মারপ্যাঁচ: চলছে আত্মরক্ষার পাঠ। ভাঙড়ে মার্শাল আর্টসের একটি কর্মশালায়। নিজস্ব চিত্র
বছরখানেক আগে স্বামী মারা গিয়েছেন। স্বনির্ভর প্রকল্পে আচার বানিয়ে দু’বেলা সন্তানের খাবার জোগাড় করেন ফরজানা বেগম। কিন্তু রাস্তায় বেরোনো যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিল। ফরজানা বা তাঁর সাত বছরের মেয়েকে কখনও কুপ্রস্তাব, কখনও হুমকি দেওয়া হতো। প্রথমে বাজারে যাওয়ার পথ আটকে, পরে প্রতিবেশী দুই যুবক রাতে ঘরে ঢুকে হুমকি দিয়েছিল, ফরজানা তাঁদের সঙ্গে থাকতে রাজি না হলে তাঁর মেয়ের মুখে অ্যাসিড মারা হবে। হুমকিকে পাল্টা ‘প্যাঁচে’ কাত করতে শিখছেন ফরজানা।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে পাল্টা মার দিতে শিখছেন টুম্পা সাহা। বিয়ের সময়ে রঙিন টিভি আর বাইক দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাবা কথা রাখতে পারেননি। তাই বিয়ের কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই শুরু হয় মারধর। শ্বশুর, শাশুড়ি আর ননদ মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সময় মতো টুম্পার স্বামী এসে পড়ায় সে যাত্রা তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে বুঝেছিলেন, বাঁচার ‘কৌশল’ শেখা জরুরি।
টুম্পা, ফরজানাদের হাত ধরে লড়াইয়ের কৌশল শিখতে এগিয়ে আসছে তরুণ প্রজন্ম। আত্মরক্ষার জন্য মার্শাল আর্ট শিখছেন পারিবারিক হিংসার শিকার হওয়া গৃহবধূ থেকে কলেজ ছাত্রী। কেউ তাইল্যান্ডের ‘মুয়াইথাই’, কেউ আবার ইজরায়েলের ‘ক্রভ মাগা’-র কৌশলে আত্মরক্ষার পাঠ নিচ্ছেন। শহর থেকে শহরতলি— মহিলাদের আগ্রহ বাড়ছে আত্মরক্ষার পাঠে।
এ প্রসঙ্গে সিআইডি-র এক মহিলা কর্তা বলেন, ‘‘স্কুলে গিয়ে অঙ্ক কষা কিংবা গানের রেওয়াজ করার মতোই শারীরিক ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠা জরুরি। এটা ছোট থেকে মেয়েদের শেখানো দরকার। তবে মেয়েদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে, সেটা দেখে ভাল লাগছে।’’ ক্রিকেটার ঝুলন গোস্বামী অবশ্য মনে করেন, এ প্রজন্ম ছক ভাঙতে শিখছে। তাঁর কথায়, ‘‘চিরাচরিত কাজের বাইরেও মেয়েরা সফল হচ্ছে। এমন ‘আইকন’ এখন রয়েছে। তাঁদের দেখে মহিলারা বুঝতে পারছেন শারীরিক দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা।’’
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ক্রভ মাগা কিংবা মুথাই একসঙ্গে একাধিক আক্রমণ প্রতিহত করতে শেখায়। আর এ ধরনের কৌশল শেখার জন্য বয়সের কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। তাই যে কোনও বয়সের মহিলারা এই কৌশল শিখতে পারেন এবং একসঙ্গে একাধিক আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারবেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাই এই সব কৌশল শেখার প্রতি অধিক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এই আগ্রহকে ‘সৌন্দর্য’-র নতুন নামকরণ বলে মনে করছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘মেয়েরা শারীরিক ভাবে শক্তিশালী হওয়ার মধ্যে দিয়ে ছক ভাঙছে সৌন্দর্যের ধারণার। নির্যাতিতা কিংবা সদ্য বাইরে পা রাখা মেয়ে, সব বয়সীদের মধ্যেই যে নিজেকে শক্তিশালী করার আগ্রহ জন্মাচ্ছে, এটা খুব ভাল।’’
এমন কর্মশালার আয়োজকেরা জানাচ্ছেন, হাতেকলমে কৌশল শেখানোর পাশাপাশি যে কোনও চরম পরিস্থিতিতে যাতে মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, সেই তালিমও দেওয়া হচ্ছে মহিলাদের। আক্রমণের শিকার হয়ে অনেক সময়েই তাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়েন। কিন্তু কোনও পরিস্থিতিতে কী ভাবে কৌশলের সঙ্গে নিজেকে বাঁচানো যাবে সেটা যেমন শেখানো হচ্ছে, তেমনই আইনগত সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কেও অবগত করা হচ্ছে। এমনই একটি আয়োজক সংস্থার কর্ণধার অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় জানান, সম্প্রতি তাঁরা প্রায় ৮০০ মহিলাকে নিয়ে ক্লাস শুরু করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুল-কলেজের পড়ুয়ার পাশাপাশি গৃহবধূরাও আত্মরক্ষার পাঠে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।’’
আত্মরক্ষার পাঠ শেখার এই আগ্রহকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘সর্বত্রই দুর্বলের উপরে সবল অত্যাচার করে। তাই নিজেকে সব দিক থেকে সবল ভাবে তৈরি করা দরকার। আত্মরক্ষার পাঠ সকলের জন্যই জরুরি। মেয়েরাও যে এগিয়ে আসছে, এটা দারুণ ব্যাপার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy