শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গা প্রতিমা।
শোভাবাজার রাজবাড়ির বড় তরফ এবং ছোট তরফ, দুই পক্ষেরই রথযাত্রার দিন ঠাকুরের কাঠামো পুজো হয়। যজ্ঞ এবং মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়। শুরু হয় প্রতিমাতে মাটি চাপানোর কাজ। দেবীকে আবাহন করা শুরু হয় কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি থেকে। ১২ জন পুরোহিত দেবী বন্দনা শুরু করেন ওই দিন থেকে। এই সময় নিত্যপুজোর ঘরে ঘট স্থাপন করে দেবীর পুজো শুরু হয় যায়। দশমীর দিন দেবীর সঙ্গে এই ঘটও বিসর্জন করা হয়। সেই সঙ্গে এমন কিছু পুঁথি পড়া হয় যা ১৭৫৭ থেকে এই পরিবারে রক্ষিত আছে। সেই সঙ্গে রামায়ণ, বেদ, চণ্ডীপাঠ এবং মধুসূদন মন্ত্র জপ করেন পুরোহিতরা।
রাধাকান্ত দেবের নির্দেশ অনুযায়ী এই বাড়িতে একমাত্র স্মৃতিতীর্থ পুরোহিতরাই পুজো করতে পারেন। আগে নাকি দেশের চার প্রান্ত থেকে পুরোহিতরা এই বাড়িতে পুজো করতে আসতেন। এখনও যিনি প্রধান পুরোহিত তাঁকে বিশেষ সম্মান সহকারে পুজোর দিন নিয়ে আসা হয়। আগে ঠাকুর তৈরি হত ঠাকুরদালান সংলগ্ন পাঠশালাতে। এখন অবশ্য ঠাকুরদালানেই ঠাকুর তৈরি হয়। এই সময় বাড়ির নিত্যদেবতা রাধাকৃষ্ণ জিউকে তুলে দিয়ে আসা হত নাটমন্দির সংলগ্ন নবরত্ন মন্দিরে। সেখানেই তার পুজো হত। কালের প্রকোপে নাটমন্দিরের এখন আর কোনও অস্তিত্ব নেই। পুজোর ক’টা দিন রাধাগোবিন্দর তাই স্থান হয় পাঠশালার উপরের তলায়।
ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় দেবীকে বেলবরণ করে চক্ষুদান করা হয়। দেবী দুর্গাকে সোনার নথ, সোনার টিপ ও সিঁদুর এই দিনই পরানো হয়। এরপরই শুরু হয়ে যায় মূর্তিপুজো। বড় তরফের সিংহের গায়ের রং সাদা। মুখ ঘোড়ার মতো। ছোট তরফের সিংহের চেহারা কিন্তু আলাদা। এর মুখ অনেকটা সিংহির মতো। এবং গায়ের রং রূপালী। ছোট তরফের সদস্য দেবাশিস কৃষ্ণ দেব জানালেন, আগে বিদেশ থেকে রুপোর পাত এনে সিংহের গা মুড়ে দেওয়া হত প্রতি বছর। সেই পাত সমেতই ঠাকুর বিসর্জন হত। এখন আর তা সম্ভব হয় না। কিন্তু সিংহের গায়ের রং এখনও প্রথা মেনে রূপালী রাখা হয়।
আরও পড়ুন: আজও ঐতিহ্য অমলিন শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয়
দুই বাড়িতেই দেবী হয় একচালার। আগে জার্মানি থেকে অর্ডার মাফিক ‘ডাক’-এর সাজ আসত প্রতিমার জন্য। এখন স্থানীয় শিল্পীরাই নিখুঁত করে সম্পূর্ণ পুরনো দিনের আদল এবং সাজপোশাক অনুযায়ী দেবীকে সাজান। এই বাড়িতে বিশাল আকৃতির সোনা-রুপোর সিংহাসন পুজোর জন্য আগে ব্যবহার করা হত। চোখধাঁধানো সেই সিংহাসনের কারুকাজ ছিল দেখার মতো। এখন অবশ্য সেই সিংহাসন আর বের করা হয় না। কাঠের উপর রুপোর পাতে মোড়া সিংহাসনে দেবীর পুজো হয়।
বড় তরফের সৌমিত নারায়ণ দেব জানালেন, অব্রাহ্মণ বলে তাঁদের দুই বাড়ির সদস্যদের ঠাকুরের জিনিস সরাসরি ছোঁয়ার অধিকার নেই। পুরুষানুক্রমিক ভাবে ওড়িশার ব্রাহ্মণরা পুজোর কাজ সম্পন্ন করেন। বাড়ির মহিলারা দূর থেকে নির্দেশ দেন শুধু। এই বাড়ির বৈশিষ্ট হল, নবকৃষ্ণ দেবের সময় থেকে যাঁরা এ বাড়িতে নিত্যপুজো, ঠাকুরদালান দেখাশোনা বা নায়েবের কাজ, এমনকি বলি দেওয়ার কাজ করতেন, তাঁদের উত্তরপুরুষরা বিগত নয় পুরুষ ধরে এই বাড়িতে রয়ে গিয়েছেন এবং একই কাজ করছেন। আগে অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর সময় কামান দেগে সন্ধিপুজোর সূচনা করা হত। গোটা কলকাতার মানুষ বুঝতেন রাজবাড়িতে সন্ধিপুজা শুরু হল। সেই সময় বিশ্বাস করা হত, ওই সন্ধিক্ষণে দেবী অসুরকে বধ করেন। অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তির জয় হয়।
আরও পড়ুন: সন্ধিপুজোয় এক মণ চালের নৈবেদ্য
এখন অবশ্য কালের গর্ভে চলে গিয়েছে সে প্রথা। এখন সন্ধিপুজো শুরুর সময় পরিবারের সদস্যরা দোনলা বন্দুক দিয়ে শূন্যে গুলি করে পুজোর শুভসূচনা করেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির বড় তরফে আগে নবমীর দিন ছাগল বলি হত। কিন্তু এক বার বলির সময় হাঁড়িকাঠ থেকে ছাড়া পেয়ে কী ভাবে একটি পাঁঠা সোজা রাধাকান্তদেবের পায়ের কাছে এসে আশ্রয় নেয়। আশ্রয়প্রার্থীকে আর মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে রাজি হননি রাধাকান্ত দেব। কিন্তু রক্ত ছাড়া যেহেতু শক্তির আরাধনা হয় না তাই পণ্ডিতদের বিধানে পাঁঠার বদলে মাগুর মাছ বলি দেওয়া শুরু হয় সে দিন থেকে। অষ্টমী নবমীর দিন এই বাড়িতে চালকুমড়ো, আখ আর মাগুর মাছ বলি দেওয়ার প্রথা সেই থেকে। রাজবাড়ির ছোট তরফে অবশ্য সাবেক নিয়ম মেনে এখনও ছাগ বলি হয়। সপ্তমী অষ্টমী নবমী, তিন দিন তিনটি ছাগল বলি দেওয়া হয় এ বাড়িতে।
শোভাবাজার রাজবাড়িতে পুজোয় অন্নভোগ হয় না। আগে ২১ রকমের মিঠাই ভোগ, ১২ রকমের নোনতা ভোগ দেওয়া হত। এখন ১২ রকমের মিঠাই ভোগ আর ৭ রকমের নোনতা ভোগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে থাকে বালুসাই, দরবেশ, মতিচূড়, ল্যাংচা, পাকুলি, খাস্তা কচুরি, শিঙারা ইত্যাদি। এখানকার খাস্তা কচুরি আর শিঙারা তৈরি হয় শুধুমাত্র ডালের পুর দিয়ে। যে সময় পুজো আরম্ভ, অর্থাৎ ১৭৫৭ নাগাদ বাঙালির হেঁসেলে আলু অপরিচিত ছিল। সেই নিয়ম মেনে এখনও পুজোর কোনও কিছুতে আলু দেওয়া হয় না। ষষ্ঠীর দিন বাড়ির মেয়ে-বউরা ব্রত রাখেন বলে এই দিন কুমড়োর ছক্কা, লুচি, মিষ্টি দই আলাদা করে শরিক সেবায়েতদের বাড়ি পাঠানো হয়। এই বাড়িতে অন্নভোগ দেওয়া হয় না বলে শুকনো চাল দেবীকে অর্পণ করা হয়। এই চালের উপর কলা, চিনি আর ক্ষীরের মণ্ড সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয়। একে বলে ‘আগা’। এই বাড়ির ছোট তরফে একটা সময়ে বিশাল বিশাল থালায় এক কিলো ওজনের সাদা রঙের মোতিচূড় লাড্ডু ভোগে দেওয়া হত, এর মধ্যে থাকত গোলমরিচ আর এলাচ। বিরাট বড় জিভেগজা, এক আঙুল সমান উঁচু জিলিপি আকারে আয়তনে দেখার মতো ছিল সেই সময়ের ভোগের আয়োজন।
আরও পড়ুন: বলির সময় পাঁঠাটি ছুটে চলে এল সামনে দাঁড়ানো রামদুলাল দে-র কাছে
বাড়ির মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় যেমন কনকাঞ্জলি দেয়, এই বাড়ির দুর্গাও কৈলাশে যাওয়ার সময় কনকাঞ্জলি দেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুই তরফেই এই প্রথা প্রচলিত আছে। আগে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা আঁচল পেতে কনকাঞ্জলি নিতেন। সোনা-রুপোর মুদ্রা, চাল, এ সব দেওয়া হত কনকাঞ্জলিতে। এখন আর সোনা-রুপোর মুদ্রা নয়, টাকাপয়সা, চাল এ সবই দেওয়া হয় কনকাঞ্জলিতে। ঠাকুরমশাই দেবীর পিছন দিকে এগুলি ফেলেন। বাড়ির বড়রা ঠাকুরের পিছনে দঁড়িয়ে সেগুলি গ্রহণ করেন। ছোট তরফে মাকে বিসর্জন দেওয়ার আগে বাড়ি থেকে রওনা করার সময় তলোয়ার পুজো করা হয়। মনে করা হয় এই তলোয়ারই সারা বছর পরিবারকে রক্ষা করবে বিপদআপদ থেকে।
শোভাবাজার রাজবাড়ির বিসর্জনের ঘটাও ছিল চমকপ্রদ। এই বাড়ির ঠাকুরদালানের উপরে রয়েছে ‘আশাসোঁটা ঘর’, অর্থাৎ অস্ত্র ঘর। পলাশির যুদ্ধের সময়ের বল্লম, তলোয়ার, গদা এখনও রাখা আছে এখানে। আগে এগুলি নিয়ে বাড়ির বাছা বাছা লোকেরা বিসর্জনের সময় দেবীর সঙ্গে যেতেন। সত্তর দশকে যখন কলকাতা অশান্ত হয় রাজনৈতিক কারণে তখন থেকে অস্ত্র নিয়ে শোভাযাত্রা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আগে নিয়ম মেনে নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়া হলেও এখন সেই প্রথা বন্ধ। তার বদলে বেলুনে শোলার তৈরি নীলকণ্ঠ বসিয়ে উত্তর মুখ করে সেই বেলুন ছেড়ে দেন বড় তরফ আর মাটির নীলকণ্ঠে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে সেটি ভাসিয়ে দেন ছোট তরফের সদস্যরা। এর পর মাঝগঙ্গায় জোড়া নৌকায় করে ঠাকুর নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: ঠাকুরবাড়ির ঈর্ষা জাগাতে বেশ কয়েক বার ঘোরানো হত শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের ঠাকুর
পুজো আসে পুজো যায়। কত কিছু যে হারিয়ে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। তবে এ বার পুজোয় বহু পুরনো এক প্রথাকে ফিরিয়ে আনায় উদ্যোগী হয়েছেন শোভাবাজার রাজবাড়ির সদস্যরা। ছোট তরফের সদস্য তীর্থঙ্কর দেব জানালেন, আগে সপ্তমীর দিন ভোরবেলা পরিবারের সদস্যরা কলাবউ স্নান করাতে যেতেন মন্ত্রোচ্চারণ আর স্তোত্রের মধ্য দিয়ে। একে বলা হত দেবীবন্দনা। চারিদিক থেকে শোনা যেত সেই পবিত্র গান। আশপাশের লোকেরা তখন যাকে বলত ‘নয়া রাস্তা’, এক দিকে সেই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এবং অন্য দিকে ‘রাজা রাস্তা’, অর্থাৎ রাজা নবকৃষ্ণ দেব লেন মুখরিত হয়ে থাকত গানে। পরবর্তী কালে বড় বড় মাইক লাগিয়ে দেওয়া হত রাস্তার চারিদিকে। কিন্তু ১৯৬৮-তে কোনও কারণে এই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। এই বছর থেকে ফের তা শুরু করা হবে। তবে, সপ্তমীর ভোরে নয়, এ বার তা হবে পঞ্চমীর দিন বিকেলে। যুগের প্রয়োজনে কিছু নতুনত্ব আনলেও প্রার্থনার মূল সুর থাকবে পুরনোই।
ছবি: সংগৃহীত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy