Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
Durga Puja Preparations

এখনও কামান দেগে পুজো শুরু হয় নরসিংহ চন্দ্র দাঁ পরিবারের

স্থানীয় লোকের মুখে মুখে এ বাড়ির নাম ‘বন্দুকওয়ালা’ বাড়ি। কিন্তু কেন?

 দাঁ বাড়ির পুজো।

দাঁ বাড়ির পুজো।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৮ ১৯:২৮
Share: Save:

জনবহুল রাস্তা, গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ি আর দোকানের সারির মধ্যে এই বাড়িটাকে দেখলে চট করে অন্য বনেদি বাড়ি থেকে হয়তো আলাদা করা যাবে না। কিন্তু এ বাড়ির ইতিহাস অন্য কথা বলে। স্থানীয় লোকের মুখে মুখে এ বাড়ির নাম ‘বন্দুকওয়ালা’ বাড়ি। হবে নাই বা কেন? বন্দুকের ব্যবসায় জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ির বাসিন্দারা একসময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ১৮৩৪ এ বাঁকুড়ার কোতুলপুরের বাসিন্দা দয়ারাম দাঁয়ের উত্তরপুরুষ নরসিংহ দাঁ অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলেন বন্দুকের ব্যবসা। ধর্মতলায় দু’টি দোকান খুললেন তিনি। একটি নিজের নামে, অন্যটি ছেলে আশুতোষ দাঁয়ের নামে। কোম্পানির আমলে শুরুটা খুব সহজ না হলেও দেশীয় রাজারাজড়া আর জমিদারদের কাছে এঁদের বন্দুকের চাহিদা ছিল খুব। সুদৃশ্য দেখনদার বন্দুকের জন্য রাজারাজড়াদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত রীতিমতো। পরবর্তীকালে ইংরেজরা হয়ে ওঠেন দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার। ব্যবসায় প্রভূত অর্থলাভের পর নরসিংহ দাঁ সিপাহী বিদ্রোহের দু’বছর পর, অর্থাৎ ১৮৫৯-এ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ধুমধাম করে শুরু করলেন দুর্গাপুজো। বন্দুকের ব্যবসা বাড়ির পুজোর রীতিনীতির উপর ছাপ ফেলেছিল বহুলাংশে। এখনও পুজোর সেই সাবেক ধারা অব্যাহত।

রথের দিন রথপুজোর পর গরান কাঠ পুজোর মধ্য দিয়ে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রতিমা তৈরির সময় এই কাঠ ঠাকুরের দেহের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিপদের দিন দেবীর বোধন হয় এই বাড়িতে। সপ্তমীর দিন কলাবৌ স্নান করিয়ে নিয়ে আসার পর কুলদেবী লক্ষ্মীকে ঠাকুরঘর থেকে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। আগে নবপত্রিকা স্নানের সময় বন্দুক এবং তলোয়ারধারী প্রহরী যেত কলাবৌয়ের সঙ্গে। এখন অবশ্য আর তা হয় না। লক্ষ্মীনারায়ণ পুজোর মধ্য দিয়ে সপ্তমীর পুজো শুরু হয়। সুন্দর কারুকাজ করা লোহার খিলান দেওয়া ঠাকুরদালানে ডাকের সাজ পরিহিতা দেবীর রূপ আলো করে রাখে চারিদিক। দাঁ বাড়িতে দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না। লুচি ভোগ দেওয়া হয়। পঞ্চমীর দিন ভিয়েন বসে বাড়িতে। সে দিন থেকেই নানা রকম মিষ্টি তৈরি হওয়া শুরু হয়। ভোগে পাঁচ রকম মিষ্টি, নোনতা, দই দেওয়া হয়। এ ছাড়াও দেওয়া হয় পান্তুয়া, গজা, মিহিদানা।

পুজো শুরুর দিন থেকেই এই বাড়ির অষ্টমীপুজো স্বাতন্ত্রে ভরপুর। আগে সন্ধিপুজো যাতে একদম ঠিক সময়ে শুরু করা যায় তার জন্য অবজারভেটরি থেকে ঘড়ি মিলিয়ে আনা হত প্রতি বার। শুধুমাত্র সন্ধিপুজোর জন্যই ব্যবহার করা হত ঘড়িটি। পুজো শেষে পরের বছরের জন্য তুলে রাখা থাকত। এখন আর সে প্রথা নেই। ঘড়িও আর মিলিয়ে আনা হয় না অন্য জায়গা থেকে।

আরও পড়ুন: সন্ধিপুজোয় এক মণ চালের নৈবেদ্য​

তবে সাবেক কালের মতোই আজও পুজো শুরুর ঠিক আগে ‘উইনচেস্টার রিপিটিং আর্মস’ কোম্পানির ১৭ ইঞ্চির ছোট্ট কামান দাগা হয়। সেই সঙ্গে করা হয় গান ফায়ার। নরসিংহ দাঁ পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, এই মহা সন্ধিক্ষণে দেবী আসেন তাঁদের বাড়িতে। দেবীকে স্বাগত জানাতে ‘জয় মা’ বলে ধ্বনি দেন তাঁরা। দেবী যাতে অবাধে বাড়িতে আসতে পারেন সেই জন্য এই সময়ে বাড়ির সমস্ত দরজা জানলা খুলে দেওয়া হয়। অষ্টমীর আরতি চলাকালীনও বেশ কয়েক বার শূন্যে গুলি চালানো হয়। প্রথা মেনে নবমীর দিন কুমারী পুজো হয় এই বাড়িতে। এর পর হোমযজ্ঞ এবং পুজোর সমস্ত আচার অনুষ্ঠান শেষে নবমীর দিন রাতে মৎস্যমুখ করেন বাড়ির সদস্যরা। দশমীর দিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘটে ঠাকুর বিসর্জনের পর ব্যবসার সূত্রে ‘যাত্রা’ করেন বাড়ির সদস্যরা। ‘যাত্রা’ অর্থাৎ ঠাকুর বাড়িতে থাকাকালীন পুজোর ফুল বিল্বপত্র দোকানে গিয়ে সামান্য কিছু বিক্রিবাটা করা যাতে সারা বছর দেবীর কৃপায় ব্যবসায় লাভ হয়। দশমীর দিন এই বাড়ির পুরুষেরা মহিলাদের কনকাঞ্জলি দেন। পুজো শেষে বাড়ির মহিলারা আঁচল পেতে দাঁড়ান। বাড়ির পুরুষেরা পিছন দিকে চাল কড়ি পান সুপুরি, আরও অন্যান্য জিনিস ছুড়ে দেন। মহিলারা কনকাঞ্জলি গ্রহণ করে কোঁচড়ে করে ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে সেই জিনিস এক বছর যত্ন করে রাখেন। প্রতিমা বিসর্জনের জন্য যখন দেবীকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসা হয় সেই সময় তাঁকে সম্মান জানাতে গান স্যালুট দেন বাড়ির সদস্যরা। আগে ওড়িশা থেকে আসা বাহকেরা কাঁধে করে ঠাকুর নিয়ে যেতেন। ঠাকুরের সঙ্গে দু’দিকে তিন জন করে মশাল বাহক থাকতেন। সেই সঙ্গে থাকতেন সশস্ত্র রক্ষীরা। সব মিলিয়ে অদ্ভুত আর মায়াময় এক পরিবেশের সৃষ্টি হত। ঘাটে প্রস্তুত থাকত বিশমনি নৌকো। নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে সেই নৌকো নিয়ে মাঝগঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হত দেবীকে।

আরও পড়ুন: বলির সময় পাঁঠাটি ছুটে চলে এল সামনে দাঁড়ানো রামদুলাল দে-র কাছে​

এখন আর সে দিন নেই। পুজোর জন্য গরান কাঠই পাওয়া যায় না। আগামী বছর থেকে প্রথা ভেঙে হয়তো অন্য কাঠে কাজ চালাতে হবে। ‘বিশমনি’ নৌকাই বা এখন আর কোথায়? কোথায় বা সেই বাহকেরা যাঁরা মাকে গঙ্গায় নিয়ে যেতেন? মশালের লালচে আলোয় যাঁদের ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে পথচারীদের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হত। সভয়ে পাশ কাটিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে মায়ের উজ্জ্বল মূর্তির দিকে চোখ পড়ত তাঁদের। সব দোলাচল কেটে প্রশান্তিতে ভরে যেত মন। সে সব কিছুই নেই এখন আর। তবে সব গিয়েও কিছু বোধহয় থেকে যায় আগের মতো। এই পরিবারের আরাধ্য দেবীর মুখ আজও বড় উজ্জ্বল, বড় পবিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE