Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

তেলেভাজা বিক্রেতা আরতি সফল মাছ চাষি

এক সময় তেলেভাজা বিক্রি করতেন। এখন তিনিই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। পেয়েছেন কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের পুরস্কার। মাছ চাষি আরতি বর্মণের কথা বললেন আরিফ ইকবাল খানআরতি বর্মণ হয়তো তেলেভাজার দোকানিই থেকে যেতেন। যদি না তিনি মাছ চাষ শুরু করতেন। মাছ চাষ করেই এখন তিনি স্বচ্ছলের থেকেও বেশি।

মাছ ধরছেন চাষি আরতি। নিজস্ব চিত্র

মাছ ধরছেন চাষি আরতি। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৮ ০১:৫১
Share: Save:

অভাবের সংসার। তাই স্বামীর সঙ্গে লড়াই করতে হতো স্ত্রীকেও। বাড়তি উপায়ের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হন স্ত্রী। মেলায় মেলায় তেলেভাজার দোকান দিতে থাকেন। তাতে সংসারের উপকার হয়।

আরতি বর্মণ হয়তো তেলেভাজার দোকানিই থেকে যেতেন। যদি না তিনি মাছ চাষ শুরু করতেন। মাছ চাষ করেই এখন তিনি স্বচ্ছলের থেকেও বেশি। ব্যবসায় সফল হলে অনেকেই অর্থের মুখ দেখেন। কিন্তু আরতির সাফল্য অন্য জায়গায়। তিনি এখন শতাধিক মানুষের ভরসাস্থল। এক সময় লড়াই করেছেন। এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেন অন্যদের।

আরতি বর্মণের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া ব্লকের দ্বারিবেড়িয়া গ্রামে। ১০ বছর আগেও লোকে তাঁকে মেলায় তেলেভাজার দোকান দিতে দেখেছেন। কিন্তু তেলেভাজার ব্যবসা ছেড়ে মাছ চাষের দিকে ঝুঁকলেন কেন? অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেলেন? আরতি জানান, ভাগ্য ফেরাতে তিনি অনেক ভাবেই চেষ্টা করেছিলেন। প্রথমে মাছ চাষের দিকে ঝোঁকেননি। নিজেদের অল্প জমি ছিল। প্রথম দিকে স্বামীর সঙ্গে বাড়ির সামনের জমিতে ধান চাষ শুরু করেন। কিন্তু ধান চাষে ক্ষতি হয় তাঁদের। ভেবেছিলেন হয়তো গ্রামে গ্রামে মেলায় তেলেভাজার দোকান দিয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। সেই সময়েই তাঁকে পথ দেখায় রাজনগর। ওই গ্রামে আরতির বাপের বাড়ি। রাজনগরে সেই সময়ে অনেকে মাছ চাষে ঝুঁকছিলেন। আরতি খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। কী ভাবে নামা যায় মাছ চাষে? পুঁজিপাতি ইত্যাদি লাগে কতটা?

খোঁজখবর শুরু করে মাছ চাষে ঝোঁকেন তিনি। বাড়ির একটি পুকুরে শুরু করেন মাছ চাষ। লাভ হয় সেই চাষে। তাতে অল্প কিছু পুঁজি জমে। আরতি মাছ চাষ বাড়াতে থাকেন। মাছচাষ। সাহস করে আরও জমি লিজে নেন তিনি। হলদিয়া ব্লকের মাছ চাষি আরতি বর্মণকে এখন অনেকেই চেনেন। দু’চারটে পুকুরে সীমাবদ্ধ নেই আরতির মাছ চাষের পরিধি। আরতির কথায়, ‘‘তমলুকের রাজনগরে ২০০ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করি। এছাড়া হলদিয়ার দ্বারিবেড়িয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ১২০ বিঘা জমিতে চাষ করি।’’

আরতির ১০ বছরের আগের লড়াই কি এখন শেষ হয়েছে? আর্থিক সমৃদ্ধি এসেছে। লড়াই থামেনি তাঁর। এখন লড়াই অন্য দিকে বাঁক নিয়েছে। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। নানা শারীরিক সমস্যা। তা সত্ত্বেও রাত আড়াইটে পর্যন্ত কাজ করতে হয়। মাছ ওজন এবং রফতানির সময় গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। জেলার নানা প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন মাছ কিনতে। ভিন রাজ্যের পাইকারি ব্যবসায়ীরাও মাছ কিনতে আসেন আরতির কাছে। টন টন রুই, কাতলা, মৃগেল রফতানি হয় এখান থেকে। ব্যবসার কাজ ছাড়াও রাত জাগতে হয় মাছ রক্ষায়। এমন অনেক দিন গিয়েছে যে রাতে টর্চ ও লাঠি হাতে কর্মীদের সঙ্গে মাছের ভেড়ি পাহারা দিয়েছেন। ভেড়িতে মাছ চুরি হতো। তা ঠেকাতেই রাত পাহারা।

অভাবকে জয় করেই মাছ চাষে একের পর এক সাফল্য এনে দিয়েছে আরতিকে। কেন্দ্রীয় সরকারের মৎস্য দফতরের মৎস্য চাষির পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সম্প্রতি তিনি এই সম্মান পেয়েছেন। এর আগে অবশ্য তাঁর ঝুলিতে একাধিক পুরস্কার ছিলই। বছর তিনেক আগে হলদিয়া এনার্জি লিমিটেড সংস্থা তাঁর লড়াইকে সম্মান জানিয়েছিল বিশ্ব নারী দিবসে। তিনি ইতিপূর্বে হলদিয়া ব্লক ‘মৎস্য চাষি দিবস’ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে মৎস্য খাতে অবদানের স্বীকৃতিতে শংসাপত্র পেয়েছেন। এরপর বেশি মাছ উৎপাদনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আরতি পেয়েছেন ‘মীন মিত্র’ পুরস্কার। জলাভূমি দিবস-২০১৬ উপলক্ষে আরতি মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংেহর কাছ থেকে ওই পুরস্কার গ্রহণ করেন। পোনা জাতীয় মাছের অধিক উৎপাদন বিভাগে একমাত্র তিনিই এই পুরস্কার পেয়েছেন। আরতি জানান, সরকারি সাহায্য তাঁর এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। পরবর্তী সময়ে মৎস্য দফতরের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শে ঋণ ও সরকারি ভর্তুকি নিয়ে চাষের পরিধিও বাড়িয়ে তোলেন তিনি।

দারিদ্রের কারণে এক সময় মেলায় আরতি সামান্য তেলেভাজার দোকান দিতেন। আজ তাঁর কাছেই স্বনির্ভর হয়েছেন ২০০ জন। এখনও পাঁক জলে নেমে মাছ চাষ করেন। কিন্তু তাঁর অফিস ঘরটি ঝাঁ চকচকে। আরতি বর্মণ বলেন, ‘‘আমার লড়াই ছিল বেঁচে থাকার। বহু সংগ্রাম করেছি। সামান্য একটা পুকুর থেকে মাছ চাষ শুরু করে আজ নিজের পায়ের ওপর শুধু দাঁড়াতে পেরেছি। আমার সাফল্য কিন্তু বহু জনের কর্মসংস্থান করে দেওয়ায়। এটাই আমার সাফল্য বলতে পারেন।’’

হলদিয়া ব্লক মৎস্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় ২০০ বিঘার মাছ চাষের জমির মালিক আরতি।

হলদিয়ার মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক সুমন সাহু বলেন, ‘‘হলদিয়া ব্লকের আরতি বর্মন বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য মাছ চাষিদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণের জন্য নিজের ফিশারি ফার্মের জায়গা দিয়েছেন। এখানেই আধুনিক মাছ চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’’ হলদিয়া ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি খুকুমণি দাস জানান, আরতি একজন প্রগতিশীল মাছ চাষি। এত দ্রুত তিনি সব কিছু গ্রহণ করেন ভাবাই যায় না। আরতি বলেন, ‘‘মাছ চাষে এখন সংকটও দেখা দিচ্ছে। তমলুকে জলের অভাব দেখা দিয়েছে। মাছ চাষে অর্থ আছে বেশি। সরকার জলের ব্যবস্থা করুক।’’

সাফল্য এলেও আরতি কিন্তু এখনও মনোযোগী ছাত্রী। নতুন কিছু প্রশিক্ষণ হলে অন্যদের সঙ্গে নিজেও শেখেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Arati Barman fishing
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE