Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
বলরাম দে স্ট্রিটে দত্ত বাড়ি
Durga Puja Preparations

সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, তিনদিনই কুমারী পুজো হয় এখানে

তখন দত্ত বাড়ির পুরুষ ও নারীরা সরাসরি পুজোর ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতেন না। মেয়েরা শুধুমাত্র উপর থেকে অথবা চিকের আড়াল থেকে একঝলক মাতৃমুখ দেখেতে পারতেন।

পুজোর তিনদিন এভাবেই কুমারী পুজো হয় দত্ত বাড়িতে।

পুজোর তিনদিন এভাবেই কুমারী পুজো হয় দত্ত বাড়িতে।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ১৩:৩৯
Share: Save:

সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। হাটখোলা দত্ত বাড়িতে মহা ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়। সেই সময় ওই বাড়ির এক ছেলে, নামজাদা অ্যাডভোকেট শ্যামলধন দত্ত বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি একদিন কোনও ব্যক্তিগত কারণে গিরিশপার্কের কাছে এক বিরাট বাড়িতে চলে এলেন। তখনই পুরো বাড়িটা কেনা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। বাড়ির বারমহলটুকু কিনে সেখানে শুরু করলেন বসবাস।১৮৮৩ সালের ঘটনা এটি।

তখন থেকেই নিয়মিত দুর্গাপুজো শুরু করেন তিনি। সেই সময় পুরো এলাকাটাই ছিল সেনদের। বিপত্নীক, দুই কন্যার পিতাকে সব ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে আশপাশের পরিবারগুলি। তবে তখন পরিবারের পুরুষ ও নারীরা কিন্তু সরাসরি পুজোর ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতেন না। মেয়েরা তো শুধুমাত্র উপর থেকে অথবা চিকের আড়াল থেকে একঝলক মাতৃমুখ দেখেতে পারতেন। অন্দরের চৌকাঠও ডিঙানোর অনুমতি ছিল না তাঁদের।

তখন শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়ে থাকা বিরাট পরিবারের আত্মীয়স্বজনরা দায়িত্ব নিয়ে পুজো সম্পন্ন করাতেন। এখন অবশ্য সেই অবস্থা নেই আর। ভেঙে যাওয়া পরিবার ব্যবস্থা, দেশভাগ সব কিছু পাল্টে দিয়েছে অনেক। এখন পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণ,কর্মব্যস্ততা পুজোকে আলাদা মাত্রা দেয়।

আরও পড়ুন: ষষ্ঠীর দিন আমিষ খেতেই হয় বাড়ির মেয়েদের​

আগে জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামোতে প্রথম মাটি চাপানো হত। দুই ধরনের শিল্পী আসতেন দেবী মূর্তি গড়তে। একদল আসতেন মাটি, বাঁশ এসবের কাজ করতে। অন্যদল আসতেন কৃষ্ণনগর থেকে। এখন অবশ্য এক শিল্পীই সম্পূর্ণ কাজ করেন। মঠচৌড়ী পদ্ধতিতে ঠাকুর তৈরি হয় এখানে। মঠচৌড়ী, অর্থাৎ তিনটি চালা থাকে ঠাকুরের মাথায়। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ ছাড়াও ঠাকুরের পাশে ছোট ছোট কুঠুরিতে শিব এবং রামের মূর্তি রাখা থাকে।

এই পরিবারে দুর্গামূর্তির সব থেকে বড় বৈশিষ্ট হল, এখানে দেবীকে আলাদা করে কাপড় পরানো হয় না। অপূর্ব মুন্সিয়ানায় ঠাকুরের গায়ে রং তুলি দিয়ে পোশাক আঁকা হয়। আগে কৃষ্ণনগর থেকে বংশানুক্রমিকভাবে শিল্পীরা এই কাজ করতে আসতেন।

এই পরিবারের প্রবীণ সদস্য দেবাশিস ঘোষ এখনও মনে করে বলেন, তুলির নিঁখুত টানে প্রথমে গোলাপী, ময়ূরকণ্ঠী, তারপর একে একে অন্য রংগুলি দেবীর শিউলি ফুলের বোঁটার মতো গায়ের রঙের সঙ্গে কী ভাবে মিশে যেত। শরতের আলো তেরছাভাবে যখন এসে পড়ত ঠাকুরদালানে, সুসজ্জিতা দেবী ঝলমল করে উঠতেন। দত্তবাড়িতে দেবীর সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র তো বটেই অসুরের অস্ত্রও রূপোর এখানে। পুজোর সময়ে সোনার গয়নায় দেবীকে সাজান হয়। এই পরিবারে সিংহের মুখ হয় ঘোড়ার মুখের মতো।

আরও পড়ুন: শরতের এই-মেঘ এই-বৃষ্টির মতো প্যান্ডেলের পারিজাতকে ভাল লাগার শুরু​

পুজোর আগে কৃষ্ণা নবমীর দিন থেকে শুরু হয় ঠাকুরের আবাহন। এই দিন ঘট স্থাপন করা হয়। পাঁচ জন ব্রাহ্মণ চণ্ডীপাঠ করেন,এক জন দুর্গানাম জপ করেন, একজন ব্রাহ্মণ জপ করেন মধুসূদন নাম। পুজোর আগে টানা ১৫ দিন ধরে চলে চণ্ডীপাঠ। ষষ্ঠীর দিন থেকে একজন ব্রাহ্মণই চপাঠ করেন। এই পরিবারে দেবীর বোধন হয় বাইরে।

নারায়ণের কাছ থেকে দেবীপুজোর অনুমতি নিয়ে তারপর পুজো শুরু হয়।সপ্তমী অষ্টমী নবমী, তিনদিনই কুমারী পুজোহয় এখানে। সেই সঙ্গে হয় সধবা পুজো। দেবীকে মা এবং কন্যা এই দুই রূপেই পুজো করা হয়। ভোগের সামগ্রীর মধ্যে সাত রকমের মিষ্টি আর তিন রকমের নোনতা প্রধান।

রাধাবল্লভী, খাস্তা কচুরী আর পদ্ম নিমকি। লেডিকেনি দরবেশ, নারকেল নাড়ু , নানা রকম সন্দেশ এগুলি থাকে মিষ্টির মধ্যে। ষষ্ঠীর দিন ভিয়েন বসে বাড়িতে পুজোর সামগ্রী তৈরির জন্য চলে নবমী পর্যন্ত। এখানে দেবীর অন্নভোগ না হলেও দশমীর দিন দর্পণে ঠাকুর বিসর্জনের পর খিচুড়ি হয় প্রতি বছর। এরপর হয় দরিদ্র নারায়ণ সেবা।

এই পরিবারে ঠাকুর বিসর্জনের আগে সিঁদূর খেলা দেখার মতো সুন্দর হয়। বিসর্জন দিয়ে ফিরে এসে যেখানে দেবীপ্রতিমা, সিঁদূর খেলার সময় আনা হত সেখানে গরু পুজো করতেন পরিবারের সদস্যরা। কালের নিয়মেএই প্রথাও অবশ্য আর নেই। তবে পুরনো দিনের কিছু ঐতিহ্য ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে নতুন প্রজন্ম। আগে পুজোর সময় যাত্রা নাটক আর গানের আসর বসত ঠাকুরদালানের সামনে। এই প্রজন্ম সেই রেওয়াজ একটু অন্যভাবে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে গত কয়েক বছর ধরে। বাড়ির বড়রা আর কুচো কাচারা মিলে পাড়ার সবাইকে নিয়ে ভারি সুন্দর অনুষ্ঠান করে পুজোর দিনগুলিতে।

ছবি সৌজন্য: লেখক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE