১৯৭৭-এর ১৮ জানুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পেয়েই মোরারজি দেশাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পিলু মোদীকে বলেছিলেন, ‘‘এক হওয়ার পাপ থেকে আমরা বেঁচে গেলাম।’’ মার্চের নির্বাচনের কথা সে দিনই ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু বিরোধী দলগুলির এককাট্টা হওয়া তখন প্রশ্নের বাইরে। ৮১ বছর বয়সেও মোরারজি দেশাই দৃঢ়তার প্রতিমূর্তি। কিন্তু জেল থেকে বেরনোর পর অনেক বেশি নিঃসঙ্গ শূন্যতার মধ্যে। আঘাতে-সংঘাতে তাঁর দল টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। আজ এত বছর পর বিজেপি-র বিরুদ্ধে যখন লালুপ্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার, বামদল একত্রিত হয়ে বিহার নির্বাচনে মোর্চা বানাতে চলেছেন তখন এই জনতা পরিবারের পুরনো অভিজ্ঞতাগুলিও মনে পড়ছে, মনে পড়বে এ দেশের মানুষের। ’৭৭ শুধু নয়, ’৮৯ সালে, এমনকী, তারপর দেবগৌড়া এবং সেন্ট্রিস্ট দলগুলির পরিস্থিতি দেখেছি। কখনও এই দলগুলি কংগ্রেস বিরোধিতা করেছে। ’৭৭ সালে, ’৮৯ সালে যেমন জনসংঘ এবং বিজেপি-কে নিয়ে তারা কংগ্রেস বিরোধিতা করেছে, তেমনই আবার চরণ সিংহ, চন্দ্রশেখর, দেবগৌড়া, গুজরাল কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে বিজেপি-কে ভারতীয় রাজনীতিতে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে।
ভারতের রাজনীতি কোয়ালিশন যুগে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে বেশ কয়েক দশক ধরেই। কিন্তু এ বার ২০১৪-র নির্বাচনে যে ভাবে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, তাতে এ প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবে উত্থাপিত হচ্ছে যে এই প্রাচীন জনতা পরিবারের ঐক্যবদ্ধতা কি ভারতের রাজনীতিতে আবার পরিলক্ষিত হবে? শুধু বিহার নির্বাচন নয়, দিল্লির রাজনীতিতেও কি এই জনতা পরিবার আবার বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের প্রতিনিধিত্বের কোলাজ তৈরি করে এক অখণ্ড জাতীয় রাজনীতির পথে এগোতে পারবে?
আসলে বিজেপি এবং কংগ্রেস, যত দিন যাচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতিতে এই দুই প্রধান প্রতিপক্ষ ক্রমশ এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারাও ক্ষমতার রাজনীতির জন্য সব রকমের আপোসে আজ অভ্যস্ত। প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সেই একই রকমের অশ্রদ্ধা। রাজনৈতিক নেতাদের একই রকমের জীবনযাপনের ধারা। ক্ষমতার বুড়ি ছোঁয়ার জন্য জকির মতো প্রাণপণ দৌড়। সেই সনাতন কূট চক্রান্ত। মতলব হাসিলের চেষ্টা। সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি অনুরূপ অসহিষ্ণুতা।
এক জন একনায়ককে সরিয়ে আর এক জন একনায়ক হন। এক বিদূষকের বদলে অন্য বিদূষক আসেন। মোরারজি দেশাই সরকার যখন গঠন হয়েছিল, তখন সাংবাদিক জনার্দন ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘সঞ্জয় গাঁধীর জায়গায় এসেছিলেন কান্তি দেশাই। বংশীলালের বদলে এসেছিলেন দেবীলাল।’ কাজেই জামা বদলায়, রাজা বদলায় না। জনতা সরকার আসার পরেও শাসনের অবস্থা ছিল হতাশাব্যঞ্জক। বরং সেই সময় জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো দলহীন গণতন্ত্রে এক ভাবুক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আজ কিন্তু সে রকম কোনও চরিত্র নেই। জয়প্রকাশ বলেছিলেন, হয় ওরা এক দল হয়ে নির্বাচন লড়বে, তা না হলে আমি ওদের সঙ্গে নেই। বিরোধী দলের ধর্মপিতা ছিলেন তিনি। তাঁর হুমকিতে কাজ হয়েছিল। চরণ সিংহ, মোরারজি দেশাই থেকে বাজপেয়ী, আডবাণী— সব এক মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ মুলায়ম-লালু-নীতীশকে নিয়ে মোদী বিরোধী মঞ্চের কাণ্ডারী কে হবেন?
তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক সময় দেশের ঘটনাপ্রবাহের অভিমুখ তৈরি করে দেয়। সিপিএমের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। মনমোহন সিংহের সরকারের প্রতি তীব্র অসন্তোষ নরেন্দ্র মোদীর সাফল্যের পথ প্রশস্ত করেছে। ইন্দিরা গাঁধীর ‘বিশাল নাসিকা’কে বিরোধীরা অনেকখানি বিকৃত করতে সফল হয়েছিল। একাত্তরের সুনাম, গরিবি হঠাও স্লোগান অন্তঃসারশূন্য হয়ে গিয়েছিল। এ বার নরেন্দ্র মোদী আগামী চার বছর কী ভাবে এগোবেন, কী করবেন, তিনি গণতন্ত্রের পথে হাঁটবেন না কি তাঁর নেতৃত্বেও আসবে একনায়কতন্ত্র— সেটা দেখার। তিনি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ দেবেন না কি দুর্নীতির সঙ্গে আপস করবেন, এই বিষয়গুলি আগামী বছরগুলিতে খুব বড় বিচার্য হয়ে উঠবে। যখন জনতা সরকার এসেছিল, তখনও সবাই ভেবেছিল কংগ্রেসের জমানার দুর্নীতি বিদায় হল। চন্দ্রশেখরের মতো তরুণ তুর্কী নেতা জনতা আমলে কী ভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে পরিচিত ব্যবসায়িকদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন, সে সব ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। জনার্দন ঠাকুরের ‘জনতা অ্যান্ড কোং’ বইতে সাধারণ মানুষের কাছেও ক্রমশ এই সব নেতাদের অন্ধকার জগৎ প্রকাশ্যে আসে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বিহার নির্বাচনে জাতপাতের সমীকরণ এবং বিজেপি বিরোধিতার তাস ব্যবহার করে নবগঠিত জনতা পরিবার সাফল্য পাবে কি না? আর পরবর্তী প্রশ্ন, বিহারের নির্বাচনের সাফল্য হোক বা না হোক, জাতীয় স্তরে মোদী বিরোধী এক নতুন মঞ্চ গঠনে এই জনতা পরিবার কর্মক্ষম হবে কি না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy