Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Durga Puja Preparations

ঠাকুরবাড়ির ঈর্ষা জাগাতে বেশ কয়েক বার ঘোরানো হত শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের ঠাকুর

শিবকৃষ্ণ দাঁ-র সময়কাল ছিল জোড়াসাঁকো দাঁ পরিবারের স্বর্ণযুগ। পারিবারিক লোহা, কয়লা আর হার্ডওয়ারের ব্যবসায় প্রভূত লাভ করেন তিনি।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ১৮:৫৪
Share: Save:

কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘কলকাতার বারোইয়ারী পূজা’র তিনি ছিলেন প্রধান চরিত্র। তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছিল ‘বীরকৃষ্ণ দাঁ কেবলচন্দ্র দাঁ-এর পুষ্যিপুত্তুর। বীরকৃষ্ণ দাঁ শ্যামবর্ণ বেঁটে খেঁটে রকমের মানুষ। নোয়াপাতি রকমের ভুঁড়ি, হাতে সোনার তাগা, কোমরে মোটা সোনার গোট, গলায় এক ছড়া সোনার দু’নর হার, আহ্নিকের সময় খেলবার তাসের মত চ্যাটালো তাসের কষ্টিকবচ পরে থাকেন।’

এই বীরকৃষ্ণই ছিলেন জোঁড়াসাকো দাঁ পরিবারের শিবকৃষ্ণ দাঁ। লেখার প্রয়োজনে অনেক সময়েই তিনি তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিদের নাম পরিবর্তন করেছিলেন। সেই সময়ে দুর্গাপুজোতে কী রকম জাঁকজমক আর খরচ হত,‘হুতুম প্যাঁচার নকশা’, ‘কলকাতার বারোইয়ারী পূজা’ সহ বেশ কিছু বইতে তার বর্ণনা দিয়েছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।

১৮৪০-এ এই বংশের গোকুলচন্দ্র দাঁ শিবকৃষ্ণ দাঁ কে দত্তক নেন। সেই বছরই মহা ধূমধাম করে তিনি শুরু করেন দুর্গাপুজো। শিবকৃষ্ণ দাঁ-র সময়কাল ছিল জোড়াসাঁকো দাঁ পরিবারের স্বর্ণযুগ। পারিবারিক লোহা, কয়লা আর হার্ডওয়ারের ব্যবসায় প্রভূত লাভ করেন তিনি। সেই সময়ে আসানসোল এলাকায় বেশ কিছু কোলিয়ারি কিনে সেইখানে রেললাইন তৈরির বরাত পান। লাভের টাকার একটা বড় অংশ শিবকৃষ্ণ দুর্গাপুজোয় ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন। শিবকৃষ্ণ দাঁ সাজগোজ করতে বড় ভালবাসতেন। কালীপ্রসন্ন সিংহের ভাষায়‘বীরকৃষ্ণবাবু ধূপছায়া চেলীর জোড় ও কলার কট প্লেটওয়ালা কামিজ ও ঢাকাই ট্যারচা কাজের চাদরে শোভা পাচ্ছেন রুমালটি কোমরে বাঁধা আছে...!!’

আরও পড়ুন: ষষ্ঠীর দিন আমিষ খেতেই হয় বাড়ির মেয়েদের​

এহেন বাবু শিবকৃষ্ণ ঠিক করলেন তিনি দুর্গা মাকেও মনের মতো করে সাজাবেন। বলা হয়, সেই সময়ে তিনি ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে বিশেষ কাজ করা অলঙ্কার ও পোশাক আনালেন ঠাকুরকে পরানোর জন্য। সেই পোশাকে ভারী সোনালি রুপোলী জরির কাজ আর কিছু দামি পাথর খচিত ছিল। ওই আমলে সেই রকম পোশাক কেউ কখনও দেখেনি। পোশাক এবং দেবীর অলঙ্কার এতটাই সুন্দর আর মনোমুগ্ধকর ছিল যে তখন মুখে মুখে চালু হয়ে গিয়েছিল যে দেবী মর্ত্যে এসে প্রথম দাঁ বাড়িতে পোশাক এবং অলঙ্কার পরে সাজেন। তারপর অন্য জায়গায় যান।

সেই পোশাকই কিন্তু এখনও দেবী পরেন এই বাড়িতে। এছাড়াও সেই সময় দেবীর চালচিত্রের বর্ডারের কিছু অংশ জার্মানি থেকে আনা হয়েছিল বলে জানালেন পরিবারের প্রবীণ সদস্য অসীম দাঁ। চালচিত্র উজ্জ্বল এবং ঝকঝকে করার জন্য তামা ও পিতল দিয়ে তৈরি একরকম ধাতুর পাত শিবকৃষ্ণ দাঁ নিয়ে এসেছিলেন। প্রতিমার চালচিত্রে আজও এই পাত ব্যবহৃত হয়। এই পরিবারে ঠাকুরের জন্য যে ছাতা ব্যবহার করা হয় সেটিও অসাধারণ বলে জানালেন অসীমবাবু। গাঢ় মোলায়েম ভেলভেটের কাপড়ে সোনা এবং রূপোর জরির কাজে ঠাসা এই ছাতাটি কলাবৌ স্নান করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

আরও পড়ুন: সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, তিনদিনই কুমারী পুজো হয় এখানে​

শাস্ত্রীয় বিধি এখনও কঠোরভাবে মানা হয় এই বাড়িতে। রথের দিন গড়ানকাঠ পুজোর মধ্য দিয়ে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। এরপর শুরু হয় কাঠামো তৈরির কাজ।জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামোতে দেবীর মস্তক স্থাপন করা হয়। অন্য দেবদেবীর মস্তক স্থাপন হয়ে পরে।পটুয়ারা তৈরি করেন দেবীর চালচিত্র। দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠার সময় তেরোটি শাড়ি ও তেরোটি কাঁসার পাত্র দেওয়া হয়। এছাড়াও একশো আটটি পেতলের প্রদীপ সাজানো হয়। এই বাড়ি যেহেতু বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত এখানে বলি প্রচলিত নেই। অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো হয় ধূমধাম করে। আগে নবমীর দিন এই বাড়ির বিরাট ঠাকুরদালানের সামনে অথবা দোতলার বৈঠকখানার ঘরে গানবাজনার আসর বসত। শচীনদাস মতিলাল, অসিতবরণরা আসতেন প্রতিবছর। পরিবারের সদস্যরা তো বটেই, আশপাশের বহু মান্যগণ্য মানুষ আসতেন এই অনুষ্ঠান দেখতে।

এই পরিবারের কীর্তিচন্দ্র দাঁ ছিলেন অত্যন্ত শৌখিন এবং নাটক সঙ্গীতের বিশেষ সমঝদার। তাঁর সময়ে এবং পরবর্তীকালে রথের সময় চিৎপুরের যাত্রাপালাগুলির মহরত হত এই বাড়িতে। তারপর বুকিং শুরু হত বিভিন্ন জায়গায়। পুজোর সময়েও নাটক ও যাত্রা হত নিয়মিত। দোতলার আর্চের মতো বারান্দা থেকে মেয়েরা অনুষ্ঠান দেখতেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে দাঁ বাড়ির রেষারেষি ছিল সাঙ্ঘাতিক। ওই বাড়ির ব্রাহ্ম সংস্কৃতির ছাপ কোনওমতেই যাতে এই বাড়িতে না পরে সেই বিষয়ে সচেষ্ট থাকতেন এই পরিবারের লোকেরা।

এই বিষয়ে দশমীর দিনের একটি মজার গল্প প্রচলিত আছে। প্রতিমা বিসর্জনের সময় ৪০ জন বাহক দেবীকে কাঁধে করে বিসর্জন দিতে যেতেন। বাহকদের প্রতি নির্দেশ ছিল তাঁরা যেন গঙ্গায় যাওয়ার আগে ঠাকুরবাড়ির সামনে দেবীকে বেশ কয়েকবার ঘুরিয়ে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের ঈর্ষা উদ্রেক করিয়ে তারপর গঙ্গায় নিয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সোনালী দিনগুলি চলে যায়, সেই রেষারেষিও আর অবশিষ্ট থাকে না, কিন্তু প্রথাটা রয়ে যায়। এখন অবশ্য দেবীকে আর বাহকেরা নিয়ে যান না। লরি যায় গঙ্গার ঘাটে। ফলে ঠাকুরকে আর ঘোরানোও হয় না আর এক জমিদার বাড়ির নাকের ডগায়। আগেকার জাঁকজমক জৌলুস, সময়ের সঙ্গে সবই অস্তমিত। তা-ও অতীত-বর্তমান ঐতিহ্য আর নিষ্ঠা আজও মিলেমিশে যায় জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়িতে।

ছবি সৌজন্য: লেখক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE