্ত আজ আমার বিরুদ্ধে লিখেছে। কমলা দেবী বললেন, তা হলে চা খাওয়াবো না আজ জয়ন্তকে। চা-বন্ধ। আডবাণী বললেন, না না, এমন কোর না। আমাদের দু’জনের জন্যই বেশ গরম চা আর নমকিন পাঠাও।
বলুন তো, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের কাছ থেকে এই আচরণ আশা করা যায়?
(এখন থেকে ‘শাহি সমাচার’ বুধবারের পরিবর্তে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy