Prasanta Chandra Mahalanobis

আধুনিক ভারতের স্থপতি

তথ্য বা ডেটা যখন ফুলেফেঁপে ওঠে, সমকালীন প্রযুক্তি সংগৃহীত তথ্যকে বিশ্লেষণ করতে অপারগ, সেটাই বিগ ডেটা।

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৩৩
Share:

যুগপুরুষ: সফল প্রতিষ্ঠান ও সবল দেশ, দুইয়েরই স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।

আজ যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্লাবন ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রায় সব ধরনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে, রাশিবিজ্ঞান কি তার বাইরে থাকতে পারে? ‘ডেটা’র দুনিয়াটা আরও বেশি বদলেছে সাম্প্রতিক অতীতে— আন্তর্জালের যুগে ডেটা হয়েছে ‘বিগ ডেটা’। অবাক বিস্ময়ে দেখি, ভারতের রাশিবিজ্ঞানের কারিগর কী ভাবে সাত দশক আগেই সামলেছেন এ জাতীয় বিষয়গুলি।

তথ্য বা ডেটা যখন ফুলেফেঁপে ওঠে, সমকালীন প্রযুক্তি সংগৃহীত তথ্যকে বিশ্লেষণ করতে অপারগ, সেটাই বিগ ডেটা। এমন ঘটনা বার বার ঘটে। যেমন ঘটেছিল সদ্যস্বাধীন ভারতে, প্রচুর পরিমাণে বড় বড় সমীক্ষার ফলে যখন আসতে থাকে তথ্য। দেখা যাক, এই সমস্যা সামলাতে কী করেছিলেন ভারতের রাশিবিজ্ঞানের যুগপুরুষ। বিস্তর সাধ্যসাধনা করে, অর্থসংস্থান করে, লাল ফিতের ফাঁস আলগা করে, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ তাঁর স্বপ্নের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট-এ নিয়ে এসেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দু’টি ডিজিটাল কম্পিউটার, ১৯৫৬ আর ১৯৫৮-তে। সূচনা হয় ভারতের কম্পিউটার-যুগের। ঘটনাচক্রে ঠিক তার আগেই মহলানবিশের উদ্যোগে দু’বার— ১৯৫৪-র সংক্ষিপ্ত সময়কালে, এবং ১৯৫৫-য় দীর্ঘ সাত মাসের জন্য আইএসআই-এ আসেন এমআইটি-র কিংবদন্তি অধ্যাপক নরবার্ট ওয়েনার— উত্তরকাল যাঁকে জানে সাইবারনেটিক্স-এর স্রষ্টা হিসাবে।

বাস্তবিকই, এক জন রাশিবিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করার পাশাপাশি মহলানবিশ ছিলেন এক প্রকৃত প্রতিষ্ঠান-নির্মাতা। আইএসআই যেন তাঁর কারুশিল্পের একটি শক্তিশালী স্মৃতিস্তম্ভ। সেই সঙ্গে রাশিবিজ্ঞানী এবং গণিতবিদদের একটি প্রজন্মকেও অধ্যবসায়ের সঙ্গে লালন করেছিলেন তিনি। এঁদের মধ্যে ছিলেন রাজচন্দ্র বসু, সমরেন্দ্রনাথ রায়, ডি বি লাহিড়ি, দেবব্রত বসু, রঘুরাজ বাহাদুর এবং অবশ্যই সি আর রাও-এর মতো দিকপাল। ভারতীয় বংশোদ্ভূত একমাত্র অ্যাবেল-বিজয়ী অঙ্কবিদ এস আর এস ভারাধন-ও পিএইচ ডি করেছিলেন আইএসআই থেকে।

এই গবেষকদের শিক্ষাগত পুষ্টির অংশ হিসাবে রাশিবিজ্ঞান, গণিত, প্রকৌশল এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের ডাকসাইটে বিদেশি গবেষকদের আইএসআই-এ নিয়ে আসতেন মহলানবিশ, যে কাজকে তিনি মনে করতেন ভারতীয় গবেষকদের বিদেশ ভ্রমণের বিকল্প। আইএসআই-এর গড়ে ওঠার যুগে এখানে এসেছেন দেশ-বিদেশের প্রবাদপ্রতিম গবেষকরা— ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যর রোনাল্ড ফিশার, আমেরিকান গণিতবিদ আব্রাহাম ওয়াল্ড, সোভিয়েট অঙ্কবিদ আন্দ্রে কলমোগরভ, পোলিশ রাশিবিজ্ঞানী জার্জ়ি নেম্যান, এবং আরও অনেকে। এঁদের জ্ঞানের আলোয় ঋদ্ধ হয়েছেন ভারতীয় গবেষকরা। সে যুগে বিদেশিদের এ ভাবে আমন্ত্রণ জানানো সহজ ছিল না একেবারেই। অর্থসংস্থান ছিল কষ্টসাধ্য। যেমন, ওয়েনারকে যৌথ ভাবে আনার জন্য কী ভাবে বিভিন্ন ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে নিষ্ফল চিঠি লিখেছেন মহলানবিশ, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন অশোক রুদ্র, তাঁর লেখা মহলানবিশের জীবনীর ‘স্ট্র্যাটেজি অব ব্রেন ইরিগেশন’ শীর্ষক অধ্যায়ে। ওয়েনার আইএসআই-এ এসেছিলেন ভারতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়কালে, যখন আইএসআই দেশের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, যেখানে আইএসআই-এ পরিচালিত পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে দ্রুত শিল্পায়ন এবং সরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে দেওয়া হচ্ছে অগ্রাধিকার। ওয়েনারের প্রযুক্তিচালিত সাইবারনেটিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা স্পষ্টতই অনুপ্রাণিত ও গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন মহলানবিশ। এর আগে, ১৯৫০ সালে, ওয়েনারের বিখ্যাত বই সাইবারনেটিক্স প্রকাশের দু’বছর পরেই, পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিবিজ্ঞানের একটি সাইবারনেটিক দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রস্তাবনা করেন মহলানবিশ।

দেশ গঠনের পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ মহলানবিশের এক উল্লেখযোগ্য অবদান। শুধু দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপকার হিসাবে নয়, সদ্যস্বাধীন দেশে বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা ও তার তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে, এবং আইএসআই-এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এনএসএসও এবং সিএসও-র মতো প্রতিষ্ঠান স্থাপনায় ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রেও। তাদের লালন করা ও রূপদানের মাধ্যমে ভারতে রাশিবিজ্ঞানের এক সুদৃঢ় ইমারত তৈরিতে মহলানবিশের অবদান বটবৃক্ষের মতো ব্যাপ্ত। তাই আজকের ভারতের রাশিবিজ্ঞানীরা সকলেই যেন তাঁর মানসপুত্র— আমরাই তাঁর উত্তরাধিকার। নিখিল মেননের ২০২২-এর বই প্ল্যানিং ডেমোক্র্যাসি-তে পরিকল্পনা ও তার রূপদানের মাধ্যমে মহলানবিশের অবদান ভারতীয় গণতন্ত্রের এক ভিত্তি হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। নেহরুর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক নিঃসন্দেহে সাহায্য করেছে এই লক্ষ্যে। হয়তো দেশগঠনের অভিমুখে নেহরু এবং মহলানবিশ পরস্পরের দ্বারা খানিক প্রভাবিতও হয়ে থাকবেন। এটাও তো ঠিক, দেশের শাসকের সঙ্গে বিজ্ঞানীর উপযুক্ত যুগলবন্দি না থাকলে এ ধরনের কাজও সম্পূর্ণতা পায় না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কী ভাবে ভারতে ফেরার জাহাজ ছাড়তে দেরি হওয়ায় সেই অবকাশে কিং’স কলেজের লাইব্রেরিতে মহলানবিশের হাতে আসে স্ট্যাটিস্টিক্সের বই, তাতে আকর্ষিত হয়ে কী ভাবে তিনি ইংল্যান্ড থেকে এ দেশে নিয়ে আসেন রাশিবিজ্ঞানের বীজ, এবং কী ভাবে স্বশিক্ষিত রাশিবিজ্ঞানী হয়ে তিনি নিজে এ দেশের মাটিতে সেই বীজকে সযত্নে বপন করে, পরিচর্যা করে পরিণত করেছিলেন এক মহীরুহে, সে গল্প নানা ভাবে পরিবেশিত হয়েছে নানা জনের লেখনীতে, দীর্ঘ দিন ধরে, বিভিন্ন প্রকাশনায়। এক জন রাশিবিজ্ঞানী হিসাবেও তাঁর সমকালে তিনি ছিলেন বিশ্বপর্যায়ের। কিন্তু সেটি মহলানবিশের ‘লেগ্যাসি’র একটা ক্ষুদ্র অংশমাত্র। মহলানবিশের কীর্তি তাঁর সম্মিলিত গবেষণাকে ছাপিয়ে উঠেছে অনেক উঁচুতে।

প্রশাসক মহলানবিশ আবার ছিলেন এক দক্ষ জহুরিও। আন্তর্জালহীন সে দিনের দুনিয়ায় তিনি খুঁজে বার করেছিলেন দেশ-বিদেশের মণিমুক্তোদের, এবং তাঁদের জড়ো করেছিলেন আইএসআই-এ। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। দিল্লি আইএসআই-এ প্ল্যানিং ইউনিট চালু হয় মহলানবিশ-যুগের একদম শেষ পর্বে। মহলানবিশ সেখানে নিয়ে এলেন এক ঝাঁক তরুণকে, যাঁরা হয়ে উঠবেন ভবিষ্যতের উজ্জ্বল তারকা। সে দলে ছিলেন প্রণব বর্ধন, টি এন শ্রীনিবাসন, বি এস মিনহাস, সি রঙ্গরাজন। আর ছিলেন তরুণ জর্জ অ্যাকারলফ, যিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাবেন ২০০১ সালে। অ্যাকারলফের নোবেলজয়ী গবেষণাপত্র ‘দ্য মার্কেট ফর লেমনস: কোয়ালিটি আনসার্টেনটি অ্যান্ড দ্য মার্কেট মেকানিজ়ম’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০-এ। এই কাজের সূত্রপাত তাঁর আইএসআই-এর সময়সীমাতেই।

তাঁর উৎসাহ ছিল অনেকটাই অর্থনীতি-ঘেঁষা। তা গুরুত্বপূর্ণ রূপ পায় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপদান-কালে। দুই-সেক্টর মডেল বানিয়ে ফেলেন তিনি। ‘ফেল্ডম্যান মডেল’ নামে অনেকটা একই ধরনের মডেল করা হয়েছে সোভিয়েটে, ১৯২৮-এ। পরবর্তী কালে প্রশান্তচন্দ্র করেছেন চার-সেক্টর মডেল। আসলে সে এক অনন্য সময়— দেশ এবং সমাজের এক ক্রান্তিকাল। দিনবদলের তালে এক জাতির গড়ে ওঠার সময়প্রবাহ। ‘প্ল্যানিং ডেমোক্র্যাসি’ সংক্রান্ত প্রশান্তচন্দ্রের কর্মকাণ্ড আর পরিকল্পনার রূপরেখাকে তাই বিচার করতে হবে সেই সময়ের ছাঁচে ফেলে। যেমন, ১৯৫৫-তে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-য় প্রচারিত মহলানবিশের বক্তব্যে ইস্পাত উৎপাদনকে বলা হল জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক।

মানবকল্যাণের জন্য প্রযুক্তির সহায়তা গ্রহণের এক অদ্ভুত দক্ষতা ছিল মহলানবিশের, সম্ভবত পদার্থবিদ্যায় তাঁর প্রশিক্ষণের কারণেই। রাশিবিজ্ঞানকে তিনি মনে করতেন ‘মানব-প্রচেষ্টার দক্ষতা বৃদ্ধির উপযোগী এক নতুন প্রযুক্তি’। তাঁর মূল চিন্তাধারা তাই প্রযোজ্য ভিন্ন সময়ে, ভিন্নতর প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটেও। আজকের বিগ ডেটা কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝাপটা তিনি যে সামলাতে পারতেন অনেকের চেয়ে দক্ষতর হাতে, সেটাও অনুমেয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র দ্বারাঅনুপ্রাণিত মহলানবিশের ছিল ত্রুটিহীনতা এবং পরিপূর্ণতার দিশায় এক অদ্ভুত দক্ষতা, অক্লান্ত নিষ্ঠা, উজ্জ্বল নেতৃত্ব— যিনি ‘সময় ও স্থানের প্রেক্ষিতে সংখ্যার নাচের ছন্দ’ বুঝতে পারতেন তথ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করা অন্য অনেকের চেয়ে বেশি পরিমাণে। আজকের পরিপ্রেক্ষিতেও হয়তো তিনিই হতে পারতেন বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণের এবং জনকল্যাণকর পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য রাষ্ট্রের সেরা বাজি।

অথচ, আজ যাঁরা শীর্ষক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান করেন, তাঁদের মধ্যেই কেউ কেউ নির্দ্বিধায় অপমানজনক মন্তব্য করতে পারেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ সম্বন্ধে, তাচ্ছিল্য করে তাঁকে ‘ওই লোকটা’ বলতে পারেন। তাতে অবশ্য প্রশান্তচন্দ্রর কিচ্ছুটি আসে যায় না— হাউই এবং তারকার গল্পটি আজও একই রকম সত্য বলেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন