রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব উষ্ণায়নের নানা সমস্যা নিয়ে উদ্বেগটুকু ছাড়া, কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশ্বব্যাপী হিমবাহের গলন নিয়েও বিশেষ আলোচনা হয়নি। পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ১১ শতাংশ হিমবাহ-আবৃত। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ হিমবাহ অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডে, বরফের পরিমাণ সেখানে সর্বাধিক। একে মহাদেশীয় হিমবাহ বলা হয়। মহাদেশীয় হিমবাহগুলি ১ কোটি ৩০ লক্ষ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে রয়েছে। নিম্ন অক্ষাংশ এলাকার মধ্যে হিমালয়-সহ, পূর্ব আফ্রিকা, মেক্সিকো, নিউ গিনি ও ইরানের পর্বতে হিমবাহ আছে। সাত হাজারেরও বেশি হিমবাহের মধ্যে মেরু অঞ্চল ছাড়া পাকিস্তানে আছে সবচেয়ে বেশি হিমবাহ-বরফ।
পৃথিবীতে চারটি মহাশৈত্য যুগ এবং অন্তর্বর্তিকালে মহাউষ্ণ যুগ এসেছে। প্রতিটি যুগের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চলেছে একাধিক নানা মাত্রার শীতল ও উষ্ণ প্রবাহচক্র। শেষ মহাশৈত্য যুগ শুরু হয়েছে কুড়ি লক্ষ বছর আগে, এখনও চলছে। পরীক্ষায় জানা গেছে, এই মহাশৈত্য যুগে যে অন্তর্বর্তিকালীন শীতল ও উষ্ণ প্রবাহচক্র চলেছে তাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা গড় তাপমাত্রার তুলনায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে বা কমে। শেষ শীতল প্রবাহ শেষ হওয়ার পর গত পনেরো হাজার বছর ধরে পৃথিবী গরম হতে শুরু করেছে। গরম শুরু হতেই হিমবাহের পশ্চাদপসরণ দেখা গেছে। ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে পৃথিবীর সব সুউচ্চ পর্বতেই হিমবাহের পিছু হটা লক্ষ করা গেছে, হিমবাহ থেকে নির্গত নদীর সঙ্গে ভেসে আসছে অনেক বেশি করে পাথর ও বালি-মাটি। হিমালয়ের হিমবাহগুলির পিছনে সরে যাওয়ার গতি এলাকা অনুসারে ভিন্ন। যেমন, হিন্দুকুশ পর্বতে হিমবাহের পশ্চাদপসরণ-গতি বছরে ১৫ মিটার। উত্তরাখণ্ডে ডোকরিয়ানি হিমবাহ বছরে ১৫-২০ মিটার পিছোচ্ছে; ১৯৯৫ থেকে চোরাবাড়ি হিমবাহের পিছোনোর গতি ৯-১১ মিটার প্রতি বছরে।
হিমালয় থেকে আল্পস, গ্রিনল্যান্ড থেকে অ্যান্টার্কটিকা, সর্বত্র গরমের চোটে হিমবাহ-বরফ গলছে, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে মধ্য এশিয়ার পর্বতের হিমবাহ স্থিতাবস্থায়, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব নেই। বিজ্ঞানীমহলে এ এক বিস্ময়। তাঁরা সেখানে পরীক্ষারত, তাজিকিস্তানে বরফে ১০৫ মিটার গর্ত করে বরফের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তা থেকে গত এক হাজার বছরের জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাবে বলে আশা। কারাকোরাম, তিয়ান শান, কুনলুন ও তাজিকিস্তানের পামির পর্বতের উঁচু চূড়ায় হাজার হাজার কিমি জুড়ে হিমবাহ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, গত পঁচিশ বছরে এ সব এলাকায় হিমবাহের বরফ গলা দূরস্থান, বরং নতুন করে বরফ জমছে। মেরু অঞ্চলের তুলনায় মধ্য এশিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান অপেক্ষাকৃত শীতল আবহাওয়াপ্রধান অঞ্চল তৈরি করেছে, গ্রীষ্মেও তাপ কমই থাকে। অতি সম্প্রতি, গত বছর থেকে, বিজ্ঞানীরা এই স্থিতাবস্থা অবসানের ইঙ্গিত পাচ্ছেন।
পৃথিবীর তাপমাত্রার হেরফেরে হিমবাহের গঠন ও ভাঙন হয়। কম তাপমাত্রায় পাথরের স্তরের উপর বরফের স্তূপ জমে হিমবাহ গঠন হয়, উপরে নতুন বরফের আস্তরণ জমে। বরফের পুরু আস্তরণ ও নীচের পাথরস্তরের সংযোগস্থলে অত্যধিক চাপে বরফের গলন হয়, যে কারণে হিমবাহ খুব ধীরে চলতে থাকে। গরমে হিমবাহের ভাঙনে বরফ গলে গেলে নীচের পাথর বেরিয়ে পড়ে। সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডে ভূবিজ্ঞানীরা এমন উন্মুক্ত বরফ-গলা পাথর পরীক্ষা করে, পাথরের কোয়ার্টজ় খনিজের কেলাসিত গঠনে বেরিলিয়াম-১০ অণু পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে এই অণু পৃথক করে, তার ঘনত্ব ও বয়স নির্ধারণ করে বলেন, কোন সময় বরফ গলে পরিত্যক্ত বালি সূর্যালোকে উন্মুক্ত হয়েছে। পৃথিবী এখন যে-হেতু গরম হয়ে উঠছে, তাই নানা জায়গায় হিমবাহও গলতে শুরু করেছে। হিমবাহের চলন-গতিপথে দুটো ভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা নিয়ে তার বয়স নির্ধারণে গতির মাত্রা বার করা সহজ হবে, সেই অনুসারে হিমবাহের ভবিষ্যৎ জেনে উপযুক্ত পদক্ষেপও সম্ভব।
পৃথিবী আগেও গরম হয়েছে, আবার ঠান্ডাও। আন্তঃ-হিমবাহকালে তাপমাত্রার সর্বোচ্চ বৃদ্ধি ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এই উষ্ণতা হিমবাহ-গলনে সহায়ক। সব বরফ হয়তো গলবে না, অনেকটাই গলে সমুদ্রে মিশে তার জলস্তর বাড়িয়ে দেবে, উপতট ভাসাবে, বাড়বে সামুদ্রিক ঝঞ্ঝা। বেশি গরম ও একই সঙ্গে বৃষ্টির আধিক্যে কৃষির স্থান, কাল ও ফসলে পরিবর্তন হবে। বাস্তুভাবনা নতুন করে ভাবতে হবে, অপেক্ষাকৃত উঁচু শীতল অঞ্চলে বাসস্থান সরাতে হবে। বিশ্বব্যাপী জৈব বৈচিত্রে বদল হবে, বহু সামুদ্রিক প্রাণ জলের তাপবৃদ্ধি সইতে না পেরে বিনষ্ট হবে। উত্তর মেরু অঞ্চলের স্থলভাগ উন্মুক্ত হওয়ায় বরফে শীতনিদ্রায় জমে থাকা বহু ব্যাকটিরিয়া ও অণুজীব নবজন্ম পাবে, যার কিছু নমুনা এখনই মিলেছে। বহু নতুন খনিজ ও খনিজ তেলের হদিসও মিলছে। আবার কৃষির জন্য অতিরিক্ত জমি পাওয়া যাবে, নতুন নগর পত্তন হবে। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে নয়, প্রাকৃতিক পরিবর্তনকে স্বীকার করে মানবসভ্যতাকে এগোতে হবে।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে