গত জুলাইয়ে বিষ্ণুপুরের একটি স্কুলের ক্লাস ওয়ানের একটি বাচ্চাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। বাচ্চাটির অপরাধ, সে এইচআইভি পজিটিভ। বাবা-মা এইচআইভি পজিটিভ হওয়ায় বাচ্চাটির শরীরেও এইচআইভি বাসা বেধেছে। সে কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় অন্য অভিভাবকেরা আপত্তি করেন। যার ফলে বাচ্চাটির স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ পাঁচ মাস লড়াইয়ের পর কয়েক দিন আগে থেকে বাচ্চাটি আবার স্কুলে যেতে পারছে।
পাশাপাশি বসলে বা একসঙ্গে খেলাধুলো করলে সেই বাচ্চার থেকে অন্য বাচ্চার শরীরেও এডস-এর ভাইরাস ঢুকবে, সেই আতঙ্ক থেকেই বাচ্চাটিকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। অনেক প্রচারের পরেও এডস-নিয়ে এ রকমের ভ্রান্ত ধারণা আজও অনেকেই পোষণ করেন। আর এ-ও ধরে নেওয়া হয়, এডস-এর ভাইরাস শরীরে ঢুকলেই অবধারিত মৃত্যু।
বাস্তব হল, ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে এডস-এর ভাইরাস কখনওই ছড়ায় না। আবার এড্স মানেই মৃত্যু নয়।
মূলত চারটি উপায়ে এডস-এর ভাইরাস আমাদের শরীরে আসে।
১) অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গ।
২) ড্রাগ নেওয়ার সময়ে অনেকে মিলে একই সূচ ব্যবহার করলে।
৩) এইচআইভি পজিটিভ ব্যাক্তির রক্ত অন্যের শরীরে দেওয়া হলে।
৪) গর্ভবতী মা এইচআইভি পজিটিভ হলে বাচ্চারও এডস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
উপরের এই চারটি কারণ ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে এডস-এর ভাইরাস সংক্রমিত হয় না। হাঁচি, কাশি থেকে এই ভাইরাস ছড়ায় না। একই স্কুলে পড়লে, পাশাপাশি বসলে, এক সঙ্গে খেলাধুলো বা করমর্দন করলে তো নয়ই। এমনকী, এক ঘরে থাকলেও ছড়ায় না। এডস-এর ভাইরাস জলবাহিত নয়। তাই একই পুকুর বা সুইমিং পুলে স্নান করলে এই ভাইরাস ছড়ায় না।
আমাদের দেশে এডস-এর ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছড়ায় অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গের মাধ্যমে। অন্তত ৯৫% ক্ষেত্রে এ ভাবেই রোগ ছড়ায়। আর ৩-৪% ক্ষেত্রে এই ভাইরাস ছড়ায় ড্রাগ নেওয়ার নিডল থেকে। আগে রক্তদান থেকেও ছড়াত। কিন্তু বর্তমানে পরীক্ষা করে তবেই অন্যের শরীরে রক্ত দেওয়া হয় বলে এই পদ্ধতিতে এডস-এর ভাইরাস খুব কমই ছড়ায়।
অসুখটা কী
এডস-এর ভাইরাসের নাম হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস। এই ভাইরাস নিজে কোনও রোগ তৈরি করে না। শরীরের কোনও অঙ্গকে বিকল করে দেয় না। শুধু শ্বেত রক্তকণিকার সিডি-৪ লিম্ফোসাইট কোষকে খেয়ে ফেলে। এই কোষই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। যার ফলে অন্য কোনও ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া শরীরে ঢুকতে বাধা পায়। এইচআইভি ভাইরাস এই কোষকে খেয়ে নেওয়ায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকে। তখন যে কোনও ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া সহজে শরীরে বাসা বাঁধে। প্রথমে জ্বর, পেট খারাপ, সর্দিকাশির মতো ছোটখাট অসুখ দিয়ে শুরু হয়। পরে নানা জটিল রোগ বাসা বাঁধতে থাকে।
মুশকিল হল, এই ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা খুব আস্তে আস্তে কমে। তাই প্রথম দিকে কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না। একে বলে উইন্ডো পিরিয়ড। মোটামুটি ভাবে পাঁচ-সাত বছর পর গিয়ে ব্যাপারটা টের পাওয়া যায়। তখন হয়তো জ্বর হল। ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও সেই জ্বর কমছে না। এক জন যৌনকর্মীর শরীরে হয়তো এই ভাইরাস ঢুকেছে। প্রথম দিকে কোনও রকম উপসর্গ না থাকায় তিনি নিজেও ব্যাপারটা জানেন না। পাঁচ বছর পর গিয়ে দেখা গেল তাঁর জ্বর বা অন্য কোনও অসুখ হয়েছে। যা সারতেই চাইছে না। সে সময়ে রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ল এইচআইভি-র উপস্থিতি। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যেই হয়তো তাঁর হাজারখানেক ক্লায়েন্টের সঙ্গে কোনও রকম সুরক্ষা না নিয়ে যৌনসংসর্গ করেছেন। ফলে তাদের শরীরেও সেই ভাইরাস ঢুকে পড়েছে। এ ভাবেই ছড়ায় এডস।
ভাইরাসের উপস্থিতি কী ভাবে টের পাওয়া যায়
কারও হয়তো পেট খারাপ হয়েছে। কিন্তু ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও কিছুতেই সারছে না। মাসখানেক ধরে চলছে। বা কারও জ্বর একটানা মাস দেড়েক ধরে চলছে। বা কয়েক মাসের মধ্যে ওজন ভীষণ ভাবে কমে গিয়েছে। তখন দেখা হয়, সেই ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে কি না।
যৌনকর্মী বা যারা নিয়মতি ড্রাগ নেয় বা অন্য কোনও ঝুঁকিসম্পন্ন মানুষের প্রতি তিন মাস অন্তর রক্ত পরীক্ষা করলে ভাইরাস আছে কি না বোঝা যায়। গর্ভবতী মায়ের বা অন্য কারও অস্ত্রোপচারের আগে রুটিন টেস্ট করালে এডস-এর ভাইরাস আছে কি না বোঝা যায়।
কিছু দিন আগে মণিপুর থেকে এক জন এসেছিলেন কলকাতায় নাকের অস্ত্রোপচার করাতে। অস্ত্রোপচারের আগে রুটিন টেস্ট করাতে গিয়ে ধরা পড়ল তিনি এইচআইভি পজিটিভ। পরে সেই ব্যক্তির হিস্ট্রি নিয়ে জানা গেল, তিনি নিয়মিত ড্রাগ নেন নিড্লর মাধ্যমে। নিজেও জানতেন না শরীরে কখন বাসা বেধেছে এইচআইভি ভাইরাস।
এইচআইভি ভাইরাস মানেই এডস নয়
কারও রক্তে এইচআইভি ভাইরাস পাওয়া গেলেই সে এডস আক্রান্ত নয়। এডস তখনই হয়, যখন শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে নানা রোগ বাসা বাঁধতে থাকে।
এইচআইভি পজিটিভ হলে
কাছাকাছি হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয় সেই ব্যক্তি সত্যি সত্যি এইচআইভি আক্রান্ত কি না। যদি পজিটিভ হন, তবে নিকটবর্তী এআরটি ক্লিনিকে পাঠানো হয় পরবর্তী সমস্ত পরীক্ষা ও বিনামূল্যে সব ওষুধ পাওয়ার জন্য। এ জন্য তাঁকে নাম নথিভুক্ত করতে হয়। পাশাপাশি, তাঁকে পুরোপুরি পরীক্ষা করে দেখা হয় শরীরে অন্য কোনও রোগ বাসা বেঁধেছে কি না। দরকারে সে রোগের চিকিৎসা শুরু করা হয়।
এক সময় ধারণা ছিল এডস মানেই মৃত্যু। কিন্তু মোটেই তা নয়। নিয়মিত চিকিৎসা করালে এডস রোগী বহু দিন সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকেন। এ জন্য রোগীকে নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। প্রতি মাসে এই ওষুধ সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। মুশকিল হল, ওষুধ খেয়ে ভাল হয়ে যাওয়ার পর অনেক রোগীই আর ওষুধ খেতে চান না। তাঁদের প্রশ্ন, ভাল হয়ে গেছি। তবে আর ওষুধ কেন? তা ছাড়া এই রোগে বাইরে থেকে যে হেতু কিছু দেখা যায় না, তাই রোগীরা ধরেই নেন, তিনি পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু ওষুধ বন্ধ করলে যে এইচআইভি ভাইরাস আবার রক্তকণিকার সিডি-৪ লিম্ফোসাইট কোষকে খেতে খেতে শেষ করে দেবে, আর পাশাপাশি শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমতে থাকবে, সেটা তাঁরা বুঝতে পারেন না। প্রেসার, সুগারের মতো এইচআইভি-র ওষুধ জীবনভর খেয়ে যেতে হয়। তবেই রোগী সুস্থ থাকবেন। ওষুধ বন্ধ করে দিলে তার ফল মারাত্মক হয়।
• বর্তমানে নানা রকম প্রচার ও সচেতনতা থেকে এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণের হার অনেক কমেছে। ন্যাকো-র হিসেব মতো এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে এইচআইভি ভাইরাস রয়েছে কমবেশি ১,৫০,০০০-১,৮০,০০০ মানুষের শরীরে। এই সংখ্যাটি নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কারণ ধরেই নেওয়া হয়, ভাইরাস নিয়েও অনেকে আছেন, যাঁদের কথা আমরা জানি না।
• পশ্চিমবঙ্গে এখন এডস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২৫,০০০-৩০,০০০।
• পশ্চিমবঙ্গে আগে প্রতি ১০০ জন যৌনকর্মীর মধ্যে ৬ জনের শরীরে ভাইরাস পাওয়া যেত।
• এখন সেই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১ জন।
প্রতিবেদন রুমি গঙ্গোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy