Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Durga Puja Preparations

লাহা পরিবারের পুজো

লাহা বাড়ির পুজোর প্রবর্তন কে করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে বিস্তর।

লাহাবাড়ির পুজো।

লাহাবাড়ির পুজো।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৮ ১০:২১
Share: Save:

অসাধারণ কারুকাজ করা ঠাকুর দালান, আভিজাত্য আর প্রাচুর্যের শব্দ তুলে ওপরে ওপরে উঠে যাওয়া কাঠের সিঁড়ি কখনও আবার চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মন কেড়ে নেওয়া অ্যান্টিক পিস। হঠাৎ মনে হয় এক টুকরো পুরনো কলকাতা এখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টুকটুকে লাল বাড়িটায়। আগে লোকে এই বাড়িটকে বলত ‘ল’ বাড়ি। এই বাড়ির দুর্গা পুজো নাকি হত দেখার মত। হবে নাই বা কেন ? সেই সময় জমিদার বাড়িগুলির মধ্যে তো রেষারেষি কম ছিল না। সেই সঙ্গে এঁরা সবাই ছিলেন বাবু কালচারের পৃষ্ঠপোষক। কাজেই পুজোকে উপলক্ষ্য করে বাবুদের নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার ধূম পড়ে যেত। লাহারা যেমন ছিলেন অর্থবান তেমনই প্রভাবশালী। পুজোর উপাচার আয়োজনে কীভাবে অন্য বাড়িকে তাক লাগিয়ে দেওয়া যায় সেটা এই বাড়ির কর্তারা বিলক্ষণ জানতেন। তবে জাঁকজমক যতই থাক, এই পুজোতে দেবী মায়ের প্রতি আন্তরিক ভক্তিতে খামতি পড়েনি কোনওদিনও। প্রাণকৃষ্ণ লাহা , নবকৃষ্ণ লাহা, শ্রীকৃষ্ণ লাহা এই বাড়ির বড় তরফ মেজ তরফ এবং ছোট তরফ। লাহা পরিবারে তিনটি তরফে পালা করে প্রতি বছর পুজো হয়।

লাহা বাড়ির পুজোর প্রবর্তন কে করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে বিস্তর। মনে করা হয় বর্ধমানের বড়শূলে প্রথম পুজো শুরু করেন বনমালী লাহা। এরপর মধুমঙ্গল লাহা চুচুঁড়ার বাড়িতে পুজো শুরু করেন। কলকাতায় এই পুজো শুরু করেন দুর্গাচরণ লাহা। শিবচরণ লাহা ইংরেজদের সঙ্গে পেন খাতাপত্র এবং মূল্যবান রত্নের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। পুজোর জাঁকজমকও বাড়ে এই সময়। লাহা বাড়ির পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। এখানে ঠাকুরের রূপ অন্যরকম। একচালা মূর্তি হয়। শিবের কোলে দেবী দুর্গা উপবিষ্টা। শিবের বাহন ষাঁড়। লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ আছেন তাঁর দুইপাশে। দেবীর দুই হাত এবং তাতে কোনও অস্ত্র নেই। মহিষাসুর থাকেন না এই মূর্তিতে। সেই জন্যই এই বাড়িতে দুর্গা মহিষাসুর মর্দিনী রূপে পূজিত হন না। কখনও তাঁকে বলা হয় অভয়া কখনও হরগৌরী কখনও বা আবার হরপার্বতী মূর্তি। লাহা পরিবারের কুলদেবী অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী মূর্তি জয়জয় মা। মূর্তিটি নিয়ে ভারি সুন্দর একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। লাহা পরিবারের তখনও তত খ্যাতি ঐশ্বর্য হয় নি। সেই সময় নাকি দেবীর এই মূর্তি কোন এক গভীর জঙ্গলে ডাকাতদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে অনাদরে অযত্নে পড়ে ছিল। বাড়ির এক সদস্য দেবীর কাছে স্বপ্নাদেশ মেয়ে মূর্তি উদ্ধার করতে গিয়ে দেখেন, দেবী বড় বিপন্ন। তিনি যত্নে দেবীকে তুলে নিয়ে এসে কুলদেবী রূপে পুজো করতে শুরু করেন। তারপর থেকেই লাহাদের প্রভূত উন্নতি হয়। পুজোর সময় মূর্তি রূপোর সিংহাসন সহ ঠাকুর ঘর থেকে নিয়ে এসে হরপার্বতীর সামনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে দুই দেবী মূর্তির একই সঙ্গে পুজো হয়। পুজো শেষে বিসর্জনের আগে জয়জয় মা কে ঠাকুর ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।

লাহাবাড়িতে কাঠামো পুজো হয় জন্মাষ্টমীর দুই তিন দিন পরে। এই সঙ্গে তৈরি করা হয় একটি ছোট্ট মাটির গনেশ। যতদিন না ঠাকুর সম্পূর্ণ হচ্ছে মাটির গণেশকে পুজো করা হয়। এরপর বড় গণেশ তৈরি হলে ছোট গণেশকে তার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দেবীপক্ষের শুরুতে বোধন হয়। পঞ্চমীর দিন সকালে চাল ডাল তেল চিনি মশলা মধু রান্নার সব উপকরণ ডালাতে সাজিয়ে দেবীকে দেওয়া হয়। একে বলে ‘রচনা। ষষ্ঠীর দিন হয় কল্পনা আর অধিবাস। এই দিন ঠাকুরকে গয়না আর অস্ত্রে সাজিয়ে দেওয়া হয়। কার্তিকের যাবতীয় অস্ত্র , লক্ষ্মীর ঝাঁপি, পেঁচা, গণেশের শঙ্খ , চক্র , গদা , পদ্ম , মা সরস্বতীর বীনা, শিবঠাকুরের মাথায় সাপ এগুলি সবই রূপোর এই বাড়িতে। মহালয়ার দিন থেকে বাড়িতে ভিয়েন বসে। এই সময় থেকেই মিষ্টি তৈরি শুরু হয় বাড়িতে। নানা রকম নাড়ু এই বাড়ির ভোগের বৈশিষ্ট। তিলের নাড়ু , নারকেলের নাড়ু সুজির নাড়ু, বেসনের নাড়ু, মেওয়া চিনি ক্ষীর আর বাটার স্কচ ফ্লেভার দিয়ে দিয়ে তৈরি বিশেষ এক ধরণের নাড়ু এছাড়া আছে খাজা, পান গজা , চৌকো গজা , কুচো গজা , এলোঝেলো তো আছেই। সবমিলিয়ে প্রায় ২১ রকমের মিষ্টি বাড়িতে তৈরি হয়। পঞ্চমীর দিন পর্যন্ত চলে এই পর্ব। লাহা বাড়িতে অন্নভোগ হয় না। পুজোতে পশুবলিও হয় না। কুমড়ো আর শশা বলি দেওয়া হয়। অষ্টমীর পুজোর পরে ধুনো পোড়ানো হয়। বাড়ির মহিলারা দুই হাতে আর মাথার ওপরে সরায় জ্বলন্ত ধুনো নিয়ে ঠাকুর দালানে বসেন। নবমীর দিন দেবীকে ‘কোল হাড়ি’ দেওয়া হয়। দেবীর কাছে খই মুড়কি মিষ্টি ছোট্ট একটা হাড়িতে ভরে উৎসর্গ করা হয়। পুজোর পর বাড়ির মহিলারা গৃহের মঙ্গলার্থে এগুলি নিয়ে যে যাঁর বাড়িতে নিয়ে যান।

ঠাকুর দালান।

আরও পড়ুন: আটটি বাড়িতে পুজো হয় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের​

আরও পড়ুন: নবমীতে রাতভর মজলিশ নেই, তবে জোড়া নৌকায় বিসর্জন আজও ঘোষবাড়ির ঐতিহ্য বয়ে চলেছে​

দশমীর দিন বেলপাতায় দুর্গানাম লেখেন বাড়ির ছেলেরা। দশমীর অঞ্জলিও তাঁরাই দেন। মেয়েরা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন না। বিসর্জনের প্রথাও অন্য বাড়ি থেকে আলাদা এই বাড়িতে। কোনও যানবাহনে নয় পুরনো ঐতিহ্য মেনে লাহা বাড়ির দেবীকে আজও কুলিরা কাঁধে ঝুলিয়ে বিসর্জনে নিয়ে যান। যেই মাত্র দেবী বাড়ির মূল দরজা পার হন, ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন বাড়ির মেয়েরা। বিসর্জন দিয়ে ফিরে বাড়ির পুরুষরা জিজ্ঞাসা করেন, ‘মা আছেন ঘরে’ ? তখন বাড়ির কোনও মহিলা ভিতর থেকে উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ মা আছেন।‘ বাইরে থেকে ফের জিজ্ঞাসা করা হয় ‘মা আছেন ঘরে ?’ একই উত্তর দেওয়া হয় ভিতর থেকে। এভাবে পরপর তিনবার জিজ্ঞাসা করা হয়। এরপরই মূল দরজা খুলে পুরুষরা প্রবেশ করেন বাড়িতে। দেবী আসলে সর্বময়, মৃন্ময়ী মূর্তির বিসর্জনে বাড়ি ফাঁকা হয় না, দেবীর অধিষ্ঠান সব সময় তাঁর ভক্তদের মাঝে, সম্ভবত এই কথা বাড়ির লোকদের বোঝাতেই পুজো শুরুর দিন থেকে লাহা বাড়িতে চলে আসছে এই প্রথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE